শব্দ ব্রহ্ম। রাজনীতি পরমব্রহ্ম। অতএব, আসন্ন বাজির মরসুমে রাজ্যবাসীর কর্ণবিদারণের ব্যবস্থা পাকা হইয়া গেল। ৯০ ডেসিবেল-এর সীমা ঘুচিয়া গেল, বাজির শব্দ ১২৫ ডেসিবেলের মধ্যে থাকিলেই তাহা ধর্মমতে গ্রাহ্য হইবে বলিয়া রাজ্য সরকার জানাইয়া দিল। বাজি প্রস্তুতকারক হইতে বিক্রেতা ও ক্রেতা, সব মহল হইতেই যে চাপ ছিল, তাহা মানিয়া লওয়া হইল। কাহারও মনে ক্ষোভ পুষিয়া রাখিবার আর কারণ নাই। সত্য, যাঁহারা এই শব্দকল্পদ্রুমে আমোদ পান না, বা কপালদোষে অসুস্থ, তাঁহাদের প্রাণান্ত হইবে। কিন্তু, রাজ্যের পরিবেশ দফতরের এক কর্তা সার কথাটি বলিয়া দিয়াছেন: মাত্র কয়েকটা দিনই তো শব্দবাজি ফাটে। তাহাতে দুনিয়া এমন কিছু রসাতলে যায় না! অতএব, আনন্দধারা বহিবে ভুবনে। সহ্য না হইলে কানে আঙুল দিয়া রাখুন, কয়েকটি দিন বই তো নহে।
সরকারের তরফে অবশ্য যুক্তি আছে: সিদ্ধান্তটি তাহাদের নিজস্ব নহে, জাতীয় পরিবেশ আদালতই এই রায় দিয়াছে। প্রতিযুক্তিও হাজির: পরিবেশ আদালতের নির্দেশ সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরিপন্থী। বাজির শব্দসীমা ৯০ ডেসিবেলের পরিবর্তে ১২৫ ডেসিবেল করিবার আবেদন সুপ্রিম কোর্ট অতীতে একাধিক বার খারিজ করিয়া দিয়াছে। কিন্তু এই আইনি তর্ক থাকুক। সভ্য সমাজ নামক একটি বস্তু, শুনিতে অলীক হইলেও, আছে। কোনও সমাজ সভ্য কি না, তাহা বিচার করিবার একটি স্বাভাবিক মাপকাঠি, সেই সমাজ এবং তাহার প্রতিনিধি রাজনীতিকরা স্বপ্রবৃত্ত হইয়া মানুষের সুস্থ জীবনযাপনের অধিকারকে সম্মান করেন কি না। পশ্চিমবঙ্গ বারে বারেই এই পরীক্ষায় ফেল করিতে অভ্যস্ত। শব্দবাজির প্রশ্নেও ফল বদলায় নাই। পরিবেশ মন্ত্রী প্রশ্ন করিয়াছেন, এত দিন তো শব্দবাজি নিষিদ্ধ ছিল। তবুও কি বাজি ফাটে নাই? মন্ত্রিবরের এই প্রশ্নটি কৃষ্ণের মুখগহ্বরের ন্যায়, তাহাতে শাসকদের মনের ভিতরকার বিশ্বরূপ দর্শন হইয়া যায়। আইন থাকা সত্ত্বেও কেন শব্দরাক্ষসের দাপট রোখা যায় নাই, তাহাও বোঝা যায়— কিঞ্চিৎ হাসিয়া বেনিয়মকে প্রশ্রয় দেওয়াই শাসকের অভ্যাস। আইনের শাসন আর রাজনীতির মধ্যে এখন মুখ-দেখাদেখি নাই।
শব্দবাজির দাপট একটি উদাহরণ। মূল সমস্যা আরও অনেক গভীরে। কোনটি আনন্দ আর কোনটি বিকৃতি, বর্তমান সমাজ সেই কথা ভুলিয়াছে। কেন, তাহা এক ভিন্ন আলোচনার বিষয়। কিন্তু বিকৃতিগুলিও যখন রাজনীতির মাহাত্ম্যে প্রশাসনিক প্রশ্রয় পায়, পুলিশ যখন দেখিয়াও না দেখিবার ভান করিয়া থাকে, তখন সেই বিকৃতির উদ্যাপনে আর কোনও বাধা থাকে না। রাস্তা জুড়িয়া দুর্গাপূজা যেমন এই রাজ্যে দস্তুর হইয়া দাঁড়াইয়াছে। যে ‘আনন্দে’ এক জন নাগরিকেরও স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়, সেই ‘আনন্দ’ বন্ধ করিবার দায়িত্ব প্রশাসনের। তাহা সভ্য হইবার শর্ত। কিন্তু সেই শর্ত পালনের মধ্যে বোধ হয় ‘হেডমাস্টারসুলভ কঠোরতা’ রহিয়াছে। রাজনীতিকরা আজকাল ‘বন্ধু’ হইতে চাহেন, তাহাতে দলে লোক জুটাইতে সুবিধা হয়। ফলে, বিকৃত আনন্দও প্রশাসনের প্রশ্রয়ে দিব্য চলিতে থাকে। নেতারা জানেন, নির্বাচন আসিতে ঢের দেরি আছে, তত দিনে মানুষ বাজির শব্দ ভুলিয়া যাইবে। কিন্তু আজ বাজি, কাল দুর্গাপূজা, পরশু কলেজে ভাঙচুর, তাহার পরে ভোটের মরসুম— প্রশ্রয়ের ধারাটি নিত্যপ্রবাহিনী। বন্ধুত্বে অতএব ছেদ পড়িবে না। তাহাতে সভ্যতার ক্ষতি হইলে হউক। শব্দটি এমনিতেই বিরল হইয়া গিয়াছে। |