স্তন্যদায়িনী
বিজ্ঞাপন জগতের ঝাঁ-চকচক দুনিয়ায় তাঁর চলাফেরা। হরেক রকম পণ্যের বিজ্ঞাপন করে চলেছেন বহু বছর ধরে। কিন্তু জানতেন না বিকিকিনির হাটে মায়ের দুধও বিক্রি হয়। এই রকম একটি বিষয় নিয়ে দেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল কানাই কুণ্ডুর লেখা গল্প ‘অমৃতমন্থন’। পড়ে চমকে উঠেছিলেন বিজ্ঞাপনের অনুমিতা দাশগুপ্ত। সত্যি ঘটনা অবলম্বনে লেখা সেই দেড় পাতার গল্প এমনই নাড়া দিয়ে গেল অনুমিতাকে যে বানিয়ে ফেললেন একটা আস্ত ছবি। নাম ‘জুমেলি’।
প্রায় পঁচিশ বছর আগের বস্তার। সেখানেই থাকত জুমেলি। গাঁ-গঞ্জের হাটে টাকা নিয়ে অন্যের বাচ্চাকে নিজের বুকের দুধ খাওয়াত জুমেলি। তার মরদ হাঁক দিয়ে খদ্দের জড়ো করত। কোলের বাচ্চাটাকে আরও হাট্টাকাট্টা করার বাসনায় দুধ খাওয়ানোর জন্য লাইন দিতেন আদিবাসী মা-বাবারা। একবার দুধ খাওয়াতে চার টাকা। জুমেলির মন এতে সায় দিত না। বুকের দুধ নিয়ে ব্যবসা! মনে হত, বড় পাপ করছে। কিন্তু না-করেও উপায় কী? পাঁচ বার মরা বাচ্চা হয়েছে। শরীর ঠিক রাখার জন্য তার মরদ গ্রামের বৈদ্যের কাছ থেকে পুরিয়া এনে দিত। তা-ও বাচ্চারা বাঁচত না। প্রত্যেক বারই জুমেলির বুকে মাত্রাতিরিক্ত দুধ জমত। কাউকে খাওয়াতে না-পারলে প্রচণ্ড যন্ত্রণা শুরু হত।
প্রথম-প্রথম যন্ত্রণা কমাতে গ্রামের দাইয়ের পরামর্শে পাড়া-পড়শির বাচ্চাদের এমনিই দুধ খাইয়ে দিত। তার পর একদিন মরদ বোঝালো, মাগ্গিগণ্ডার বাজারে বিনে পয়সায় কেউ কিচ্ছু করে না। প্রথমটায় রাজি হয়নি জুমেলি। কিন্তু অভাব মানুষকে অনেক কিছু করতে বাধ্য করে। জুমেলিরও দুধ বেচা শুরু হয়। কেতকালের হাটেও সেই জন্য আসা। হঠাৎ দেখা গ্রামের বৈদ্যজির সঙ্গে। দেখেই রাগে ফেটে পড়ে ছ’বারের গর্ভবতী জুমেলি। “কী ছাইয়ের ওষুধ
দাও তুমি? বাচ্চা বাঁচাতে পারো না! ভণ্ড, ধাপ্পাবাজ!” গালি শুনে পাল্টা খেপে ওঠেন বৈদ্য। বলেন, “নিজের মরদকে জিজ্ঞাসা কর। প্রত্যেক বার সে বাচ্চা নষ্ট করার পুরিয়া নিয়ে গিয়েছে আমার থেকে। যাতে তোর দুধ নিয়ে ব্যবসা করে টাকা ঘরে আনতে পারে!” পায়ের তলার মাটি সরে গেল জুমেলির। স্বামীর প্রতি ঘৃণায় আচ্ছন্ন হল তার মন।
জুমলি: করুণ বাস্তব এ বার সিনেমার পরদায়
এই বিষয় নিয়ে অল্প বাজেটের দেড়ঘণ্টার বাংলা ছবি ‘জুমেলি’তে নামী অভিনেতা-অভিনেত্রী বলতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর সোহাগ সেন। নায়ক-নায়িকাও প্রায় অপরিচিত। তবে ছবির টেকনিক্যাল দিক সামলেছেন তাবড় সব ব্যক্তিত্ব। এডিটিং-এ অর্ঘ্যকমল মিত্র, সিনেমাটোগ্রাফিতে আদিনাথ দাস, সঙ্গীতে তন্ময় বসু। মুম্বই, নাগপুর, পুণে, কলকাতা ফিল্মোৎসবে প্রশংসিত সেই ছবি এ বার কলকাতার একাধিক প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেতে চলেছে আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর। অনুমিতা আর কানাইবাবু দু’জনেরই আফশোস, “ইস! জুমলিকে যদি এক বার কলকাতায় আনা যেত।” বস্তারের এলাকায় পরে গিয়ে অনেক খোঁজার পরেও বাস্তবের জুমেলিকে আর পাওয়া যায়নি।
যে মাসে জুমেলিকে নিয়ে তৈরি ছবি মুক্তি পাচ্ছে ঠিক তার আগের মাসেই এই কলকাতায় এসএসকেএম হাসপাতালে পূর্বভারতের প্রথম মাতৃদুগ্ধের ব্যাঙ্ক চালু হল। শুরুর সময়েই ১৮৫ জন মায়ের থেকে প্রায় ৪০ লিটার দুধ ব্যাঙ্কে পাস্তুরাইজড করে রাখা হয়েছিল।
এসএসকেএমে শিশুর জন্ম দেওয়া মায়েরাই নিজেদের অতিরিক্ত দুধ দান করছেন মানবিকতার খাতিরে। উদ্যোগ নিয়ে প্রশংসা উপচে পড়ছে। অথচ, জুমেলির মতো কেউ যদি তাঁর অতিরিক্ত দুধ টাকার বিনিময়ে অন্যের সন্তানকে দেন তা হলে সমাজ চমকে ওঠে। সেখানে ঔচিত্যের, নীতির প্রশ্ন আসে। অপরাধবোধে নিয়ত জর্জরিত হতে থাকে সেই মেয়ের আত্মা। কারণ, দান করা দুধের সঙ্গে তাঁর দুধের মধ্যে গাঢ় বিভাজিকা টেনে দিয়েছে ‘টাকা’।
নারীআন্দোলন কর্মী শাশ্বতী ঘোষের কথায়, “একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে কীসের এত ছুঁৎমার্গ? টাকা নিয়ে সারোগেসি, স্পার্ম বিক্রি, ডিম্বাণু বিক্রি যদি এ সমাজে গ্রহণোগ্যতার সার্টিফিকেট পায়, তা হলে টাকা নিয়ে মায়ের দুধ খাওয়াতে নৈতিক বাধা কেন?”
