প্রবন্ধ ১...
ইসলামি দুনিয়া যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে
যে রাজনৈতিক ডামাডোল মিশরে চলছে, তার বহু মারাত্মক ফলাফল সম্ভব। একে একে সেগুলো টের পাওয়া যাবে। কিন্তু তার মধ্যে একটি বিষয় নিয়ে গোটা দুনিয়ার মুসলমানরা উদ্বিগ্ন হয়ে রয়েছেন। আরব অঞ্চলে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ যে দেশটি ইসলামি দুনিয়ার বৌদ্ধিক রাজধানী, শিক্ষা ও পরমতসহিষ্ণুতার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল, সেই মিশরে গোষ্ঠীবাদ ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠবে এবং অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়বে। এর প্রভাব মিশরে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বৃহত্তর মুসলমান বিশ্বকে প্রভাবিত করবে। ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার’-এ জঙ্গি হানার বারো বছর পূর্ণ হল আজ। আরব দুনিয়ায় ক্রমবর্ধমান গোষ্ঠীবাদ যে আল কায়দার নীতি ও রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত, তা আজ সংশয়াতীত ভাবে বলা চলে। আবার, আল কায়দার বিরুদ্ধে পশ্চিমি দুনিয়া যে ভাবে সামরিক অভিযান চালিয়েছে, তার সঙ্গেও এই বিচ্ছিন্নতাকামী গোষ্ঠীবাদের সম্পর্ক অনস্বীকার্য।
কায়রোর রাস্তায় মুসলিম ব্রাদারহুড আর সামরিক বাহিনীর মধ্যে সংঘাত অব্যাহত। এরই মধ্যে মিশরের স্থানীয় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের দিকে সংখ্যাগরিষ্ঠরা আঙুল তুলেছেন অভিযোগ, তাঁরা সামরিক বাহিনীর পক্ষে, তাঁরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হাত মেলাতে উত্‌সুক। আরও সহজ অভিযোগ তাঁরা আলাদা। মিশরের সাড়ে আট কোটি মানুষের দশ শতাংশ এই ‘কপ্টিক ক্রিশ্চান’ ধর্মগোষ্ঠীভুক্ত। গত দু’বছরে বহু চার্চ এবং অন্যান্য প্রতীক আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে, তাঁরা সাক্ষী থেকেছেন।
ধ্বংস ও নির্মাণ। ৯/১১-র বর্ষপূর্তিতে এক শিশুর শিল্পকৃতি।—নিজস্ব চিত্র।
সিরিয়াতেও একই ঘটনা ঘটছে। সে দেশের দু’কোটি ত্রিশ লক্ষ মানুষের আট শতাংশ খ্রিস্টান। সরকারি সামরিক বাহিনী আর বিদ্রোহী গোষ্ঠী, উভয় পক্ষই তাঁদের যথেচ্ছ হত্যা করছে। ইরাকে অ-মুসলিম সংখ্যালঘুমাত্রেই খুন হতে হবে, এই কথাটি আল কায়দা প্রায় জীবনের সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যত। শুধু অ-মুসলিমই বা কেন? সুন্নি ইসলামের আল কায়দা-কৃত অসহিষ্ণু ব্যাখ্যা যে শিয়া মুসলমানরা মাথা পেতে মানতে নারাজ, তাঁদেরও নিকেশ করে দেওয়াই আল কায়দার নীতি। শুধু জুলাই মাসেই ইরাকে প্রায় হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। তাঁদের অধকাংশই শিয়া।
পশ্চিম এশিয়া থেকে পাকিস্তানের দিকে নজর ফেরানো যাক। সেখানেও গোষ্ঠীবাদ যে জায়গায় পৌঁছেছে, তা অদৃষ্টপূর্ব। সুন্নি চরমপন্থীরা নির্বিচারে খ্রিস্টান, শিয়া হত্যায় মেতেছে। এমনকী, ইসমাইলিরাও তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। শিয়া মুসলমানদের মধ্যে এই বিশেষ গোষ্ঠীটি শান্তিপ্রিয়তার জন্য খ্যাত। পাকিস্তানে যত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে, তার পিছনে ইসমাইলি গোষ্ঠীর অবদান অনস্বীকার্য। পাকিস্তানের সাত লক্ষ সৈনিক-সমৃদ্ধ সেনাবাহিনী বা অতি দুর্বল সরকার, কোনও পক্ষেরই এই সন্ত্রাসে লাগাম পরানোর সামর্থ নেই। সম্ভবত ইচ্ছাও নেই। ফলে, উগ্রপন্থীদের তৈরি করা সন্ত্রাসের রাজত্বে সে দেশের কাঠামো কার্যত ভেঙে পড়ছে।
