এ-ও এক পরিবর্তন, সিদ্ধিদাতায় মজল বঙ্গ
বাম জমানায় তিনি এক বার মহা শোরগোলে দুধ খেয়েছিলেন! পরিবর্তনের জমানায় তিনি পরম মমতায় পূজিত হচ্ছেন! উত্তরের বাগবাজার, পূর্বের বেলেঘাটা বা সল্টলেক, মধ্য কলকাতার মৌলালি-শিয়ালদহ বা দক্ষিণের সন্তোষপুর। সর্বত্র তাঁর নাদুসনুদুস মূর্তি ঘিরে মহা ধুমধাম! এমনকী সাহেবি গন্ধ লাগা পার্ক স্ট্রিটের অ্যালেন পার্কে পর্যন্ত মূষিক বাহন নিয়ে তাঁর অধিষ্ঠান! বিশ্বকর্মা পুজো থেকে উৎসবের ঢাকে কাঠি দিতে অভ্যস্ত বাঙালি হঠাৎই যেন আবিষ্কার করেছে, মহারাষ্ট্রের কায়দায় গণেশ উৎসব এ বার তাদেরও ভাসিয়ে নিল! স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেই দিয়েছেন, “আজ (সোমবার) গণেশ চতুর্দশী। পুজোর বাদ্য বাজছে। কিন্তু আকাশের মুখ ভারী! সবাই ভাল থাকুন!”
কুমোরটুলির এক সূত্রের হিসেব, অন্য বার যেখানে মেরেকেটে খান পঞ্চাশেক প্রতিমার বায়না আসত, এ বার সেখানে সংখ্যাটা কয়েক হাজার ছাড়িয়েছে! শহরে ঠিক কত গণেশ পুজো হচ্ছে, তার কোনও হিসেব অবশ্য কলকাতা পুলিশের কাছে নেই। গণেশ পুজোর জন্য লালবাজার থেকে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আনুষ্ঠানিক ভাবে স্থানীয় থানাকে জানিয়ে রাখতে হয় শুধু। তবে লালবাজারের এক কর্তা মানছেন, যে ভাবে শহরে গণেশ পুজোর সংখ্যা বাড়ছে, তাতে আগামী দিনে হয়তো লালবাজার থেকে অনুমতি দেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়বে।
শহরে মহারাষ্ট্র নিবাসের গণেশ পুজোয় মুখ্যমন্ত্রী। —নিজস্ব চিত্র।
অনুমতি যে-ই দিক, গণেশ পুজোর রমরমা এ বার শহরবাসীর নজর এড়ায়নি। এবং অনেকেরই মোক্ষম প্রশ্ন শিল্প-বাণিজ্য-কর্মসংস্থানে তেমন সিদ্ধিলাভে বঞ্চিত বাংলা সিদ্ধিদাতার আরাধনায় এত আলোড়িত হয় কী করে? সারদা-কেলেঙ্কারির পরে বেআইনি লগ্নি সংস্থাগুলি (চলতি কথায় চিটফান্ড) ঝাঁপ গুটিয়েছে। যার জেরে ভাঁড়ে বেশ টান পড়ছে বারোয়ারি সব পুজোর উদ্যোক্তাদেরই। অথচ গণেশ ফুলেফেঁপে উঠছেন! এর রহস্যই বা কী?