আমেরিকা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে দেখুন। মায়েদের বুকের দুধ বিক্রি রীতিমতো জনপ্রিয় পেশায় পরিণত হয়েছে। এ ব্যাপারে সম্প্রতি ইন্টারনেটে প্রকাশিত অসংখ্য বিজ্ঞাপনের কয়েকটার কথা উল্লেখ করা যাতে পারে। যেমন, আমেরিকার মেরিল্যান্ডের এক এরোবিক্স শিক্ষিকা ৩৪ বছরের ডেনিস ইয়ারবোস্মিথ লিখেছেন, গত ১৩ অগস্ট সারোগেট মা হিসাবে তিনি এক স্বাস্থ্যবান সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। সন্তানকে দিয়েও দুধ বেশি হচ্ছে, যা তিনি প্রতি আউন্স এক ডলারে বিক্রি করতে চান। ক্রেতাদের দুধদায়িণীর শারীরিক পরীক্ষার রিপোর্টও হাতেহাতে দেখানো হবে।
আবার ক্যালিফোর্নিয়ার হোলি বার্ক তাঁর বিজ্ঞাপনে লিখেছেন “অ্যামেজিং মিল্ক ফ্রম অ্যামেজিং হেলদি মামা অফ টু!” ১৯ মাস ও ২ মাসের দুই সন্তানের মা হোলি। তিনি ফ্রিজারে অতিরিক্ত ১ হাজার আউন্স বুকের দুধ সংরক্ষণ করেছেন যা প্রতি আউন্স ২ ডলারে বিক্রি করতে চান। পেনসিলভেনিয়ার অ্যাসলে রডিচক গত ২২ জুন মা হয়েছেন। তিনি তাঁর অতিরিক্ত দুধ প্রতি আউন্স আড়াই ডলারে বিক্রি করছেন। শিপিং চার্জ আলাদা। ইন্ডিয়ানার বাসিন্দা ২৬ বছরের শেবি ফর্টওয়াইন মা হয়েছেন ২ অগস্ট। তিনি অতিরিক্ত প্রায় ৩ হাজার আউন্স দুধ ফ্রিজারে সংরক্ষণ করেছেন। যাঁরা এই ফ্রজেন দুধ কিনতে চান তাঁদের দিতে হবে ১ ডলার, আর যদি টাটকা দুধ পেতে হয় তা হলে তার এক আউন্সের দাম সাড়ে তিন ডলার। তবে সবাইকে পিছনে ফেলে দিয়েছে চিন। সেখানে বুকের দুধ বিক্রি করতে আগ্রহী মহিলা জোগান দেওয়ার অজস্র এজেন্সি তৈরি হয়ে গিয়েছে। চিনের বহু ধনীর কাছে আকর্ষণীয়া দুগ্ধদাত্রী রাখাটা এখন স্টেটাস সিম্বল। মাসে কমবেশি ২৬০০ মার্কিন ডলার দিয়ে এঁদের ভাড়া করা হয়। শুনে ধাক্কা খাবেন হয়তো যে, শুধু শিশুরা নয়, সেখানে প্রাপ্তবয়স্ক ধনীরা নিয়মিত সেই ‘ওয়েট নার্স’-এর দুধ খান! যদি সেই মহিলা কোনও প্রাপ্তবয়স্ককে সরাসরি তাঁর স্তন থেকে দুধ পানের অনুমতি দেন তা হলে টাকার অঙ্কটা দ্বিগুণ হবে!
জুমেলিদের মানসিক টানাপোড়েন এখন ইতিহাস। বর্তমান বিশ্বে নতুন অবতারে উত্তীর্ণা এ যুগের পয়োস্বিনী।
আত্মধিক্কারে দগ্ধ হওয়া জুমেলি যদি জানতে পারত সে কথা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.