রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ১...
খুদে খুনি
হার্ভে রবিনসন যখন প্রথম খুনটা করে, তার বয়স মোটে ১৭। তার প্রথম শিকার একটি মেয়ে। মেয়েটি শুতে যাওয়ার আগে ঘরে পোশাক ছাড়ছিল। তার নগ্ন চেহারা রবিনসন দেখে ফেলে খোলা জানলা দিয়ে। জবরদস্তি বাড়িতে ঢুকে, মেয়েটিকে খুন করে। কিছু দিন পরেই ফের একটা খুন। তার আগে ধর্ষণ। এ বার বছর পনেরোর কিশোরী। পরের ঘটনাটি আরও মারাত্মক। প্রতি বারের মতোই সে তার টার্গেট ঠিক করে একটি বাড়িতে ঢুকে পড়ে। কিন্তু মেয়েটি সেই সময় বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছিল। রবিনসনের সামনে পড়ে যায় তার পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়েটি। তাকেই সে ধর্ষণ করে গলা টিপে পালিয়ে যায়। একরত্তি শিশুটি কোনও মতে প্রাণে বেঁচে যায়। পরের ঘটনার শুরুটা একই রকম। কিন্তু শেষটা আলাদা। রবিনসন তার শিকারকে ধর্ষণ করে গলা টিপে মারতে যাবে, এমন সময় এক জন এসে পড়ে। রবিনসন পালায়, কিন্তু তক্কে তক্কে থাকে। তার কুকর্মের জলজ্যান্ত সাক্ষী থেকে গেল যে! ফেলে রাখা কাজ শেষ করতে সে ফিরে আসে। ভাগ্য ভাল, মেয়েটি সে সময় ছিল না। এ বার কিন্তু শুরু হয় এক অন্য খেলা।
পুলিশ ওই মেয়েটিকেই ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করে, খুনিকে ধরতে। তারা জানত, রবিনসন আবার আসবে। ইতিমধ্যে সে আরও এক জনকে খুন করেছে। কিন্তু ফসকে যাওয়া শিকারের কথা ভোলেনি। ফের মেয়েটির বাড়িতে হানা দেয়। এবং ধরা পড়ে, প্রচণ্ড গুলির লড়াইয়ের পর। রবিনসনই ছিল আমেরিকায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কনিষ্ঠতম সিরিয়াল কিলার। এক বছরের কম সময়ে পাঁচটি মেয়েকে আক্রমণ করেছে সে, সকলকে ধর্ষণ ও খুনের চেষ্টা করেছে, কোনও ‘মোটিভ’ ছাড়াই। ‘মোটিভ’, রহস্যরোমাঞ্চ সিরিজের পোকাদের খুব চেনা একটি শব্দ। বহু বেয়াড়া কেস-এর মসৃণ সমাধান সম্ভব হয়েছে মোটিভটা ঠিক ঠিক চেনা গিয়েছে বলেই। কিন্তু ১৮ বছরের কমবয়সিরা যখন খুনি, তখন প্রায়ই দেখা গিয়েছে গোদা অর্থে যাকে ‘মোটিভ’ বলে, সেটা উধাও। ওই মুহূর্তে খুন করতে ভীষণ ইচ্ছে হয়েছে, তাই করেছে এটাই একমাত্র কারণ। এক জনের নরম শরীরে শানানো অস্ত্রের মসৃণ গেঁথে যাওয়া, ভলকে ভলকে বেরিয়ে আসা তাজা রক্ত, আর্তনাদ, অস্ফুট গোঙানি, তার পর মরে যাওয়ার ঠিক আগে ধড়ফড় করতে থাকা শরীর সবটুকু তারা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছে। ঠিক এই অনুভূতির কথাটাই লিখে রেখেছিল ১৫ বছরের অ্যালিসা বাস্টামান্টে তার জার্নালে, প্রতিবেশী ওল্টেনদের ন’বছরের ছোট্ট মেয়েটা হারিয়ে যাওয়ার কিছু পরেই ‘... অসাধারণ একটা অনুভূতি, যে মুহূর্তে তুমি ‘হে ভগবান, আমি কিছুতেই এটা করতে পারব না’-মার্কা আবেগটা থেকে বেরিয়ে আসবে, দেখবে বেশ উপভোগ করার মতোই জিনিস।’ অ্যালিসাদের বাড়ির কাছেই একটা কবরের ভেতর পাওয়া গিয়েছিল পাতায় ঢাকা ন’বছরের এলিজাবেথ ওল্টেন-এর ক্ষতবিক্ষত দেহটা। ময়নাতদন্ত পরে জানাবে, গলা টিপে মারা হয়েছে ওটেন-কে। ছিন্নভিন্ন করা হয়েছে তার গলা আর কবজি, তার পর কোপানো হয়েছে ছুরি দিয়ে। অ্যালিসার ওপর সন্দেহ পড়ে জার্নালটা পুলিশের হাতে আসার পরেই। সেটা দানা বাঁধে, যখন তারা দেখে কিশোরীটির সোশাল ওয়েবসাইটে পাঠানো ছবিগুলো, যেখানে টকটকে লিপস্টিক ঘেঁটে মুখময় রক্ত এঁকেছে সে, হবি হিসেবে লিখেছে, ‘মানুষ মারা’। জেরায় অ্যালিসা স্বীকার করে সে-ই খুন করেছে ওল্টেন-কে। কেন? খুন করার অনুভূতিটা ঠিক কেমন, তা জানতে! ওই জন্যই তো সে বেশ কিছু দিন আগেই কবরটাও তৈরি করে রেখেছিল!
