|
|
|
|
|
|
শিল্প যখন ঠোঁটকাটা থাপ্পড়বান |
আজকের হিরো: অগমেন্টেড রিয়েলিটি ম্যানিফেস্টো
|
শিশির রায় |
হলিউড ছবি ‘ট্রন’ মনে আছে? আশির দশকের সিনেমার নায়ক ঘটনাক্রমে ঢুকে পড়ল আস্ত একটা মাস্টার কম্পিউটারের মধ্যে। সেখানে নানান কম্পিউটার প্রোগ্রামগুলোও হিউম্যানাকৃতি, যাদের নরমে-গরমে বুঝে-যুঝে হিরো শেষমেশ মোকাবিলা করে ভিলেনের। একটা সিকিয়োরিটি প্রোগ্রাম ‘ট্রন’ একটা সিনে বলে ওঠে অমোঘ কথা। ‘যা কিছু দৃশ্যমান, তার নিজেকে ছাপিয়ে বেড়ে ওঠাটা মাস্ট। বাড়তে বাড়তে এক দিন তা অদৃশ্য, অলক্ষ্য সব সীমা পেরিয়ে যাবে।’
কাট টু ২০১১। এখন ভার্চুয়াল রেসিং ট্র্যাকে শোঁ-শাঁ রকেটগতিতে গাড়ি ছোটে, বাস্তবের গায়ক-নায়ক-খেলুড়ে-সন্ত্রাসবাদী সবাই আইপ্যাড-ফোনের ওইটুকু স্ক্রিনে ভার্চুয়াল দাপাদাপি করে। আমার হাতে মাউস, বাটন, গেম-এর স্টিয়ারিং। আমিই ‘রিয়েল’, ওরা তো খেলা, ওরা ‘ভার্চুয়াল’। আমেরিকার নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি পলিটেক-এর থ্রি-ডি গ্রাফিক্স-এর শিক্ষক মার্ক স্কোয়ারেক কিন্তু অন্য রকম ভাবছিলেন। ‘ট্রন’-এর কথাটা তাঁর মাথায় ঘুরছিল। যা কিছু দৃশ্যমান, যা কিছু রিয়েল, তা কেন নিজেকে ছাপিয়ে বাড়বে না? কেন রিয়েল মিলবে না ভার্চুয়ালে? বা ভার্চুয়াল রিয়েল-এ মিশে গিয়ে তৈরি করবে না এমন এক আনকোরা রিয়েলিটি, যা জন্ম দেবে তাবৎ ধ্রুপদী শিল্প-ভাবনার পারেও এক অন্য জীবন-বোধের?
এই ভাবনাই জন্ম দিল ‘অগমেন্টেড রিয়েলিটি’র, স্কোয়ারেক-এর সহ-চিন্তক কিছু মানুষ একজোট হয়ে লিখে ফেললেন ‘অগমেন্টেড রিয়েলিটি (এ আর) ম্যানিফেস্টো’। এঁরা কেউ ভিশুয়াল আর্টিস্ট (ফোন-ট্যাবলেট-ল্যাপটপ আর থ্রি-ডি স্ক্রিন যাঁদের ক্যানভাস), কেউ স্থপতি, কেউ গ্রাফিক ডিজাইনার। মার্ক স্কোয়ারেক, টামিকো থিল, উইল প্যাপেনহাইমার, স্যান্ডার ভিনহফ, ক্রিস্টোফার ম্যানজিওন, জন ক্রেগ ফ্রিম্যান আর জিওফ্রে অ্যালান রোড্স এই ক’জনার ভাবনা এসে মিলল এই ম্যানিফেস্টো-য়।
অনেকগুলো ‘স্পেস’ একই সময়ে একসঙ্গে অবস্থান করে অগমেন্টেড রিয়েলিটিতে। তাই এই বাস্তবে ‘অসম্ভব’ বলে কিছু নেই। যা কিছু ঘটতে পারে যখন খুশি। যে রিয়েল (চার পাশের দৃশ্যশ্রাব্য বাস্তব) আর ভার্চুয়াল (আন্তর্জাল-জগতের ঘটমান বাস্তব) রিয়েলিটি নিয়ে আমাদের জীবনযাপন, সেই দুইয়ের মাঝেই কোথাও আছে ‘এ আর’ ভবিষ্যৎ। তার কোনও বাউন্ডারি নেই, কাঁটাতার নেই, আক্ষরিক অর্থেই তা অনন্ত, অশেষ। |
|
উইল প্যাপেনহাইমার-এর আকাশ-ছবি |
সেই ভবিষ্যতে প্রতিটি মানুষই এক একটি গণমাধ্যম। এবং এক এক জন সেভিয়ার। ম্যানিফেস্টোয় লেখা: ‘স্থির, স্থাণু একটা স্ক্রিনের বন্দিদশা থেকে ভার্চুয়ালকে মুক্ত করব আমরাই। ওই যে ইঞ্চিকয়েকের একটা নিরাপদ চৌকো, ওখান থেকে ওকে বার করে এনে ছড়িয়ে দেব চার পাশের গোদা, প্রকৃত স্থান-কালের পৃথিবীতে। দৃশ্যশ্রাব্য রিয়েল আর স্ক্রিনবন্দি ভার্চুয়াল মিলেমিশে যাবে নতুন, মাঝামাঝি একটা স্পেসে। শিল্পের, সৃষ্টির আঁতুড়ঘর হবে এই ইন-বিটুইন জমিনেই। সেটাই চরম অ্যাবসোলিউট, চিরন্তন, সর্বব্যাপী একটা ভূ-স্থানিক (জিও-লোকেটিভ) অস্তিত্ব।’
