ফৌজদারি মামলার বিচার যাতে দ্রুত শেষ হয়, সে জন্য স্পষ্ট বিধান আছে।
সুপ্রিম কোর্টও বারংবার বলেছে,
সংবিধানে প্রদত্ত জীবনের অধিকারের মধ্যেই দ্রুত বিচারের অধিকার নিহিত আছে। কিন্তু বাস্তব কেন বাধ্যতে।
বিবেক দেবরায় |
দেওয়ানি মামলার তুলনায় ফৌজদারি অপরাধের বিচার নিয়ে তুলনায় অনেক কম আলোচনা হয়। এই লেখাটি সেই বিষয়েই। এক দিক থেকে, দেওয়ানি মামলার চেয়ে ফৌজদারি মামলার বিচার দ্রুত নিষ্পন্ন হওয়া বেশি জরুরি, কারণ এ ক্ষেত্রে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে বন্দি রাখার প্রবণতা অনেক বেশি।
বিচারের ক্ষেত্রে ‘অপরাধ’ কাকে বলে, সেটা আইনের প্রেক্ষিতেই নির্ধারণ করা যায়। ভারতীয় দণ্ডবিধিতে অপরাধের যে সংজ্ঞা, সেটা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ। এই দণ্ডবিধিতে নির্দিষ্ট অপরাধ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো’র (এন সি আর বি) রিপোর্টে। তাতে দেখা যাচ্ছে, দেশে ষাটের দশকে যত ফৌজদারি মামলা আদালতে উঠত, তার মোটামুটি ত্রিশ শতাংশের বিচার নিষ্পন্ন হত। এখন অনুপাতটা নেমে এসেছে পনেরো শতাংশে। যে সব অপরাধ সম্পর্কিত বিচার সবচেয়ে বেশি বকেয়া আছে, তাদের মধ্যে আছে প্রতারণা, বিশ্বাসভঙ্গ, ডাকাতি, চুরি, মেয়ে-পাচার। যৌন লাঞ্ছনা, ধর্ষণ, পণপ্রথাজনিত মৃত্যু, খুন ব্যতীত নরহত্যা, হত্যার চেষ্টা ইত্যাদি অপরাধের ক্ষেত্রে নিষ্পত্তির হার তুলনায় ভাল। ভাল বলছি না, বলছি আগে উল্লেখ করা অপরাধগুলির তুলনায় ভাল। |
দ্রুত বিচার চাই। জেলা ও দায়রা আদালত, বারাসত। ছবি: বিশ্বরূপ দত্ত। |
পশ্চিমবঙ্গের হাল কেমন? বছরে বছরে পরিসংখ্যানের হেরফের হয়। তবে, এখন বছরে গড়ে হাজার পঁয়ত্রিশ মামলার নিষ্পত্তি হয়, হাজার দুয়েক তুলে নেওয়া হয় বা বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু নতুন মামলা রুজু করা হয়। সব মিলিয়ে মোটামুটি লাখ চারেক ফৌজদারি মামলা বকেয়া আছে।
ভারতীয় দণ্ডবিধির বাইরে অনেকগুলি বিশেষ এবং স্থানীয় আইনে বিশেষ বিশেষ ধরনের ফৌজদারি অপরাধের বিচার হয়। এই আইনগুলির মধ্যে আছে অস্ত্র আইন, মাদক আইন, বিস্ফোরক পদার্থ সংক্রান্ত আইন, পণ নিবারণ আইন, জুয়াখেলা সংক্রান্ত আইন ইত্যাদি। অন্যান্য রাজ্যের মতোই পশ্চিমবঙ্গেও এই আইনগুলির এক্তিয়ারে থাকা মামলায় নিষ্পত্তির হার বেশি। এ ক্ষেত্রে হাজার পঞ্চাশেক মামলা বকেয়া থাকে। বছরে গড়ে শ’দুয়েক মামলা বাতিল বা প্রত্যাহার করা হয়। নিষ্পত্তি হয় হাজার আষ্টেকের। এই সব অপরাধের একটা বড় অংশ অর্থনীতি সংক্রান্ত। এখানে একটা প্রশ্ন ওঠে। এই সব ক্ষেত্রে সব অপরাধই কি সত্য সত্যই অপরাধ বলে গণ্য হওয়ার যোগ্য? যেমন, মদ খাওয়া বা জুয়াখেলা কি নিষেধ করা উচিত? জুয়াখেলা যদি অপরাধ হয়ও, তা কি ফৌজদারি অপরাধ হওয়া উচিত?
