|
|
|
|
|
|
|
একটাভয়[কষ্ট]লজ্জাঘেন্না |
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়
|
তখনও শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, তারাশঙ্কর পড়ি। সুনীল, সন্দীপন-এ হাতে খড়ি হয়নি। তখনও বিকেলে ব্যাডমিন্টন খেলতে যাই, পড়তে বসতে দেরি হলে মায়ের বকুনি খাই। টিভিতে বরাদ্দ কেবল বুধবারের চিত্রহার। মোদ্দা কথা তখনও পাকা বা আঁতেল কোনওটাই হয়ে উঠতে পারিনি। কিন্তু ভয়টা তখন থেকেই পাই। যে ভয় বড় হয়ে জটিল জগতে ঢোকার পর, পাখা গজাবার পর, ফুৎকারে সব কিছু উড়িয়ে দেওয়ার অভ্যাসের সময়েও, মনে বাসা বেঁধে ছিল। কাউকে বলতে পারিনি। পাছে যাচ্ছেতাই বোকা বলে আওয়াজ খেতে হয়।
কিন্তু ভয় কি আর পরোয়া করে কে কী বলল, কে কী ভাবল। কালো বা রাত্রি-নীল রং তার স্টেটমেন্ট। আমার শিরদাঁড়া তার দাস, ব্রেন তার হাতে অবশ। নির্বিকার আর নির্বিচার ছুড়তে থাকে বিভীষিকার চাল। আমি আউট। পড়তে পড়তে কখনও দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে মা’কে দেখে আসি। কখনও বারান্দায় গিয়ে যাচিয়ে নিই ট্রাম-বাস-গাড়ির মহামোচ্ছব চালু আছে কি না। আর নিজেকে আয়নায় দেখি কিংবা চিমটি কেটে দেখি। জোরে জোরে বাংলা বাক্য বলি।
সেই ভয়টা হল আমার এই জীবনটা আসলে হয়তো একটা স্বপ্ন! আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এটা দেখছি! এই যে আমি খাচ্ছি, ঘুরছি, পড়ছি না, চেঁচিয়ে কথা বলার জন্য বকুনি খাচ্ছি, পুজোয় ঠাকুর দেখছি, বাংলা বলছি, এই যে আমার বাবা-মা-দিদি এ সব কিচ্ছু হয়তো সত্যি নয়, বাস্তব নয়! এর কোনও কিচ্ছুর অস্তিত্বই নেই। ঠিক যেমন এই স্বপ্নটার মধ্যে আমি যে স্বপ্নগুলো দেখি, ঘুম ভেঙে গেলে বুঝি, যাঃ, ওগুলো সত্যি ছিল না!
এমন কি হতেও পারে যে এক দিন আমার ঘুম ভেঙে গেল, আর আমি দেখলাম আমি সম্পূর্ণ একটা অন্য দেশে থাকি। ধরা যাক চিন। বা ভেনেজুয়েলা। আমি হয়তো আমি নই। আমার মতো দেখতে নই। আমার বাবা-মা অন্য। আমার ভাষা অন্য। আমার খাবার অন্য। তা হলে কী হবে? উঠতেই হয়তো এক জন চাইনিজ এসে আশ্চর্য ভাষায় আমায় পাউরুটি এনে দিতে বলল। আমি কি বুঝতে পারব? এক জন অন্য বাবা এসে যদি আমায় বেড়াতে নিয়ে যেতে চায়, ভরসা করে কি যাওয়া উচিত হবে? সবচেয়ে বড় কথা, আমি তাদের ভালবাসব কী করে? ভাষা-টাসা নয় স্বপ্ন ভাঙতেই ব্রেনে এসে যাবে, কিন্তু মনটাও কি বদলে যাবে তক্ষুনি-তক্ষুনি? খুব ভয় পেলে যেমন হয়, আমি সিরিয়াসলি পুরো ভাবনাটাকে ফলো করতাম। ভাবতাম, ঘুম থেকে উঠে, কিছু ক্ষণ পরেই, আমি কি এই পুরো স্বপ্নটা ভুলে যাব? এই যেটা দেখছি? এই যেটাকে এখন খুব জড়িয়ে-মড়িয়ে বাঁচছি? কত ক্ষণ পর অন্য লোককে মা-বাবা বলতে পারব? সেখানে কি আমার একটা দিদি থাকবে? এই দিদিটা ছাড়া আমি অন্য দিদি তো চাই না! সেখানে তো পুজো হবে না। নিভু আলোয় ব্যাডমিন্টন র্যাকেট নিয়ে গল্প হবে না, এমনকী আমির খানের সিনেমাও আসবে না। আমার গলা বুজে আসত। মন নিভে আসত।
এক সময় খুব মনের জোর করে নিজেকে বলতাম পাগলার মতো কথা বলিস না তো কিন্তু এই খচখচ মনের ভেতর ঠিক সেঁধিয়ে থাকত আর মাঝে মধ্যেই উঁকি মারত। যখন একা একা পড়ন্ত বিকেলের আলোর দিকে তাকিয়ে খামখাই মন-খারাপ করতাম, হঠাৎ মনে হত আরে! কী করছি! সময় নষ্ট করছি কেন? যদি হুট করে ঘুম ভেঙে যায় আর এই জীবনটা না থাকে, তা হলে তো যেটুকু পাচ্ছি সেটুকু নিংড়ে নেওয়া উচিত। রান্নাঘরে গিয়ে হইচই লাগিয়ে দিতাম কিংবা দিদিকে সাংঘাতিক বিরক্ত করতাম। ছটফট করত ভেতরটা। মনে হত কিছু একটা দিয়ে ভরিয়ে দিই আমার শূন্যস্থান। লেপটেজুপটে নিয়ে নিই সব আটপৌরে গন্ধ, চেটেপুটে খেয়ে নিই আমার জীবন।
এক একটা ফেজ-এ এই ভাবনাটা আমায় এমন জাঁকড়ে ধরত যে ঘুম ভেঙে গিয়ে চোখ খুলতাম না। মা’র ধাতানি তখন বড় আরাম দিত। |
|
|
|
|
|