|
পুজোর গন্ধ এসেছে |
সেই গন্ধ মানে তো পুজোর গানও। ডাউনলোডের যুগেও স্মৃতিমেদুর গায়ক-গায়িকরা। শুনলেন সংযুক্তা বসু |
পঞ্চমীর বিকেল। আলো জ্বলে উঠছে প্রতিটা পুজোমণ্ডপে। ভেসে আসছে ঢাকের তাল।
আর তারই ফাঁকে শোনা যাচ্ছে গান...‘সন্ধ্যাবেলায় তুমি আমি বসে আছি দু’জনায়।’ একটু এগোতেই কানে এল আরেকটা গান ‘মহুয়ায় জমেছে আজ মউ গো’। পুজোর মৌতাত মানে তো তখন এই সব গানই।
তখন থিম পুজো ছিল না, পুজো নিয়ে থিম গানও ছিল না। আলোকসজ্জা বা মণ্ডপসজ্জায় সিনেমার শিল্পনির্দেশক বা সিনেমাটোগ্রাফারদের নাম থাকত না। পুরস্কারের টক্করবাজি ছিল না।
ছিল সাবেক কায়দায় বারোয়ারি পুজো। আর ছিল দারুণ সব মন ভরিয়ে দেওয়া গান। পুজোর অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন রেকর্ডের দোকানে বিক্রি হত মায়াবী গোলাকৃতি ছোট বড় রেকর্ড। ভিড় উপচে পড়ত মেলোডি থেকে সিম্ফনিতে। বড় বড় শিল্পীদের ছবির পাশে তাঁদের গান সংবলিত ছাপা বই বেরোত সেই সময়কার এইচ এম ভি থেকে। পুজোর গানের আমেজে সে সময় না জানি কত প্রেমিক খুঁজে পেত নিজেদের মন দেওয়ানেওয়ার অপার্থিব ভাষা। কিশোরকুমারের ‘নয়ন সরসী কেন ভরেছ জলে’ কিংবা তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কাজল নদীর জলে ভরা ঢেউ ছলছলে’, মান্না দে-র ‘সুন্দরী গো দোহাই তোমার’ তখন মুখে মুখে ফিরছে। এ সব আজ শুধুই নস্টালজিয়া। আজকের সঙ্গীতশিল্পীরা ফিরে গেলেন পুজোর গানের কথা ভাবতে ভাবতে তাঁদের প্রিয় গানের কথায়। স্মৃতির মূর্ছনায় মন গ্রামাফোনে বেজে উঠল ফেলা আসা গান... |
|
ইন্দ্রাণী সেন |
পুজোর সেরা গান: মান্না দের গাওয়া ‘রঙ্গিনী কত মন, মন দিতে চায়.কী করে বোঝাই কিছু চাই না, চাই না, চাই না’।
স্মৃতি: তখন আমি ক্লাস সেভেন কি এইটে পড়ি। গানটার মানে যে পুরোপুরি বুঝেছিলাম তা নয়। কিন্তু আধা বোঝার আনন্দটাই ছিল আসল। মান্না দে যে -আবেগ নিয়ে গানটা গেয়েছিলেন সেটা খানিকটা বুঝেছিলাম বোধ হয়। বাবা প্রত্যেকবার তখন পুজোয় ওঁর রেকর্ড কিনে আনতেন আর আমায় বলতেন, “গানগুলো তুলে নে তো।” আমি তুলে নিয়েছিলাম। পাড়ার পুজো মণ্ডপে অষ্টমীর দিন অঞ্জলির আগে মন্ত্র পড়ার জন্য মাইক টেস্টিং হচ্ছিল। আমাকে একজন উদ্যোক্তা বললেন, “এই মেয়ে, একটা গান গেয়ে দে তো। তোর গান দিয়েই মাইক টেস্টিং হবে।”আমি কিছুটা থতমত খেয়ে গেয়েছিলাম ‘রঙ্গিনী কত মন।’ সবাই বাঃ বাঃ করে উঠলেন। আর বাবাও দারুণ খুশি হয়েছিলেন। আমি তাঁর আদেশ মেনে গান তুলে ফেলেছি বলে। সেই দিনটার কথা অষ্টমীর সকাল এলে আজও মনে পড়ে।
কোনও কোনও গান একেবারে নিজের গান হয়ে যায়। এই গানটাও তেমনই। এখনও রসিক শ্রোতা পেলে ‘রঙ্গিনী’ শোনাই। ক্ল্যাসিকাল বেসে এমনিতেই মান্নাদার গান দুর্দান্ত হয়। এ গানটাও সেই জাতের। দরদ দিয়ে গেয়ে আজও বাহবা পাই। তার ওপর ইদানীং গানের কথা গুলোর মর্ম উপলব্ধি করে বেশ লাগে। গীতিকার বলছেন রঙ্গিনী মনের অসাধারণ নারীকে তিনি চান না। তিন চান এক সাধারণ মেয়ের দেখা।
