সদ্যনির্বাচিত পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির খুনের ঘটনাকে ঘিরে রাজ্য সরকার তথা শাসক দলকে এ বার কড়া হুঁশিয়ারি দিল প্রধান বিরোধী দল সিপিএম। শাসক দল খুনখারাবির রাজনীতি চালিয়ে গেলে পুজোর পরেই তাদের জন্য ‘নতুন দাওয়াই’ নিয়ে রাস্তায় নামা হবে বলে ঘোষণা করে দিলেন সিপিএম নেতা গৌতম দেব। প্রয়োজনে মহাকরণ, লালবাজার, ভবানী ভবন বা জেলাশাসকদের দফতর ঘেরাওয়ের কর্মসূচি নেওয়া হবে। সিপিএমের অভিযোগ, সন্ত্রাস চালিয়ে পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূল বাজিমাত করেছে। কিন্তু লোকসভা ভোটে তাদের কড়া প্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে বলে আগাম হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখল তারা। এবং এই কাজে আগেই ময়দানে নামল গৌতমবাবুদের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সিপিএম।
পঞ্চায়েত ভোট-উত্তর রাজ্য রাজনীতিতে নতুন উত্তাপ নিয়ে এসেছে সোমবার রাতে উত্তর ২৪ পরগনার হাসনাবাদ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির খুনের ঘটনা। সিপিএমের অভিযোগ, তৃণমূল-আশ্রিত দুষ্কৃতীরা পরিকল্পনামাফিক ওই সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গির আলমকে খুন করেছে। ওই পঞ্চায়েত সমিতিতে ১৩টি আসন পেয়েছিল বামফ্রন্ট। তৃণমূলের ছিল ১২টি। এক জন নির্দলের সমর্থন নিয়ে তাদের ভোটও বামেদের সমান হয়ে গিয়েছিল। তখন টসে জিতে সভাপতি হন সিপিএমের জাহাঙ্গির। সহ-সভাপতি তৃণমূলের। এখন সভাপতি খুন হয়ে যাওয়ায় রীতি মেনে সহ-সভাপতিই সমিতি চালাবেন, যত দিন না উপনির্বাচন হয়ে সমীকরণের কোনও হেরফের হচ্ছে। ভোটের সময় বা বোর্ড গড়া নিয়ে বহু লড়াই হামেশাই দেখেছে এ রাজ্য। কিন্তু বোর্ডের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে যাওয়ার পরে খুনের ঘটনা বিরল।
রাজ্য সরকার তথা শাসক দল অবশ্য হাসনাবাদের ঘটনাকে সিপিএমের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফল বলেই পাল্টা দাবি করেছে। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সফরে গিয়ে মঙ্গলবারই বারাসতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাসনাবাদের নাম না-করে বলেছেন, “অভ্যন্তরীণ গণ্ডগোলে খুন হল। অথচ অন্য রকম দোষ চাপানো হচ্ছে! এ সব নিয়ে রাজনীতি করবেন না। মনে রাখবেন, শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না!” মুখ্যমন্ত্রীর আরও মন্তব্য, “যারা খারাপ লোক, খুনি-ডাকাত তারা রাজ্যের সম্পদ হতে পারে না! যদি সিপিএম অপরাধ করে, ধরবেন। যদি তৃণমূল অপরাধ করে, ধরবেন। এ সব নিয়ে রাজনীতির রং চাপাবেন না।”
সদ্যই কলকাতায় সিপিএমের রাজ্য কমিটি ও বর্ধিত রাজ্য কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়েছে, সরকারের বিরুদ্ধে বিষয়ভিত্তিক জঙ্গি আন্দোলনের পথেই এগোতে হবে। সেইমতোই জাহাঙ্গিরের হত্যার খবর পেয়ে দ্রুত আসরে নেমে পড়েন উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সিপিএম নেতৃত্ব। তাঁদের পরিকল্পনা ছিল, জাহাঙ্গিরের দেহ এ দিন কলকাতায় এনে আলিমুদ্দিন ঘুরে ধর্মতলায় বিক্ষোভ সমাবেশ করা হবে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর জেলা সফরের দিনে পুলিশ কোনও ঝুঁকি নিতে চায়নি। বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আনার কারণ দেখিয়ে ময়না তদন্তই হয়েছে এত দেরিতে যে, তার পরে আর কলকাতায় দেহ আনা সম্ভব ছিল না।
তবে দেহ না এলেও বসে থাকেনি সিপিএম। ধর্মতলার কাছে বি সি রায় মার্কেটের ধারে ম্যাটাডোর মঞ্চ করে বিক্ষোভ সমাবেশ করে তারা। যেখানে দাঁড়িয়ে উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সম্পাদক গৌতমবাবু বলেন, “ধর্মতলায় বহু বার মৃতদেহ নিয়ে এসেছিল তৃণমূল। আমরা এটা চাই না। সব দেহ আনবও না। কিন্তু জাহাঙ্গির লোকসভা ভোটের প্রথম শহিদ। লোকসভা ভোটে মমতার পরিকল্পনা রুখতে আরও যত রক্ত লাগে, আমরা দেব!” বনগাঁ এবং বসিরহাট লোকসভা এলাকায় পঞ্চায়েতের ফলের নিরিখে এ বার তৃণমূলের চেয়ে এগিয়ে বামেরা। সেই জন্যই জাহাঙ্গিরকে পরিকল্পনামাফিক খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ সিপিএমের। সেই সূত্রেই এ দিন গৌতমবাবুর হুঁশিয়ারি, “সাধারণ ওষুধে এদের কাজ হবে না! পুজোর পরে আলাদা ওষুধের ব্যবস্থা করা হবে!” ম্যাটাডোর-বিক্ষোভে হাজির ছিলেন দলের দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তী, রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেবও। সেখান থেকেই জেলা বামফ্রন্টের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণের সঙ্গে দেখা করতে যান প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত। পরে তিনি বলেন, “দুষ্কৃতীদের চিহ্নিত করে দেওয়ার পরেও কেউ গ্রেফতার হয়নি। সব শুনে রাজ্যপাল উদ্বিগ্ন।”
দলনেত্রীর সুরেই খাদ্যমন্ত্রী তথা জেলা তৃণমূলের পর্যবেক্ষক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকও দাবি করেছেন, “এটা সিপিএমের নিজেদের মধ্যে খুনোখুনির ঘটনা। গৌতম দেব, অমিতাভ নন্দীরা বুল্টন, মজিদ মাস্টারের মতো অপরাধীদের তৈরি করেছে। নিজেদের মধ্যে অতীতে খুনোখুনি করেছে। এখনও করছে!” যার জবাবে জেলার সিপিএম নেতা নেপালদেব ভট্টাচার্য বলেছেন, “বারাসত থেকে গন্ধ শুঁকে ওঁরা বলে দিলেন, গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বে খুন! অর্থাৎ খুনও করব, মিথ্যাও বলব!”
|