অনেকটা একই কথা বলেছিল ১৬ বছরের ব্রেন্ডা স্পেনসার, গুলি চালিয়ে আট জন স্কুলপড়ুয়াকে জখম আর প্রিন্সিপালকে মেরে ফেলার পর। ছ’ঘণ্টার তাণ্ডব চালিয়ে, ধরা পড়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে সে উত্তর দিয়েছিল, সোমবারটা তার এমনিতেই ভাল লাগে না। আর তা ছাড়া এতে প্রচুর মজা হবে, তাই...।
ঠান্ডা মাথায়, ছক কষে খুন এবং তার পরও আগাগোড়া নির্বিকার থাকা পাকা ক্রিমিনাল হওয়ার সব ক’টি গুণই এদের মধ্যে পুরো মাত্রায় ছিল। অথচ কারও বয়সই ১৮ ছাড়ায়নি। আইন এ সব ক্ষেত্রে সাধারণত কমসম সাজা-র দিকেই ঝুঁকে থাকে। রাষ্ট্রের যুক্তি: অবুঝ এরা, পরিণতি না জেনেই কাজ করে ফেলে। সামনে আস্ত জীবনটাই তো পড়ে, নিজেকে শুধরে নেওয়ার পক্ষে অঢেল সময়। বরং কড়া সাজা দিলে ভবিষ্যতে এরা হার্ডকোর ক্রিমিনাল হয়ে যেতে পারে। অন্য যুক্তি বলে: চলন্ত বাসে নির্মম ধর্ষণ ও ধর্ষিতার যৌনাঙ্গে রড ঢুকিয়ে দেওয়ার অমানুষিক দলবদ্ধ ইতরতার অংশী হতে পারে যে, তাকে কি স্রেফ কিছু মাস গারদে থেকেই ড্যাংড্যাং করে বেরিয়ে যেতে দেওয়া যায়, শুধু ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ হওয়ার থেকে মাসকয়েক বয়স কম পড়েছিল বলে? এই তর্কের ফয়সালা সহজ নয়।
১৪ বছরের জোশুয়া ফিলিপ্স, পাশের বাড়ির আট বছরের মেয়েটিকে পাওয়া যাচ্ছে না দেখে নিজেও অন্যদের সঙ্গে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দেয়। দিন সাতেক কেটে যাওয়ার পর ফিলিপ্সের মা ছেলের বিছানা পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখেন, সেটার তলায় কী যেন আছে। একটু খুঁজতেই বেরিয়ে আসে নিখোঁজ মেয়েটির ‘বডি’টা। ধরা পড়ে ফিলিপ্স জানায়, ঘটনার দিন খেলতে খেলতে বেসবল ব্যাট দিয়ে সে হঠাৎই দুম করে মেরে বসে মেয়েটির চোখে। মেয়েটির পরিত্রাহি চিৎকারে আরও ঘাবড়ে গিয়ে সে তাকে নিয়ে আসে বাড়িতে। এর পর গলা টিপে, বেসবল ব্যাটের বাড়ি মেরে এবং একের পর এক ছুরির কোপে ছিন্নভিন্ন করে দেয় আট বছরের ছোট্ট শরীরটিকে।
কলকাতার সজল বারুইয়ের অবশ্য পাকা মোটিভ ছিল। প্রতিশোধ। সৎমা’র অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে সে দলবল জুটিয়ে সৎমা, বাবা এবং সৎভাই-সহ গোটা পরিবারকে খুন করে। মুখ-বন্ধ অবস্থায় চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে তাঁদের গলা টিপে মারার চেষ্টা করা হয় প্রথমে। সৎমা মারা যান, কিন্তু বাকি দুজন তখনও বেঁচে। তাঁদের কুপিয়ে খুন করা হয়। তিন ঘণ্টার অপারেশনের পর ফের নিখুঁত করে গুছিয়ে রাখা হয় বাড়ির জিনিসপত্র। ফ্রিজ খুলে খাওয়াদাওয়াও করে তারা। তার পর সজলেরই পরামর্শে তাকে বেঁধে বাকিরা চলে যায়, যাতে মনে হয় সে-ও ভিক্টিম। যে ভাবে ঠান্ডা মাথায় খুন এবং পুলিশকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য ঘটনা সাজানো হয়, তাক লাগানোর মতোই। বিন্দুমাত্র অনুতাপের চিহ্ন ছিল না তার মুখে। সজলের বয়স তখন ১৬।