রিমেক করতে হলে: পুজোর গানের রিমেক করেছি বেশ কয়েক বার। খান ছয়েক অ্যালবামও আছে। কিন্তু রাহুল দেব বর্মনের সুরে আশা ভোঁশলের গাওয়া ‘এলোমেলো কথা’ গানটা রিমেক করার ইচ্ছে হয়। রাহুল-আশাজির জুটিতে এটাই প্রথম রেকর্ড যেখানে ওয়েস্টার্ন সুরের ব্যবহার হয়েছিল। সেটা ইতিহাসের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। সেই জন্যই রিমেক করতে ইচ্ছে করে। |
|
শ্রীকান্ত আচার্য |
পুজোর সেরা গান: কিশোরকুমারের গাওয়া ‘নয়নসরসী কেন ভরেছো জলে।’
স্মৃতি: আমাদের বাড়িতে তখন পুজোয় গানের সব রেকর্ডই প্রায় কেনা হত। ‘নয়নসরসী কেন’ কেনা হয়েছিল। সেই সময় রেকর্ডের ধুন্ধুমার যুগ। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন এলে রেকর্ড প্লেয়ারে ওই গান চালানো হচ্ছিল। শুনতে শুনতে গানটা আমার গলায় বসে গেল। আত্মীয়দের খালি গলায় কখনও কখনও বা হারমোনিয়াম বাজিয়ে ‘নয়নসরসী কেন’ শোনাতাম। তার পর একটা সময় ক্যাসেটের যুগ এল। আমার মামা ইউরোপ থেকে নিয়ে এলেন সোনির একটা ক্যাসেট রেকর্ডার। তাতে আমরা ভাইবোনেরা যে যা করছি রেকর্ড হচ্ছে। কেউ আবৃত্তি করছে ‘হাম্পটি ডামটি’, কেউ বা ‘বীরপুরুষ’।
আমার গলায় মামা ‘নয়নসরসী কেন’ রেকর্ড করে রেখেছিলেন। এখনও মামার কাছে সেই ক্যাসেটটা আছে। দু’বার মোট ‘নয়নসরসী কেন’ রেকর্ড করেছিলেন। এক বার একেবারে কচিগলায়। মানে বাল্যে। আর এক বার যখন আমি যৌবনমুখো কৈশোরে। একটু ভারি গলা। তখনকার গলা কেমন ছিল শুনতে হলে এখনও ‘নয়নসরসী কেন’ই আমার ভরসা।
রিমেক করতে হলে: বহু পুজোর গানই রিমেক করেছি। কিন্তু এখন পুজোর গান বা পুরনো গান রিমেক করতে ইচ্ছে করে না। আগে যে সব রিমেক গেয়েছি সেগুলো নিয়ে পরে অনেক সময় মনে হয়েছে না করলেই ভাল হত। এই সব সোনাঝরা গান আসলে স্পর্শাতীত। আমার গাওয়া উচিত হয়নি। এখন আরও বেশি করে সেটা মনে হয়। |
|
রাঘব চট্টোপাধ্যায় |
পুজোর সেরা গান: রাহুল দেব বর্মনের গাওয়া ‘শোনো এই তো সময়।’
স্মৃতি: তখন আমি কলেজে পড়ি। এবং গিটার বাজাতেও পারতাম। যে কোনও জমাটি আড্ডায় আমার ডাক পড়তই পড়ত। আর গানই ছিল তার মূল কারণ। বহু ঘরোয়া আসরে, কলেজের স্টেজে এই গানটা আমি গেয়েছি। শুধু কি তাই? তখন ভরপুর যৌবন। মেয়েদের মন টানার একটা ঝোঁক তো ছিলই। কোনও সুন্দরী বান্ধবীকে দেখলে গেয়ে দিতাম ‘শোনো এই তো সময়’ ভাবতাম শুধু মুখে তো বলতে পারব না। সুর দিয়ে বললে যদি কেউ সময়টাকে সত্যি বুঝতে পারে।
স্বপন চক্রবর্তীর লেখা এই গানের কথাগুলো খুব সহজ সরল। সাধারণ শ্রোতার জন্য খুব সহজ ভাষায় লেখা। কঠিন কিছু বলা নেই। কোনও দুরূহ অলঙ্কার, রূপক, উপমার ব্যবহার নেই। রাহুল দেব বর্মণের গাওয়া প্রত্যেকটা গানেই এই স্বাভাবিক সাবলীলতা আছে যেটা আমাকে টানে। আশ্চর্য একটা নিজস্বতা ছিল ওঁর পেশকারিতে। যেটা এই গানটাতেও আছে। পুজোর গান বললে অনেকেই অনেক গানের কথা বলেন কিন্তু ‘শোনো এই তো সময়’ আজও নতুন মনে হয়। কলেজ সোশ্যালে, ফেস্টে এ গান বহু বার গেয়েছি। ‘তোমার দু চোখে মেঘ করে আসে’ বলে আমার নিজের একটা গান আছে। সেই গানখানায় ‘শোনো এই তো সময়’য়ের অনুপ্রেরণা আছে।