কোনও একটি রাষ্ট্রের একশো শতাংশ মানুষই একটি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, ইসলামের ইতিহাসে কখনও এমন হয়নি। এমনকী, কোনও কট্টর সুন্নি-শাসিত রাষ্ট্রেও সব মানুষ একই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। ইহুদিরা নবী মহম্মদের সহনাগরিক ছিলেন। শুধু ইহুদিই নয়, বহু পৌত্তলিক ধর্মাবলম্বীও মহম্মদের সঙ্গে একই অঞ্চলে বাস করেছেন। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মুসলমানদের আচরণ কী হওয়া উচিত, কোরানে বার বার তার স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে বলা হয়েছে, তাদের রক্ষা করাই মুসলমানদের কর্তব্য।
ইসলামের প্রথম পর্যায়ে দুনিয়ার বহু সংখ্যালঘু গোষ্ঠী যারা নিজেরা কোনও না কোনও ধরনের দমন নীতির মধ্যে বাঁচতে বাধ্য ছিল এই ধর্মকে নিজেদের দুনিয়ায় স্বাগত জানিয়েছিল। ইসলামের চারিত্রিক উদারতার কারণেই এই দরজা খুলেছিল। আবার, পঞ্চদশ শতকে যখন ক্যাথলিক স্পেন থেকে ইহুদিরা বিতাড়িত হয়েছিলেন, তখন মুসলিম দুনিয়াই তাঁদের আশ্রয় দিয়েছিল। অতীতের মুসলমান সম্রাটরা তাঁদের রাজত্বে ইসলামের বিভিন্ন গোষ্ঠীকে, অন্যান্য ধর্মকেও যথেষ্ট জায়গা দিয়েছিলেন। যে শাসকরা এই কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, যাঁরা কোনও একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর শাসনকেই গোটা সাম্রাজ্যের ওপর চাপাতে চেয়েছিলেন, তাঁরাই শাসক হিসেবে ব্যর্থ হয়েছেন। ইতিহাসের এই শিক্ষা আজকের দুনিয়ার মুসলমানরা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছেন বলেই সংশয় হয়। আজ বিশ্ব জুড়ে মুসলমান সমাজকে ক্ষতবিক্ষত করছে যে সংকীর্ণ গোষ্ঠীবাদ, তা ইতিহাসে এই প্রথম।
এর দায় সবাইকেই নিতে হবে। এক দিকে যেমন রয়েছে শিয়া চরমপন্থা। ইরানের বিপ্লবে তার জন্ম। বহু ইসলামি সমাজের ওপর, বিশেষত শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর, এই চরমপন্থা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অন্য দিকে আছে সুন্নি চরমপন্থা। এর জন্ম আল কায়দার উত্থানের আগেই। উপসাগরীয় অঞ্চলে তেলের পয়সায় নব্য ধনী শাসকরা যে ভাবে ওয়াহাবিবাদের জন্য অর্থ জুগিয়েছেন, অথবা অন্যান্য চরমপন্থী চিন্তায় বাতাস করেছেন, সুন্নি চরমপন্থার জন্ম সেখানে।
১৯৭০-এর দশক থেকে সৌদি আরব এবং অন্যান্য উপসাগরীয় সুলতানিয়তগুলি ওয়াহাবিবাদের প্রসারের জন্য যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে, সেই টাকা যদি প্রতিটি মুসলমান শিশুকে সাক্ষর করার কাজে খরচ করা হত, তা হলে ইসলামি দুনিয়া আজ অশিক্ষা আর অজ্ঞতায় পূর্ণ হত না হয়তো নোবেল প্রাপকদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা বাড়ত অনেকটাই। সৌদি আরবে খ্রিস্টান বা অন্য কোনও ধর্মাবলম্বী মানুষের নিজস্ব উপাসনার অধিকারটুকুও নেই হজরত মহম্মদ যা বলেছিলেন, এই সমাজ তার ঠিক উল্টো পথে হেঁটেছে।
