লিয়েন্ডার পেজ-কে চল্লিশ বছর পেরিয়েও গ্র্যান্ড স্ল্যাম চ্যাম্পিয়ন হতে দেখে আমি অন্তত তেমন অবাক নই। সেমিফাইনাল আর ফাইনালে পর পর বিশ্বের এক আর দু’নম্বর জুটিকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া সত্ত্বেও নয়।
ও যে টেনিসটা খেলে সেটা ডাবলসের জন্য একেবারে আদর্শ। রবিবার রাতে লিয়েন্ডার আর ওর চেক সঙ্গী রাদেক স্টেপানেকের ফাইনালে অস্ট্রিয়ান-ব্রাজিলীয় জুটি আলেকজান্দার পেয়া-ব্রুনো সুয়ারেজকে ৬-১, ৬-৩ কার্যত উড়িয়ে দেওয়া টিভিতে দেখতে দেখতে একটা কথা বারবার মনে হচ্ছিল। লিয়েন্ডারদের উল্টো দিকে এ দিন আমি আর রমানাথন কৃষ্ণন কোর্টে থাকলে ম্যাচের স্কোর কী হত?
আমরাও হেরে যেতাম। তবে সেখানে আমাদের তিন ভারতীয়ের খেলার স্টাইল একই রকম হত। স্টেপানেককে দেখাত অন্য রকম। যেখানে এ দিন আর্থার অ্যাশ স্টেডিয়ামে লিয়েন্ডারের খেলা এক রকমের। বাকি তিন জনের খেলা আরেক রকমের পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। আমাদের আর লিয়েন্ডারের প্রজন্ম আলাদা। টেনিস র্যাকেট, বল-ও আলাদা। এ ভাবে হয়তো কোনও তুলনাও হয় না। তবু স্বীকার করে নিতে আপত্তি নেই যে, অন্তত ডাবলস প্লেয়ার হিসেবে লিয়েন্ডার আমাদের চেয়ে ভাল। আর ওর বয়সের কথা মাথায় রাখলে তো অবিশ্বাস্য রকমের ভাল ফিটনেস। |
উচ্ছ্বাস
ইউএস ওপেনে পুরুষদের ডাবলসে জয়ের পরে সঙ্গী রাদেক স্টেপানেককে
কোলে তুলে নিলেন লিয়েন্ডার পেজ। রবিবার নিউ ইয়র্কে। ছবি: এএফপি |
পঁয়ত্রিশ বছর পেরনোর পর শেষ ছ’বছরে ডাবলস-মিক্সড ডাবলস মিলিয়ে সাতটা গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতল লিয়েন্ডার। ভাবা যায়! একমাত্র ২০১১ বাদে ২০০৮ সাল থেকে প্রত্যেক মরসুমে কমপক্ষে একটা গ্র্যান্ড স্ল্যাম চ্যাম্পিয়ন হয়ে চলেছে ও। কৃষ্ণন আর আমি মিলে টনি রোচ-জন নিউকোম্বের মতো ভয়ঙ্কর জুড়িকেও হারিয়েছি। কিন্তু লিয়েন্ডারের মতো পেশাদার ট্যুরে আড়াই দশক ধরে বছরের পর বছর ৯৪ জন বিভিন্ন পার্টনারের সঙ্গে এ রকম অসাধারণ বোঝাপড়া তৈরি করা আর সাফল্যের কথা ভাবতেই পারতাম না আমরা। লিয়েন্ডার আটটা ডাবলস গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছে চার জন আলাদা সঙ্গী নিয়ে। ছ’টা মিক্সড ডাবলস জিতেছে তিন জন আলাদা মেয়ের সঙ্গে খেলে। লিয়েন্ডারের চেয়ে বেশি বয়সে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতার কৃতিত্ব আছে শুধু মার্টিনা নাভ্রাতিলোভার। সেখানেও ৪৬ বছর বয়সী মার্টিনার সঙ্গী ছিল লিয়েন্ডার। আরও তাৎপর্যের, সেই ২০০৩ উইম্বলডন মিক্সড ডাবলসের চেয়েও এ দিন যুক্তরাষ্ট্র ওপেন ডাবলস ফাইনাল লিয়েন্ডার জিতল সহজে। ওর চোদ্দোটা গ্র্যান্ড স্ল্য্যাম খেতাবের মধ্যে এ দিনেরটাই সবচেয়ে একপেশে জয়। একপেশে স্কোরলাইন।
ম্যাচ শুরুর আগে লিয়েন্ডার যখন টিভি রিপোর্টারকে মজা করে বলছে, “চেক পার্টনার নিয়ে আমার বারবার যুক্তরাষ্ট্র ওপেন ডাবলসে সাফল্যের রহস্য হল, চেক মানেই চেকমেট!” তখন ওর প্রতিদ্বন্দ্বী জুটি বলছিল, “লিয়েন্ডারদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রধান লক্ষ্য হবে নিজেদের সার্ভিস ধরে রাখা। তার পর ওদের সার্ভিসে পাল্টা আক্রমণ করা।”
