হর্নের ‘দাদাগিরি’
আইনে কী আছে জানে না পুলিশই
ইন আছে। আইন ভাঙার মোটা ফাইনও আছে। তবে তার প্রয়োগ হয় না ঠিক মতো। এমনকী, আইনে ঠিক কী ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে, তা নিয়ে সচেতন নন পুলিশেরই একটা বড় অংশ। আর সেই ফাঁক গলেই দেদার বাজছে হর্ন। ঝালাপালা হচ্ছে গোটা শহর। সাইলেন্স জোনেও নির্বিচারে বহাল হর্নের রাজপাট। অবশেষে এত দিন পরে হর্নের দৌরাত্ম্য রোখার ব্যাপারে কড়া আইনি পদক্ষেপ করতে উদ্যোগী হচ্ছে পুলিশ। বাস-ট্যাক্সির চালকেরা অবশ্য পাল্টা দাবি করেছেন, পথচারীদের সচেতনতা না বাড়লে হর্ন বাজানো কমানো যাবে না। গাড়ির হর্ন অনর্থক না বাজানোর ব্যাপারে চালকদের সচেতন করতে সোমবার স্কুলপড়ুয়ারা পথে নেমেছিল। তাতে হর্নের পীড়া থেকে সাময়িক মুক্তি মিলেছিল। তবে মঙ্গলবারই প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বাজা হর্ন স্বমূর্তিতে ফেরে। বেলা সাড়ে ১২টা। এজেসি বসু রোড-হরিশ মুখার্জি রোডের মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যাল সবুজ হতেই বিকট হর্ন। সঙ্গে অ্যাম্বুল্যান্সের সাইরেন, দ্রুতগতির মোটরসাইকেলের আওয়াজে তীব্র শব্দদূষণ। অথচ ওই গোটা তল্লাট নো হর্ন জোন। ওই মোড়েই, হরিশ মুখার্জি রোডের উপর এসএসকেএম হাসপাতাল, একটি স্কুল ও একটি কলেজ। একই অবস্থা হাজরা মোড় ও তার আশপাশে। ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে একটি কলেজ এবং দু’টি হাসপাতাল। তার তোয়াক্কা না করে সিগন্যাল খোলা মাত্রই আগে যাওয়ার তাড়ায় তুমুল হর্ন দিতে লাগল বাস-মিনিবাস-ট্যাক্সি-মোটর সাইকেল সকলেই।
ভেঙে পড়ে আছে ‘নো হর্ন’ বোর্ড।
মঙ্গলবার, এসএসকেএম হাসপাতালের সামনে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
গোখেল মেমোরিয়াল স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সুজাতা চট্টোপাধ্যায় বলেন, “হর্নের আওয়াজে পড়াশোনা ও স্কুলের অন্যান্য কাজে খুব অসুবিধে হয়। বহু বার পুলিশের সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলেছি। যাঁরা গাড়ি চালান, তাঁরা ‘নো-হনর্র্’ প্রতীক দেখেও কী করে জোরে হর্ন বাজিয়ে যান, সেটা মাথায় ঢোকে না।” পরিবেশ সুরক্ষা আইন অনুযায়ী, সাইলেন্স জোনে হর্ন বাজানোর অপরাধে ছ’মাসের জেল কিংবা এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা দু’টোই হতে পারে। শুধু তা-ই নয়, পুলিশ এ ক্ষেত্রে নিজেই আইনভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের মতো কোনও সংস্থার থেকে অভিযোগের প্রয়োজন হয় না। অথচ লালবাজারের কর্তাদের এবং ট্রাফিক পুলিশের অধিকাংশ এই বিষয়টি জানেন না। যদি পুলিশ আদৌ আইনভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়, তা হলে ব্যবস্থা বলতে সেই মোটরযান আইনে ১০০ টাকা জরিমানা। তা দিয়েই ছাড় পেয়ে যান শব্দদূষণ সৃষ্টিকারী চালক। অথচ নিউ ইয়র্কে এই জরিমানার পরিমাণই ৩৫০ ডলার অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রায় ২২৩০৯ টাকা (মঙ্গলবার এক ডলারের দাম ছিল ৬৩.৭৪ টাকা)।
