বিস্মৃতির পথে ধর্মমঙ্গলের প্রাচীন কবি রামদাস
কাঠ দিয়ে ঢাকা রয়েছে মাটির নীচে পোঁতা হাঁড়ির খোলা মুখ। তার উপর দাঁড়িয়ে এক জন পায়ের তাল ঠুকছেন। তার দিকে খেয়াল রেখে সুর করে পড়া হচ্ছে ধর্মঠাকুরের পাঁচালি। মঙ্গলকাব্যের বিস্মৃতপ্রায় কবি রামদাস আদকের পুথির পালাগানের আসরের এই ছবি হয়তো ধীরে ধীরে ইতিহাস হতে চলেছে।
হাওড়া থেকে আরামবাগ লোকালে চেপে দেড় ঘণ্টার রেলপথ পেরিয়ে তোকিপুর স্টেশন। সেখান থেকে দশ মিনিটের হাঁটাপথে পশ্চিমপাড়া। এখানেই বাস ছিল রাম কবির। তার স্বীকৃতি হিসেবে গ্রামে ঢোকার মুখেই চোখে পড়বে একটি ভগ্নপ্রায় স্মৃতিস্তম্ভ। পাথরের উপরে অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া বর্ণে সেখানে লেখা আছে ‘অনাদিমঙ্গল বা শ্রীধর্ম্মপুরাণ রচয়িতা সাধক কবি রামদাস আদকের স্মৃতিস্তম্ভ’।
কবি রামদাস আদকের পুথিটি এখন পড়তে পারেন রবীন্দ্রনাথবাবু।
১৯৬৫ সালের ১৩ জুন বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন এই গ্রামে এসে রামদাস আদকের এই স্মৃতিস্তম্ভটির উদ্বোধন করেছিলেন। তার পর থেকে কোনও সরকারি সাহায্য পাননি আদক পরিবারের সদস্যেরা। একটি টিনের তোরঙ্গের মধ্যে লাল শালুতে মোড়া অবস্থায় আস্তে-আস্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে রামদাস আদকের ‘অনাদিমঙ্গল।’
রামদাস আদকের বর্তমান প্রজন্মের সদস্য রবীন্দ্রনাথ আদক ও শিবপ্রসাদ আদক। রবীন্দ্রনাথবাবু এখন পালাগানের আকারে তাঁর পূর্বপুরুষের পুথি পাঠ করেন। তিনি জানালেন, জ্যাঠার ছেলে ভরত আদকের থেকে শিখে ১৮ বছর বয়সে এই পালাগান শুরু করেন তিনি। ২৪ খণ্ডে বিভক্ত এই পুথি পুরো গাইতে সময় লাগে ১২ দিন। প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসে বর্ধমানের জাড়গ্রামে এই পুথি পালা করে গাওয়া হয়। এ ছাড়াও বছরের অন্য সময়ে হুগলি ও বর্ধমানের নানা জায়গা থেকে ডাক আসে তাঁর।
কবে সৃষ্টি হয়েছিল অনাদিমঙ্গল? কে লিখেছিলেন? বাংলা সাহিত্যের গবেষক মহলে অবশ্য তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ আদকের দাবি, তাঁর বংশের পূর্বপুরুষ কবি রামদাস নিরক্ষর ছিলেন। খাজনা দিতে না পেরে রাজার সামন্তের তাড়া খেয়ে তিনি হুগলিরই খানাকুল থেকে পালিয়ে আসেন। পথে ধর্মঠাকুর দেখা দিয়ে তাঁর নামকীর্তন করতে বলেন। তার পরে তিনি মৌখিক ভাবে ধর্মমঙ্গল রচনা করেন।
প্রাচীন অনাদিমঙ্গল পুথির একটি অংশ।
যদিও পুথি বিশেষজ্ঞ শ্যামল বেরার সন্দেহ, “হয়তো কবি রামদাস নিজেই পুথি লিখেছিলেন। বর্ধমান সাহিত্যসভাতেও রামদাস আদকের দু’টি পুথি রাখা আছে। সেগুলি তবে কার লেখা?” তিনি বলেন, “পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ প্রকাশিত ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ বইয়ে সাহিত্য গবেষক দীনেশচন্দ্র সেন এই পুথির উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, বর্ধমানের রায়নার অম্বিকাচরণ গুপ্ত এই পুথি আবিষ্কার করেছিলেন। তবে সময়কাল অজানা।” ১৯৩৮ সালে (১৩৪৫ বঙ্গাব্দ) বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ও ‘শ্রীধম্মপুরাণ’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন।