রিমেক করতে হলে: কিশোরকুমারের গাওয়া ‘তারে আমি চোখে দেখিনি, তার অনেক গল্প শুনেছি’ এই গানটা দারুণ সুন্দর একটা প্রেমের গান। সুরও খুব ভাল। রিমেকের ইচ্ছে হয়। যদি করি মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট আধুনিক করব। যেমন মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট হবে সেই অনুসারে আমার গায়কী হবে। সুর কোথাও পাল্টাব না। কিন্তু একটা নিজস্বতার ছাপ রাখার চেষ্টা করব। |
|
রূপঙ্কর |
পুজোর সেরা গান: আশা ভোঁশলের গাওয়া ‘যেতে দাও আমায় ডেকো না।’
স্মৃতি: আমি বোধ হয় জন্ম থেকে আশাজির গানের ফ্যান। বছর দেড়েক বয়সে নাকি ‘চোখে চোখে কথা বলো’ গানটা শুনে বিভোর হয়ে যেতাম। ‘যেতে দাও আমায় ডেকো না’ যে পুজোয় প্রথম শুনলাম তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। গানটা অসম্ভব রোমান্টিক। সেটা অবশ্য পরে বুঝেছি। মজা হল এই যে এ গানে একই সঙ্গে ভারতীয়ত্বের সঙ্গে পশ্চিমি সুরের মিশেল রয়েছে। যেটা খুব অভিনব মনে হয় আমার। আমরা আজকাল ফিউশন মিউজিক নিয়ে তো খুব চর্চা করি। ‘যেতে দাও আমায় ডেকো’ না ছিল সে যুগের খুব গুরুত্বপূণর্র্ ফিউশন মিউজিক।
বিয়ের আগে যখন প্রেম করতাম আমার প্রেমিকা (এখন স্ত্রী) এক বার ভোপাল গিয়েছিল চাকরির কাজে। দু’ আড়াই দিনের জার্নিতে পৌঁছতে হত সেখানে। ওর যাওয়ার আগে খালি গলায় বেশ কিছু গান নিজে গেয়ে টেপ করে দিয়েছিলাম। তার মধ্যে এই গানটাও ছিল। আমাদের দু’জনের প্রিয় গানের লিস্টে এটা কমন গান।
রিমেক করতে হলে: আমি কখনও রিমেক গাইনি। গাইবার তেমন ইচ্ছেও নেই। যদি রিমেক করতেই হয় সলিল চৌধুরীর সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া পুজোর গান ‘শোনো কোনও এক দিন’ রিমেক করতে পারি। এই গানটা স্থায়ী শুরু হয় এক স্কেলে আর অন্তরায় গিয়ে গান শেষ হয় আর এক স্কেলে। তাতে গানটা বেশ সুখশ্রাব্য মনে হয়। তা ছাড়া গানের সুরের চলনও খুব সুন্দর। |
|
লোপামুদ্রা মিত্র |
পুজোর সেরা গান: ‘দুষ্টুমি আর কোরো না/ লক্ষ্মীটি দোহাই তোমার আঁচল টেনে ধরো না’
স্মৃতি: অসাধারণ স্মৃতি। তখন ফাইভটাইভে পড়ি। ওই কচি বয়সেই দারুণ লেগেছিল এই ন্যাকা গানটা। ন্যাকান্যাকা করেই গাইতাম। আর আমার দিদিরা হেসে কুটোপাটি হত। কারণ ওরা তো প্রেমট্রেম করত। সেই জন্যই ওদের উদ্দেশ্য করেই গানটা গাইতাম। দিদিরা হাসলেও বাড়ির অন্য বয়োজেষ্ঠদের মুখ গম্ভীর হত। কারণ ওইটুকু বয়সে অমন এঁচোড়ে পাকা গান গাইছি।
আমাদের বাড়ি ছিল রাবীন্দ্রিক ঘরানার। সেখানে একটা বছর দশেকের মেয়ে এমন পাকা-পাকা গান গেয়ে ন্যাকা হাবভাব করবে এটা কেউ ভাবতেই পারত না।
বিয়ের পর এখনও আমার বর জয়ের পেছনে লাগার ইচ্ছে হলে মাঝে মাঝে ক্যারিকেচার করে এই গানটা শোনাই। ও এই সব খুনসুটি দেখে ভীষণ এমব্যারাসড হয়ে যায়। আসলে ও তো আঁচল টেনে ধরার ছেলেই নয়। গান শুনে খুব লজ্জা লজ্জা পায়। খালি বলে, ‘কী হয়েছে? কেন গাইছ বলো তো গানটা?’ আমি কিন্তু চটুল গান শুনতেও পছন্দ করি। সব সময় যে ভারিক্কি গান শুনতে হবে তার কোনও মানে নেই।
রিমেক করলে: ‘আকাশ কেন ডাকে/ মন ছুটি চায়/ ময়ূর কণ্ঠী মেঘ/ যায় ভেসে যায়’ কিশোরকুমারের এই গানটা রিমেক করতে পারলে খুশি হব। পুজোর মেজাজ আছে গানটায়। মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টে ড্রামস আর গিটার থাকবে অবশ্যই। |
|