এমন দাবি করছি না যে, ইসলামি দুনিয়ার প্রথম যুগ থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নি এবং সংখ্যালঘু শিয়াদের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ছিল না। কিন্তু যত দিন পর্যন্ত সেই দ্বন্দ্বে রাজনীতির বাতাস লাগেনি, গোষ্ঠীবাদের আগুন এমন লেলিহান হয়ে ওঠেনি। বিভেদের আগুনকে এমন মারাত্মক করে তোলার কৃতিত্ব রাজনৈতিক শক্তিগুলির, যাঁদের মূল লক্ষ্য রাষ্ট্র এবং ধর্মীয় নীতির সর্বেসর্বা হয়ে ওঠা। ধর্মের মধ্যে রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ঢুকে পড়ার ফল কী হতে পারে, খ্রিস্টান দুনিয়ার দিকে তাকালেই তার মোক্ষম উদাহরণ দেখা যাবে। বহু শতাব্দী ধরে প্রোটেস্টান্ট ও ক্যাথলিকদের মধ্যে যে লড়াই চলেছিল, তার কেন্দ্রে ছিল একটিই প্রশ্ন: কোন গোষ্ঠীর নীতি অনুযায়ী রাষ্ট্রের শাসন চলবে? এই লড়াইয়ে ইউরোপ তুমুল রক্তাক্ত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আমেরিকা দখল করে সেখানে সাম্রাজ্য স্থাপনের পর লড়াই শেষ হয়েছে।
কিন্তু, আজকের মুসলিম বিশ্বের শাসকরা যে সুপরিকল্পিত উন্মত্ততার সঙ্গে গোষ্ঠীবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন, তাকে বোঝা দায়।। পাকিস্তানের কথাই ধরা যাক। ১৯৪৭ সালে জন্মলগ্নে তার নাগরিকদের ২৩ শতাংশ ছিলেন বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত। আজ তা মাত্র তিন শতাংশে এসে ঠেকেছে। পাকিস্তানের ‘মধ্যরাত্রির সন্তান’দের প্রজন্মের এক জন হিসেবে দেখেছি, কী ভাবে সে দেশে সংখ্যালঘুর সংখ্যা কমে গেল। অসহিষ্ণু শাসকগোষ্ঠী ও চরমপন্থী সুন্নি ধর্মাবলম্বীরা প্রথমে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মেরে তাড়াল। হিন্দু এবং শিখরাও দ্রুত পাকিস্তান ছাড়লেন। তার পর খ্রিস্টানরা ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য হলেন। তার পর আরম্ভ হল এক অন্য নিষ্ক্রমণ: ইসমাইল, আহমেদি, শিয়া, বোরা, মেমন ইসলামেরই বিভিন্ন গোষ্ঠীভুক্ত মানুষ ভিন্‌ দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হলেন। যে ক্ষুদ্র গোষ্ঠীবাদের শিকার হয়ে তাঁরা পাকিস্তান ছাড়লেন, তার পিছনে শুধু চরমপন্থীরাই ছিল না, ছিলেন রাজনীতিকরা, সেনা-কর্তারা, আমলারাও। আজকের পাকিস্তানে কোনও ক্ষমতাবানই সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষা করতে নারাজ।
সংখ্যালঘুদের প্রশ্নে মিশরও দ্রুত অসহিষ্ণু হয়ে উঠবে। চরমপন্থীরা হঠাত্‌ ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছেন বলে নয় যাঁরা ক্ষমতায় রয়েছেন, তাঁরা অসহিষ্ণু হওয়াকেই সহজতর পথ হিসেবে বিবেচনা করবেন বলে। প্রতিশোধ নেওয়ার, হিসেব মেটানোর, জয় করার রাজনৈতিক পথ হল এই অসহিষ্ণুতা। এর সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। ইসলাম যে শিক্ষা দেয়, এই অসহিষ্ণুতার রাজনীতি তার একেবারে উলটো পথে হাঁটছে।
যদি কখনও দুনিয়ার সব মুসলমানকে একটিমাত্র গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে সেই গোষ্ঠী-শাসিত রাষ্ট্রে থাকতে বাধ্য করা হয়, তা হলে সাচ্চা মুসলমান বলে আর কিছু এই দুনিয়ায় থাকবে না। কারণ, ইসলাম এক গোষ্ঠীর এই জবরদস্তি শাসনের অনুমতি দেয় না। কিন্তু চরমপন্থীরা যখন একের পর এক গোষ্ঠীকে শেষ করে দিচ্ছে, তখন ধর্মের প্রকৃত বাণী আর কে মনে রাখে?

‘তালিবান’ ও অন্যান্য গ্রন্থের লেখক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.