আরামবাগের আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক দেবাশিস শেঠ পশ্চিমপাড়ার বাড়িতে থাকা রামদাসের ২৪টি পালার পাঠোদ্ধার করে ২০০৯ সালে ‘ধর্মমঙ্গলের কবি রামদাস আদক ও সমকাল’ নামে প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, “বাড়িতে থাকা পুথির ভণিতা থেকে জানা যায়, ১৬৬২ সালে তিনি ধর্মমঙ্গলের এই কাহিনির মৌখিক সৃষ্টি করেছিলেন। রামদাসের তৃতীয় পুরুষ তারাচাঁদ আদক সমগ্র কাব্যটি লিপিবদ্ধ করেন ১৮২৬ সালে।”
১৯৬৫ সালে পশ্চিমপাড়ায় কবির বাড়ির সামনে তৈরি হয় এই স্মৃতিস্তম্ভটি।
বাংলা সাহিত্যর ইতিহাসে ধর্মমঙ্গলের অন্যান্য কবির বিস্তৃত পরিচয় থাকলেও রামদাস আদক অনেকটাই উপেক্ষিত। আদক পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের গলাতেও তাই ঝরে পড়ে অভিমান।
প্রাক্তন স্কুল শিক্ষক শিবপ্রসাদ আদক বলেন, “বাংলা সাহিত্যর বইগুলোয় রামদাস আদকের শুধু নামটাই রয়েছে। অথচ মঙ্গলকাব্যের অন্য কবিদের পরিচয়, কবিকৃতি আলোচনা করা হয়েছে। কেন এই বৈষম্য বলতে পারেন?”
দেবাশিসবাবুর মতে, “আদক পরিবারের পরের প্রজন্ম একটি খাতায় পুথির কিছু অংশ লিখে গান করতেন। তখন যেহেতু পালাগান খুবই জনপ্রিয় ছিল, তাই রামদাস আদকের গানের সঙ্গে ধর্মমঙ্গলের অন্য কবিদের গানও মিলিয়ে দেওয়া হয়। রামদাস আদক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেন। ফলে সাহিত্য সমালোচকেরা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস লেখার সময়ে তাঁকে আলাদা করে গুরুত্ব দেননি।”
পুথিটি রামদাস কবি লিখেছিলেন না কি তাঁর তৃতীয় পুরুষ তারাচাঁদ কবি, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বর্তমানে বাড়িতে থাকা পুথিটির যে অবিলম্বে সংরক্ষণ প্রয়োজন সে বিষয়ে একমত সবাই। রবীন্দ্রনাথবাবুর পরবর্তী প্রজন্মের আর কেউ এই পুথি পাঠ করতে জানেন না। বাড়িতে থাকা পুথিটির অবস্থাও বেশ খারাপ।
গবেষকদের আশঙ্কা, হাঁড়ির উপর কাঠ রেখে নাচের তালে এই কাব্য পাঠ এবং অনাদিমঙ্গল কাব্য দুটোই হয়তো অচিরে হারিয়ে যাবে। তাঁদের দাবি, কবির বর্তমান প্রজন্ম যদি আসল পুথিটি দিতে না চান তা হলে অন্তত সেটির ছবি তুলে সংরক্ষণ করা হোক। আর পুথিটি যখন পাঠ করা হয়, তখন তার ভিডিও করে রাখা হোক।
তা হলে অন্তত ইতিহাসে সেই অনাদি-স্বাক্ষরটুকু থেকে যাবে।

ছবি: তাপস ঘোষ।





First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.