স্তম্ভিত বিচারপতিরাও একে ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ অপরাধ বলে চিহ্নিত করে তার মৃত্যুদণ্ডের রায় শুনিয়েছিলেন। পরে তা যাবজ্জীবন সাজায় দাঁড়ায়। সজল পরে জেল থেকে পালায়, আবার ধরা পড়ে। ২০১০-এ তার কারাদণ্ড শেষ হয়, পরের বছরেই সে ফের ধরা পড়ে ডাকাতির অভিযোগে।
অনেকেই অপ্রাপ্তবয়স্কদের ভয়াবহ অপরাধের মধ্যে সজলের মতো অসুস্থ শৈশবের ছায়া দেখতে পান। ব্রিটেনের মেরি ফ্লোরা বেল-এর মা যেমন চার বছর বয়স থেকেই মেয়েকে যৌন ব্যবসায় নামার উসকানি দিত। পেশায় যৌনকর্মী মা তার প্রথম সন্তান মেরিকে একাধিক বার মেরে ফেলতেও চেয়েছিল। ১০ বছর বয়সেই মেরি তিন বছরের এক বাচ্চা ছেলেকে খুন করে, তার পাকস্থলীতে নিজের নামের আদ্যক্ষর লেখে। তার পর, তারই বয়সি অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে কাঁচি দিয়ে নিহত ছেলেটির চুল কাটে, পায়ে আঁচড় টানে, যৌনাঙ্গ কেটে দেয়।
১৯৯৩ সালের মার্চ। লন্ডনের আদালতে বিচার চলছে দুই ১৭ বছরের কিশোরীর। রায়ে বিচারপতি তাদের আখ্যা দিলেন, ‘ইভ্ল প্রোডাক্টস অব দ্য মডার্ন এজ’। কেন? তারা খুন করেছিল সত্তর বছর বয়সি পড়শি এড্না ফিলিপ্সকে। এড্না চোখে ভাল দেখতে পেতেন না। সেই সুযোগে তাঁকে উত্ত্যক্ত করে মারত এদের মধ্যে এক জন। গালাগাল দিত, বাগানে ময়লা ফেলত, জানলার কাচে পায়খানা মাখিয়ে রাখত। এড্না এক দিন সন্ধের মুখে তাঁর কুকুরটিকে খুঁজতে বেরিয়েছিলেন। সেই মুহূর্তেই মারিয়া রোজি আর টিনা মলি-র খপ্পরে পড়ে যান তিনি। চ্যাংদোলা করে বৃদ্ধাকে তারা নিয়ে আসে বাড়ির ভিতরে।
কুকুর বাঁধার চেন দিয়ে দমবন্ধ করে মারে। তার পর কাঁচি, ভাঙা কাচের টুকরো আর ছুরি দিয়ে মুখে আর বুকে ৩৫টা কোপ। লাথি মেরে মেরে থেঁতলে দেওয়া হয় নাক, পাঁচটা পাঁজরা। নড়বড়ে শরীরটাকে একটা মাংসের দলা পাকিয়ে পালিয়ে যাওয়ার আগে তারা চুরি করে নেয় সেই দিনই বৃদ্ধার তুলে আনা পেনশনের টাকা ক ’টি। অথচ, এড্না একদম রোজির ছোটবেলা থেকে তাকে দেখছেন। দীর্ঘ দিন ধরে তিনি অভিযোগ করছিলেন তাঁর এই প্রতিবেশী মেয়েগুলি বিরুদ্ধে। তারা ড্রাগ নেয়, জোরে গান বাজায়। কিন্তু কেউ কানে নেয়নি। মেয়ের ড্রাগ নেওয়ার কথা রোজির বাবা জানতেন। বাধা দেননি।
ঘটনার পরের দিন রোজি দিব্যি তার পরিবারের সঙ্গে ব্রেকফাস্ট খায়, তার পর গুনগুনিয়ে গান ধরে। কলিটি জনপ্রিয় গানের। কিন্তু কেউ কান পাতলে শুনতে পেত রোজি গাইছিল, ‘উই হ্যাভ কিলড এড্না ফিলিপ্স...’

ছবি: সুমন চৌধুরী


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.