আসল সময়ে কিন্তু ঠিক উল্টোটাই ঘটল। মাত্র ৭২ মিনিটের ফাইনালে দুটো সেটেই বিপক্ষদের ‘ডাবল ব্রেক’ করে লিয়েন্ডাররাই। আর নিজেদের গোটা ম্যাচে এক বারও সার্ভিস নষ্ট করেনি। দু’দিন আগে ব্রায়ান ভাইদের বিপক্ষে যেমন, এ দিনও তেমনই নিখুঁত খেলেছে লিয়েন্ডার। পেয়া-দের জুটির এটাই প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনাল ছিল। নার্ভাস থাকবে জানতাম। কিন্তু এতটা বেশি, ভাবিনি। অথচ এই জুটি এ বছর এটিপি সার্কিটে চারটে ট্রফি জিতেছে। এ দিনেরটা ছিল ওদের এ বছরের আট নম্বর ফাইনাল। কিন্তু গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনাল যে কী বস্তু সেটা হয়তো ওরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গেল। অন্য দিকে, লিয়েন্ডার-স্টেপানেক এ বছর একটাও ট্রফি জেতেনি। রবিবারই এ বারের ট্যুরে প্রথম ফাইনাল খেলল। কিন্তু গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনালে খেলা আর জেতা দু’টো ব্যাপারেই অভিজ্ঞতা থাকায় কোর্টে এক বারও চাপে আছে বলে ওদের দেখে মনে হয়নি। |
|
খেতাব ১৪ |
ডাবলস ৮ |
ফরাসি ওপেন: ১৯৯৯ ও ২০০১ (সঙ্গী মহেশ ভূপতি), ২০০৯ (সঙ্গী লুকাস ডুহি)
যুক্তরাষ্ট্র ওপেন: ২০০৬ (সঙ্গী মার্টিন ডাম), ২০০৯ (সঙ্গী লুকাস ডুহি), ২০১৩ (সঙ্গী রাদেক স্টেপানেক) উইম্বলডন: ১৯৯৯ (সঙ্গী মহেশ ভূপতি)
অস্ট্রেলীয় ওপেন: ২০১২ (সঙ্গী রাদেক স্টেপানেক) |
মিক্সড ডাবলস ৬ |
উইম্বলডন: ১৯৯৯ (সঙ্গী লিজা রেমন্ড), ২০০৩ (সঙ্গী মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা), ২০১০ (সঙ্গী কারা ব্ল্যাক)
অস্ট্রেলীয় ওপেন: ২০০৩ (সঙ্গী মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা), ২০১০ (সঙ্গী কারা ব্ল্যাক),যুক্তরাষ্ট্র ওপেন ২০০৮ (সঙ্গী কারা ব্ল্যাক) |
|
লিয়েন্ডার এর পর ২০১৬ রিও অলিম্পিক খেললেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। আধুনিক ডাবলসে ও একটা বিস্ময়। যে যুগে ডাবলস স্পেশ্যালিস্ট মানেই ‘বুম বুম’ সার্ভিস, প্রচণ্ড জোরালো গ্রাউন্ডস্ট্রোক, দ্রুত র্যালি শেষ করে ফেলা। সেই যুগেও লিয়েন্ডার ওর খুব জোরে না হোক কিন্তু নিখুঁত সার্ভিস, ভলির বৈচিত্র (ড্রপ, অ্যাঙ্গেল্ড, এমনকী নিজের টেনিস শু্য-র লেসের ওপর থেকেও একেবারে শেষ মুহূর্তে রিটার্ন মারে), প্লেসিং শটের দাপটে বিপক্ষকে নাজেহাল করে চলেছে। আর সব চেয়ে বড় কথা, নেটের সামনে ওর রিফ্লেক্স দেখলে মনে হয় যেন চল্লিশ নয়, ওর বয়স সবে পঁচিশ। এটা ও বছরের পর বছর ধরে সম্ভব করে চলেছে ওর ঈশ্বরপ্রদত্ত হাত-চোখের কো-অর্ডিনেশনের সুবাদে। আর কোর্টে লিয়েন্ডারের অনুমান ক্ষমতা সম্ভবত টেনিসের ইতিহাসে অন্যতম সেরা। ওকে টেনিসের সর্ব কালের অন্যতম সেরা ‘ইন্টারসেপ্টার’ বললে হয়তো আমার দিকে কেউ আঙুল তুলবে না। এ দিনই প্রথম সেটে সাইডলাইনের বাইরে চলে গিয়ে লিয়েন্ডারের মারা একটা ব্যাকহ্যান্ড ভলি আর পরের সেটে নেটের সামনে থেকে ওর নেওয়া একটা ওভারহেড ফোরহ্যান্ড শট যেগুলো একমাত্র লিয়েন্ডারের পক্ষেই মারা সম্ভব!
এই লিয়েন্ডারকে কেবল সেলাম জানাতেই পারি! আর তর্কসভা বসাতে পারি সৌরভ, লেসলি ক্লডিয়াস, দিব্যেন্দু বড়ুয়া, চুনী গোস্বামী, লিয়েন্ডারের মধ্যে কে বাংলার সর্ব কালের সেরা ক্রীড়াবিদ। |