সংস্কৃতের মতো প্রাচীন ও ঐতিহ্যশালী ভাষাকে রাজ্য সরকার সম্পূর্ণ অবহেলা করছে বলে অভিযোগ জানিয়ে মামলা দায়ের করা হয়েছে কলকাতা হাইকোর্টে। সেই মামলায় বলা হয়, বাংলার বেশির ভাগ টোল চতুষ্পাঠীই ধুঁকছে। তারই মধ্যে কিছু টোলের এক শ্রেণির অধ্যাপক তদ্বির-তদারক করে বাড়তি টাকা পেয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ। বিচারপতি বিশ্বনাথ সমাদ্দারের মন্তব্য, “বোঝা যায়, রাজনৈতিক রং দেখে এই টাকা দেওয়া হয়।”
মামলাটি করেছেন সংস্কৃত ভাষা বিশেষজ্ঞ দীননাথ মিশ্র। তাঁর আবেদনে বলা হয়, সংস্কৃত ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা এবং তার প্রসারের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার প্রতি বছর অনুদান প্রচুর টাকা বাবদ পাঠায়। কিন্তু সেই টাকা ভাষা প্রসারের কাজে না-লাগিয়ে নয়ছয় করা হচ্ছে। বিচারপতি সমাদ্দার বুধবার রাজ্যের স্কুলশিক্ষা সচিবকে এজলাসে ডেকে পাঠিয়ে জানিয়ে দেন, আদালত এ ভাবে সংস্কৃত ভাষার অবহেলা বরদাস্ত করবে না। ১ অক্টোবরের মধ্যে রাজ্য সরকারকে জানাতে হবে, কেন্দ্রীয় অনুদানের টাকার যথাযথ ব্যবহার এবং সংস্কৃত ভাষাকে মূল্য দেওয়ার জন্য তারা কী কী ব্যবস্থা নিচ্ছে।
দীননাথবাবুর আইনজীবী কাশীকান্ত মৈত্র বলেন, রাজ্যে ৮০০ টোল চতুষ্পাঠী রয়েছে। দু’টি করে পদ আছে সেগুলিতে। একটি অধ্যাপকের পদ এবং অন্যটি সেবকের। ওই অধ্যাপকেরা মাসে ১৫০০ হাজার টাকা পান। টোলগুলিতে স্মৃতি, কাব্য, সাংখ্য ইত্যাদি বিষয়ে পড়াশোনা হয় তিনটি স্তরে। ওই তিনটি স্তর হল আদ্য, মধ্য, উপাধি বা তীর্থ।
কাশীকান্তবাবুর অভিযোগ, সরকারি ভাবে টোলের সংখ্যা ৮০০ হলেও তাদের বেশির ভাগেই পড়ুয়া নেই। অথচ ওই টোলের নামে খরচ কিন্তু হয়েই চলেছে। টোল রয়েছে খাতায়-কলমে, রাজ্য সরকার খোঁজও নেয় না। সংস্কৃত ভাষাকে ন্যূনতম মর্যাদা দেওয়ার ব্যবস্থাও করেনি রাজ্য। কিছু টোলের অধ্যাপক রাজ্য সরকারের এই সংক্রান্ত অ্যাড-হক কমিটিকে ধরে মাসে ছ’হাজার টাকার বন্দোবস্ত করে নিয়েছেন। বিচারপতি তখনই রাজনৈতিক রং দেখে ওই টাকা দেওয়া হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন।
বিচারপতি বলেন, সংস্কৃতের মতো প্রাচীন ভাষাকে বাঁচিয়ে রেখে তার গবেষণায় নজর দেওয়া প্রয়োজন।
অথচ তাকে অবহেলা করা হচ্ছে। এটা দুর্ভাগ্যের। স্কুলশিক্ষা সচিব অর্ণব রায়ের কাছে বিচারপতি জানতে চান, টোলগুলিতে যে-পরীক্ষা হয়, কারা তা নিয়ন্ত্রণ করেন?
স্কুলশিক্ষা সচিব বলেন, বঙ্গীয় সংস্কৃত শিক্ষা পরিষদ বলে একটি সংস্থা ওই পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করে। একটি সূত্রের খবর, আগামী ২৬, ২৭, ২৮ এবং ২৯ সেপ্টেম্বর উপাধি পরীক্ষার দিন নির্দিষ্ট হয়েছে। কিন্তু আদি ও মধ্য পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে না।
বিচারপতি জানতে চান, বঙ্গীয় সংস্কৃত শিক্ষা পরিষদের যিনি প্রধান, তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা কী?
সচিব জানান, তিনি সংস্কৃত কলেজে পড়াশোনা করেছেন।
বিচারপতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এ-রকম পদে কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তি থাকবেন না, এটা ভাবা যায় না!
কাশীকান্তবাবু বলেন, আগে শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ, নারায়ণ কীর্তিতীর্থের মতো ভাটপাড়ার বিশিষ্ট পণ্ডিতেরা চতুষ্পাঠীর পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করতেন। কিন্তু এখন এমন লোকেদের দিয়ে সেই সব কাজ করানো হচ্ছে, সংস্কৃতের প্রতি যাঁদের আগ্রহই নেই।
সব শোনার পরে বিচারপতি টোলের সব পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেন। রাজ্য সরকারের কাছে জানতে চান, টোলগুলির উন্নয়ন ও সংস্কৃত ভাষার ঐতিহ্য রক্ষা করার জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
স্কুলশিক্ষা দফতরের আইনজীবী দেবব্রত চট্টোপাধ্যায় আদালতে বলেন, সরকার কয়েক দিনের মধ্যেই টোল ও সংস্কৃতের উন্নয়নে রূপরেখা তৈরি করে আদালতে পেশ করবে। |