|
|
|
|
|
|
|
সুমনামি |
কবীর সুমন
|
কার তাতে কী, আমরা যদি এই আকালেও স্বপ্ন দেখি। ২০১৩ সালের বর্ষার এক সকালে মেয়েটি আমায় টেক্সট করছেন: ‘আছে সবার উপরে মাখা তাহে বঁধু তব মধুময় হাসিটি’। রাস্তায় যেতে যেতে সেলফোনে পড়ছি আর ভাবছি, এ শহরে আজও এক জন আছেন, যিনি এমন এক সকালে এমন একটি গানের এমন একটি কলি এই শহরেরই কাউকে পাঠিয়ে দিতে পারেন। আমার এই উদ্ভট শহর। ভাঙাচোরা। ছিরিছাঁদহীন। পুরনো পুরনো বাড়ির ইট-বেরিয়ে-পড়া দেওয়াল বৃষ্টিতে ভিজে এই সকালে আরও বেচারি-বেচারি। আমাদের এলাকার দোকানগুলোর টিন-প্লাইউড-ময়লা-কাচ আর পুরনো বাড়ির বুনোগাছ গজানো দেওয়াল তার শ্যাওলা-ধরা ইটের ওপর কিউ-এর ‘তাসের দেশ’-এর লাল-সাদা পোস্টার তাতে হাঁ-করা একটা লোকের মুখ বিকট। পোস্টারে সাহেবদের মন্তব্য ‘সেক্সি’, ‘এক্সেন্ট্রিক’, ‘সিনিস্টার’। সব মিলিয়ে কেমন মানিয়ে যাচ্ছে। পথে যেতে যেতে চারপাশ দেখছি আর তারই মধ্যে সেলফোনে এসএমএস নিঃশব্দে গেয়ে উঠছে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের একটি গান।
আজকের বাঙালি দ্বিজেন্দ্রলালের গান বড় একটা শোনে না, গায় না, ভাবেও না। দু-এক জন শিল্পী এখনও আছেন, যাঁরা ‘দ্বিজেন্দ্রগীতি’ ও ‘অতুলপ্রসাদী’ অথবা ‘রজনীকান্তর গান’ রেকর্ড করে বিজ্ঞাপন দেন। সম্ভবত নিজেদের খরচেই রেকর্ড করেন, স্টুডিয়ো, অ্যারেঞ্জার ও যন্ত্রীদের খরচ জুগিয়ে। সেই সিডি ক’জন কিনে শোনেন জানি না। অথচ, আধুনিক বাংলার গীতিকার-সুরকারদের মধ্যে এঁরা অগ্রগণ্য। সেই সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলাম, যিনি বয়সে সবার ছোট। অনেকেই জানেন এঁরা শ্রদ্ধেয়। কিন্তু আজকের যুগে এই সাবেক শ্রদ্ধেয়দের আবেদন কতখানি, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। |
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
সাবেকপন্থীরা বলবেন এঁদের গানগুলির চর্চা হওয়া দরকার। কিছু গান নিশ্চয়ই আজও ভাল লাগতে পারে, লাগার কথা। কিন্তু সব গানের চর্চা হতে গেলে আগে তো শুনতে ও গাইতে ভাল লাগতে হবে। আমি দেখেছি অনেক গান আমারই ভাল লাগছে না। সত্যি বলতে, কোনও দিনই লাগেনি। যেমন, দ্বিজেন্দ্রলালের ‘আইল ঋতুরাজ’ বা অতুলপ্রসাদের ‘আপন কাজে অচল হলে চলবে না’ সমেত আরও কিছু, রজনীকান্তর বেশির ভাগ গান এবং যথেষ্টসংখ্যক ‘নজরুলগীতি’। তেমনি রবীন্দ্রনাথেরও ‘দৈবে তুমি কখন নেশায় পেয়ে’ বা ‘এ পরবাসে রবে কে’ এবং আরও কিছু গান শুনলে আমার ছোটবেলা থেকেই বিরক্তি আসে। শুধু কথার গুরুত্বের জন্য গান শুনতে আমি নারাজ। সুর, তাল, ছন্দ, লয়ের সঙ্গে মিলে কথা কী রূপ নিল, সেটা বরং জানতে চাই। কথা একটু দুর্বল হলেও সুরের আবেদনে গান স্মরণীয় ও গায়নীয় হয়ে ওঠে। সত্যি বলতে, বাংলার গীতিকার-সুরকারদের মধ্যে যাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক নিরিখে অগ্রগণ্য, যাঁদের নামের সঙ্গে ‘গীতি’ ও ‘সংগীত’ কথা দুটি বসানোর রীতি কায়েম হয়ে গিয়েছে, তাঁদের অনেক গানেরই সুর-ছন্দের কোনও আবেদন আমার কাছে অন্তত নেই। আজ যাঁরা নবীন, তাঁদের কাছে থাকবে কী করে?