প্রবীণ মন্ত্রী এবং দুর্গা পুজোর উদ্যোক্তা সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মত, “কলকাতার বাঙালিদের অনেকেরই এখন পড়াশোনা বা চাকরিবাকরি, ব্যবসার কারণে মুম্বইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। মুম্বইয়ের গণেশ পুজোর প্রভাব তাই কলকাতায় এসে পড়ছে।” শাসক দলের ছত্রছায়াতেই গণেশ পুজোর এই প্রসার, বলছেন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত অনেকেই। বস্তুত, খাস তৃণমূল ভবনেই এ দিন গণেশ পুজোর আয়োজন করা হয়েছিল। নারায়ণ শিলা হাতে পুরোহিতের ভূমিকায় হাজির ছিলেন সরকারি মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়! তৃণমূল ভবনের তিন তলার ঘরে সরস্বতী আরাধনায় অভ্যস্ত শোভনদেব এ বারই প্রথম সিদ্ধিদাতার সাধনা করলেন। তাঁর কথায়, “দলের কল্যাণ ও রাজ্যের সমৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করেছি।”
বাম জমানায় কমিউনিস্ট দর্শন মেনে শাসক দলের নেতা-নেত্রীরা পুজো-আচ্চায় সচরাচর সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন না। সুভাষ চক্রবর্তী তারাপীঠে পুজো দিয়ে ভর্ৎসিতও হয়েছিলেন। কিন্তু তা বলে পুজোর মতো উৎসব এবং জনসংযোগের ক্ষেত্রকে অবহেলা করা হয়নি। পুজো কমিটির পিছনে থাকতেন বাম নেতৃত্ব আর প্যান্ডেল চত্বরে মার্কসীয় বইপত্রের দোকান দেওয়া হতো।
এখন কাউন্সিলর থেকে মন্ত্রী, ক্ষমতাসীন নানা নেতার বরাভয় প্রত্যক্ষ ভাবেই পুজো উদ্যোক্তাদের মাথার উপরে আছে। শাসক দলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “আমরা বিরোধী থাকাকালীন যেমন আন্দোলন ইত্যাদি করতাম, এখন তা করা যায় না। কিছু তো একটা করতে হবে! লাগাও গণেশ পুজো!” রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের দিকে ইঙ্গিত করে তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী বলছেন, “দীর্ঘ ৩৪ বছর মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ছিল না। এখন মানুষ মুক্ত! পুজো-উৎসবে মাতছে। তাই শুধু বারোয়ারি নয়, বাড়িতে বাড়িতেও গণেশ পুজো বেড়েছে।”
কিন্তু টাকার জোগান? পুজো-উদ্যোক্তা হিসাবে দড়, অধুনা রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের হেঁয়ালি, “মায়ের পুজোর (গণেশ অবশ্য মা নন) খরচ মা-ই জোগান!”
অরূপের দাবি, পশ্চিমবঙ্গে অনেক পুজো-পাগল মানুষ আছেন, যাঁরা তথাকথিত চিট ফান্ডের টাকার উপরে নির্ভর করেন না। দরকারে স্ত্রীর গয়না বন্ধক দিয়ে বা ফ্ল্যাট বিক্রি করে পুজো করেন। নিজেদের প্রভিডেন্ড ফান্ড বা গ্র্যাচুইটির টাকা দিয়ে পুজোর ঠাট বজায় রাখেন।
কিন্তু এমন পুজো-পাগল তো কোটিকে গুটিক! উত্তর শহরতলির ভাটপাড়া, কাঁকিনাড়ায় গণেশ পুজো হচ্ছে ১৩৮টি! প্রধান পৃষ্ঠপোষক, তৃণমূল বিধায়ক অর্জুন সিংহের কথায়, “চিট ফান্ডের টাকা মফস্সলের পুজো কখনওই পায় না। শিল্পাঞ্চলে চাঁদা তুলেই যারা পুজো করার, করে।” তৃণমূলেরই এক নেতা অন্য ভাবে বলছেন, “চিট ফান্ডের টাকা এখন নেই। কিন্তু ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা তো আছেন। লেনদেনের তত্ত্বে তাঁদের কাজে লাগানো হচ্ছে!” শাসক দলের নেতাদের একাংশ ঘরোয়া আলোচনায় এও স্বীকার করছেন, বড় বড় পুজো কমিটিতে (দুর্গা বা কালী) যাঁদের জায়গা হয় না, সেই সমস্ত চুনোপুঁটি নেতারা ইদানীং অনুগামীদের নিয়ে গণেশ পুজোয় মাতছেন! প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যেরও অভিযোগ, কিছু না কিছু পুজো লাগিয়ে দিয়ে কর্মহীন তরুণ প্রজন্মকে মাতিয়ে রাখতে চাইছে বর্তমান শাসক দল।
বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এত সব কূট বিতর্কে নেই। হাজরা মোড় পেরিয়ে একটু হেঁটে গিয়ে তিনি সকালেই মহারাষ্ট্র নিবাসে গিয়ে গণেশ প্রণাম সেরেছেন। হাজির ছিলেন সুব্রত বক্সীও। পরে সন্ধ্যায় টেলি-সিরিয়ালের অভিনেত্রী রণিতা ‘বাহা’ দাসের বাড়িতে গণেশ দর্শনে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। যিনি জানেন, গণতন্ত্রে জনগণেশই সব!
সাধে কি আর ফেসবুকে নিজের আঁকা গণেশ-চিত্র পোস্ট করে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী লেখেন, ‘গণপতি বাপ্পা মোরিয়া, সিদ্ধিদাতা বিনায়ক মোরিয়া’!
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.