হর্নের দৌরাত্ম্য রুখতে তাই অবশেষে নড়েচড়ে বসছে পুলিশ। লালবাজারের এক শীর্ষকর্তা এ দিন বলেন, “হর্ন থেকে শহরে শব্দদূষণ দিন দিন যে ভাবে বাড়ছে, তাতে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া আর উপায় নেই। এ বার পরিবেশ সুরক্ষা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছি আমরা।” সোমবার সাইলেন্স জোনে এবং অন্যান্য জায়গায় অনর্থক হর্ন বাজানোর অভিযোগে ট্রাফিক পুলিশ প্রায় ১০০টি মামলা রুজু করেছে। সাধারণ দিনে মামলার সংখ্যা আরও কম হয় বলে লালবাজার সূত্রের খবর। ২০০৮-এর ৭ এপ্রিল মুম্বই ট্রাফিক পুলিশ প্রথম বার দেশে ‘নো-হর্ন ডে’ পালন করে। পরে দেখা গিয়েছে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে স্বেচ্ছাসেবক পুলিশকর্মী বাড়িয়ে এই বিষয়ে নজর দেওয়ায় অযথা হর্ন বাজানোর প্রবণতা অনেক কমেছে।
পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তের বক্তব্য, “সাইলেন্স জোনে অনুমোদিত শব্দসীমা ৪০-৪৫ ডেসিবেল। অথচ বাস্তবে এই ডেসিবেলের মাত্রা দিনে এবং সন্ধ্যার ব্যস্ত সময়ে ১০০ ডেসিবেল ছাড়িয়ে যায়।” ২০০৯ সালে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কলকাতা শহরের ১০টি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছিল, প্রতিটি জায়গায় শব্দসীমা অনুমোদিত ডেসিবেলের চেয়ে অনেক বেশি। ইএনটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তুষারকান্তি ঘোষ বলেন, “অনবরত হর্নের শব্দের মধ্যে থাকতে থাকতে অনেকের শ্রবণশক্তি কমে যায়, শ্রবণক্ষমতা নষ্টও হতে পারে। কলকাতা শহরে এই ধরনের রোগী দিন দিন বাড়ছে। তার অন্যতম কারণ, এই অতিরিক্ত হর্ন-এর ব্যবহার। তা ছাড়া, এই ধরনের শব্দ থেকে মাথার যন্ত্রণা হতে পারে, মনোসংযোগও নষ্ট হয়।”
সুভাষবাবুর কথায়, “মানুষ এমনিতে শুনতে না চাইলে, আইনের ভয় দেখিয়ে তাঁদের শৃঙ্খলা মানতে বাধ্য করাতে হবে।” দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য আইন আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, “পুলিশকে অভিযান চালিয়ে আইনভঙ্গকারীকে কঠোর শাস্তি দিতে হবে।” তাঁর মতে, হর্ন বাজানোটা চালকদের একাংশের কাছে নেশার মতো। ফাঁকা রাস্তাতেও তাঁরা হর্ন বাজান। এমনকী, হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে ঢোকার সময়েও চিকিৎসকেরাও অনেকে হর্ন বাজিয়ে ঢোকেন।
বাস ও ট্যাক্সি চালকদের অনেকেরই বক্তব্য, কলকাতায় পথচারীদের অধিকাংশই নিয়ম মানেন না, সিগন্যাল সবুজ থাকলেও তাঁরা রাস্তা পার হন। পথচারীদের একাংশের যুক্তি, হাঁটার মতো ফুটপাথই বেশির ভাগ জায়গায় নেই। পেশায় ব্যবসায়ী ইন্দ্র বসুর কথায়, “হর্ন না দিলে যে কোনও মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটবে।” চালকদের দাবি, আগে মানুষকে রাস্তা পার করার ক্ষেত্রে সচেতন করতে হবে, তবেই হর্ন বাজানো কমবে।”

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.