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানের কপিরাইটও সম্ভবত আর নেই। কিন্তু তাও রবীন্দ্রনাথের গানের কপিরাইট উঠে যাওয়ার পর যে-হারে নানান ছায়াছবিতে ‘রবীন্দ্রসংগীত’ ব্যবহার করা হয়েছে এবং নানান শিল্পী রেকর্ড করেছেন, তার তুলনায় ‘দ্বিজেন্দ্রগীতি’ ব্যবহার করা বা রেকর্ড করার নজির খুবই কম। রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে কেউ কেউ নানান এক্সপেরিমেন্টও করেছেন, করে চলেছেন। মোটামুটি সংগীতশিক্ষা করে এবং গানগুলি ভাল করে শিখে নিয়ে গাওয়ার এক্সপেরিমেন্টটাও করা যেত। তাতে খাটনি বেশি বলে আজকের ‘মিডিয়াতে ভাল বললে ভাল সেইই হয়’-এর যুগে আমরা তা এড়িয়ে যাচ্ছি। রবীন্দ্রনাথের ‘পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে’ গানটি হুল্লা-হুল্লা ধ্বনি সহযোগে বাংলা ছায়াছবিতে এক্সপেরিমেন্টিত। ‘বৃষ্টি-নেশা-ভরা সন্ধ্যাবেলা’তে ‘নেশা’র সুরে এক্সপেরিমেন্টীয়, স্বকপোলপ্রসূত বৈচিত্রও রেকর্ডিত। যে যে-ভাবে পারছে রবীন্দ্রনাথের গান গাইছে, বাজাচ্ছে, আবার এই শহরেই আজও এক নবীনা দ্বিজেন্দ্রলালের একটি গান শুনছেন, ভাবছেন, হয়তো গুনগুন করে গাইছেনও। সেই গানের একটি কলি টেক্সট করে পাঠাচ্ছেন তাঁর এক প্রবীণ বন্ধুকে। আমাকে।
নবীনা আমার বন্ধু, তাই জানি ইউ টিউব থেকে জোগাড় করেছেন তিনি এই গানের দুটি রেকর্ডিং। দুটিরই শিল্পী কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়। একটিতে তালযন্ত্র বেজেছে, ফলে তালে তালে গাওয়া। অন্যটি তালে গাননি তিনি, তালযন্ত্র নেই। এই রেকর্ডিংটিই এই নবীনা বারবার শোনেন, আমাকেও শোনান। উল্লেখ করা দরকার, তালে গাওয়া রেকর্ডিংটি আরও অল্প বয়সের। গলা তখন তাজা। প্রতিটি সূক্ষ্ম কাজ কী নিপুণ ভাবে যে করেছিলেন এই শিল্পী! তাল ছাড়া রেকর্ডিংটি কিন্তু বেশি বয়সের। গলা তখন আর স্ববশে নেই। নিচু স্কেলে গানটি ধরেও তারসপ্তকের ষড়জেও গলা যেন প্রত্যয়ের সঙ্গে সুরে ভিড়ছে না, দাঁড়াচ্ছে না। কাজগুলি, মুড়কিগুলি জড়িয়ে যাচ্ছে বয়স হলে কণ্ঠশিল্পীদের যেমন হয়। কিন্তু এই সব দুর্বলতা সত্ত্বেও কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায় গানটি গেয়েছেন পূর্ণ মেজাজে। এই বিশেষ মেজাজটি তাঁর অল্প বয়সে করা রেকর্ডিং-এ পাইনি। দীর্ঘ কাল গানে মগ্ন থাকলে, চর্চা করে গেলে বেশি বয়সে যে রসের সন্ধান এক জন বড় শিল্পী নিজে পান এবং শ্রোতাদের দিতে পারেন, সেই রসেই মাখা তাল ছাড়া এই রেকর্ডিংটি।