ফৌজদারি মামলার বিচার চলে বিভিন্ন স্তরের আদালতে: জেলা বা দায়রা বিচারক, অতিরিক্ত দায়রা বিচারক, মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট ও অন্যান্য আদালতে। একটা ফৌজদারি মামলার নিষ্পত্তি হতে কত সময় লাগে? বকেয়া মামলার ক্ষেত্রে তথ্য নেই, নিষ্পন্ন মামলার ক্ষেত্রে আছে। (কেন জানি না, ইদানীং এই তথ্য প্রকাশ বন্ধ আছে।) গড়পড়তা ৩.৫ শতাংশ মামলার নিষ্পত্তি হতে সময় লাগে দশ বছরের বেশি, ১১ শতাংশের ক্ষেত্রে পাঁচ থেকে দশ বছর, ২৫ থেকে ৩০ শতাংশের নিষ্পত্তি হয় তিন থেকে পাঁচ বছরে, ১ থেকে ৩ বছরে মেটে ৩২ শতাংশ, ১৮ শতাংশ নিষ্পন্ন হয় ৬ মাস থেকে ১ বছরের মধ্যে, বাকিটা ৬ মাসের মধ্যে। এই পরিসংখ্যান একটু পুরনো, এবং বকেয়া মামলার হিসেব এর মধ্যে নেই। তাই এ থেকে ঠিক ছবিটা পাওয়া যায় না। তাতেও দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে হাজার দুয়েক ফৌজদারি মামলা দশ বছরের বেশি চলছে, হাজার চারেক ঝুলে আছে পাঁচ থেকে দশ বছর।
অথচ ফৌজদারি মামলার বিচার যাতে দ্রুত শেষ হয়, সে জন্য সুস্পষ্ট বিধান আছে। যেমন, এ জন্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিয়োর-এর ৩০৯ ধারায় আদালতকে অনেক ক্ষমতা দেওয়া আছে। অনেকগুলি মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট দ্রুত বিচারের উপর বিশেষ জোর দিয়ে বলেছে যে, সংবিধানের ২১ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রদত্ত জীবনের অধিকারের মধ্যেই দ্রুত বিচারের অধিকার নিহিত আছে। এটা ঠিকই যে, অভিযুক্তরা অনেক সময় বিচারের প্রক্রিয়া বিলম্বিত করতে সব রকম চেষ্টা করেন, কারণ অপরাধ প্রমাণের দায়িত্ব প্রশাসনের। ফৌজদারি মামলার নিষ্পত্তির সময় বেঁধে দেওয়া সব ক্ষেত্রে যুক্তিসংগতও ন। কিন্তু ছোটখাটো অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে অনেক বিচারাধীন বন্দি যত দিন কয়েদ থাকে, সংশ্লিষ্ট অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা পেলেও তত দিন জেল খাটতে হত না। এটা নিশ্চয়ই খুব স্বাভাবিক অবস্থা নয়!
বকেয়া মামলার এই সমস্যা স্বাধীনতার আগেও ছিল। কিন্তু সমস্যার বহর উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। ১৯২৪ সালের র্যান্কিন কমিটি থেকে শুরু করে ফৌজদারি মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়টি পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকটি কমিটি বা কমিশন বসানো হয়েছে। যত রকম কারণ থাকা সম্ভব, সবই চিহ্নিত হয়েছে। মামলার সংখ্যা ও জটিলতা বৃদ্ধি, আইনের আধিক্য, নির্বাচন সংক্রান্ত বিবাদ, আপিলের সংখ্যাবৃদ্ধি, কিছু কিছু হাইকোর্টের পুরনো ‘ওরিজিনাল জুরিসডিকশন’-এর আবসান না ঘটা, যথেষ্টসংখ্যক বিচারকের অভাব, হাইকোর্টে বিচারকের শূন্যপদ পূরণে বিলম্ব, বিচারক নিয়োগে ত্রুটি, হাইকোর্টে কর্মীর ঘাটতি, স্থানাভাব, পুরনো মামলার নিষ্পত্তিকে প্রাপ্য অগ্রাধিকার না দেওয়া, এক ধরনের মামলাকে একসঙ্গে নিয়ে এসে নিষ্পত্তির সুযোগ যথেষ্ট কাজে না লাগানো, শুনানি অনাবশ্যক মুলতুবি রাখা, আদালতে অত্যধিক ও যথেচ্ছ কর্মবিরতি ইত্যাদি অসংখ্য কারণে বিচার বিলম্বিত হয়। ২০০০ সালে মলিমাথ কমিটির রিপোর্টেও এ ধরনের বহু সমস্যার কথা বলা হয়েছিল। সবগুলিই কিছুটা সত্য। তবে এ সবের সঙ্গে যোগ করা দরকার পুলিশের কাঠামোটির সমস্যাও। পুলিশ প্রশাসনের কাঠামো থেকে ফৌজদারি বিচার প্রক্রিয়াকে আলাদা করা যায় না। পুলিশ প্রশাসনের সংস্কারের বিষয়টি আলোচনা করব পরের লেখায়। |
দিল্লিতে সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এ অর্থনীতিবিদ
|