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ও যে মানে না মানা’ গানটিতে ভৈরবী রাগটিকে লুকিয়ে রেখে শুদ্ধ স্বরের পরম্পরা ব্যবহার করে ভৈরবীরই প্রচ্ছন্ন মেজাজ তৈরির যে কাজটি করেছিলেন, একই কাজ করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ‘আমি সারা সকালটি বসে বসে’ গানটিতে। রবীন্দ্রনাথের ওই গানটির স্বরলিপি যিনি করেছিলেন, তিনি ভৈরবী রাগটিকে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে তবে ছেড়েছিলেন। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধদেব রায় ‘১০১টি সুনির্বাচিত দ্বিজেন্দ্রগীতির স্বরলিপি’ বইটিতে ‘আমি সারা সকালটি বসে বসে’র যে স্বরলিপি রেখেছেন, সেটি কিন্তু শুদ্ধ স্বরভিত্তিক। ভৈরবী রাগটির ধাঁচা এতে নেই। স্বরলিপিটি যিনি করেছেন, ইচ্ছে করলে এই গানটিকে তিনি ভৈরবী বানিয়ে ছাড়তে পারতেন। রবীন্দ্রনাথের ‘ও যে মানে না মানা’র মতো ‘আমি সারা সকালটি’ও ষড়জে শুরু হয়ে শুদ্ধ গান্ধারকে করে তুলেছে গন্তব্য। হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের হিসেবে এটিকে ‘ন্যাস স্বর’ মনে করলে এটিকে এই কম্পোজিশনের লুকনো ষড়জ হিসেবে মেনে নিতে কোনও সংগীতবোদ্ধার আপত্তি থাকার কথা নয়। সে ক্ষেত্রে আপাতশুদ্ধ স্বরবিশিষ্ট এই কম্পোজিশনে আমরা লুকনো ভৈরবীর সন্ধান পাব। পাচ্ছিও। ভৈরবী রাগটিকে দেখিয়ে দেওয়ার কোনও ইচ্ছেই যে শিল্পী বা যন্ত্রানুষঙ্গ-পরিচালকের ছিল না, তার প্রমাণ বাজনার ধরতাই স্রেফ শুদ্ধ স্বরভিত্তিক। গানের মাঝামাঝির পর এক জায়গায় একটি বেহালা হঠাৎ হারমোনিয়াম আর অন্য যন্ত্রগুলিকে ছাপিয়ে উঠে নিজেকে জাহির করছে। কিন্তু সেই বেহালাতেও ভৈরবীর ছিটেফোঁটাও নেই। যে পরদা থেকে শিল্পী গানটি ধরেছেন, সেটির নিরিখেই কয়েকটি শুদ্ধ স্বরের ওপরে একটুখানি বেজে নিচ্ছে বেহালাটি।
আমি ভাবছি, ভেবে চলেছি সুর-রচনার এই যে অভিনব পদ্ধতি রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলাল দুজনেই প্রয়োগ করেছিলেন, কার মাথায় এটা আগে এসেছিল। কে কবে এই পদ্ধতিতে প্রথম সুরটি করেছিলেন? না কি মোটামুটি একই সঙ্গে? দুজনের কেউই হয়তো জানতেন না যে অন্য জন একই পদ্ধতি প্রয়োগ করছেন। না কি তাঁরা দুজনেই একই উৎস থেকে গ্রহণ করেছিলেন এই পদ্ধতি? লুকনো ভৈরবীর মতোই হয়তো চিরকাল লুকিয়ে থাকবে এই রহস্যের সূত্র। |
|
|
|
|
|