ঠিক কী রকম ‘এ আর’ শিল্পকর্ম? লিভারপুলের এক মিউজিয়ামে চলছিল ‘এ আর’ প্রদর্শনী। প্যাপেনহাইমার বললেন, শুধু ওইটুকু স্পেসে প্রদর্শনী করব কেন? মিউজিয়ামের ওপরে থাকা আকাশটুকুও আমার চাই। আকাশটাই ক্যানভাস, ছবি আঁকব ওখানেই। ‘রিয়েল’ আকাশে তো ও ভাবে ছবি আঁকা যায় না। মুশকিল-আসান ‘ভার্চুয়াল’ কম্পিউটার-তুলি। আকাশে জেট প্লেন চলে গেলে যেমন দুধসাদা ফেনিল একটা রেখা থেকে যায়, তেমনই ভার্চুয়াল এরোপ্লেন-ট্রেল ব্যবহার করে আঁকা হল ছবি (যেমন দেখছেন সঙ্গের ছবিতে)।
স্যান্ডার ভিনহফ বানালেন প্রোজেক্ট, ‘হিউম্যান কনফারেন্স সেন্সর’। হাই-তোলা, বোরিং কনফারেন্সে কেষ্টবিষ্টু অফিসাররা মনোযোগ হারাচ্ছেন? সবার গায়ে সেঁটে দেওয়া হল ‘বডি অ্যাক্টিভিটি সেন্সর’। মনোযোগের গ্রাফ ঢললেই, বা হার্টবিট লো হলেই, সেন্সরে ধরা পড়বে। তার ছবি সভাকক্ষেরই অন্য কোথাও কোনও ভার্চুয়াল স্ক্রিনে দেখে বক্তা সতর্ক হবেন, হয়তো বলবেন মুচমুচে স্বাদু চুটকি! শারীরবৃত্তীয় রিয়েল অনুভূতিকে ভার্চুয়াল স্ক্রিনে বদলে আবার রিয়েল লাইফেই তাকে কাজে লাগাও।
ভার্চুয়াল স্ক্রিনওলা যা কিছুমোবাইল ফোন, ট্যাবলেট সহ ভবিষ্যতের পৃথিবীর হরেক ভিশুয়ালাইজেশন ডিভাইসগুলোই ‘এ আর’ শিল্পকর্মের সাক্ষী। ওরাই প্ল্যাটফর্ম। ওদেরই দৌলতে ঘর থেকে রোজ বেরিয়ে অফিস যাওয়ার চিরচেনা রিয়েল মোড়, খানাখন্দ ঢুকে পড়ে থ্রি-ডাইমেনশনওলা চৌখুুপিতে। টামিকো থিল-এর প্রোজেক্ট ‘বায়োমার স্কেলটার’-এ রিয়েল বাস্তুতন্ত্রে শিল্পী-মনের বায়ো-রিদ্ম দিয়ে বানানো যায় দারুণ এক্সোটিক বন-জঙ্গল। আমি হয়তো থাকি কংক্রিটপাড়ায়, যেখানে টুকরো সবুজও বিরল। বায়োমার স্কেলটার-এর জাদুতে মুহূর্তে সেই পিচরাস্তার পাশেই নাচতে পারে উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রনগুচ্ছ। এই যে আমার পাড়া, অমুক বাসস্টপ, তমুক বিল্ডিং, এই সব স্পেসগুলোই জিপিএস (গ্লোবাল পোজিশনিং সিস্টেম) নিয়ন্ত্রিত, তার মানে পুরোদস্তুর রিয়েল। আবার ওদেরকেই ফোনের বা ট্যাবলেটের স্ক্রিনে দেখছি কী সবুজ, কী ভার্চুয়াল সবুজ! রিয়েল-ভার্চুয়ালের এই ঢুসোঢুসিতে দর্শকের মনে-মাথায় কী ঘটছে, তা বুঝতে অগমেন্টেড রিয়েলিটি অনেক ক্ষেত্রেই হয় অ্যানিমেটেড বা ইন্টারঅ্যাক্টিভ। এই শিল্প একটা সংযোগ-সাধন প্রক্রিয়া, যা কোনও বস্তু বা ধারণাকে অতিরিক্ত একটা বা একাধিক মাত্রা দেয়, সেগুলোকে জোড়ে, মেশায়। জীবনের কোনও প্রকরণই তার কাছে অচ্ছুত একঘরে নয়, সবাইকে দু’হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নেয় সে। ‘এ আর’ শিল্পীরা নিজেদের শিল্পী বলেন না, বলেন অ্যাক্টিভিস্ট। নিজেদের কৃতিকেও শিল্প না বলে বলেন প্রোজেক্ট, এগজিবিশন। তবে সবচেয়ে চালু আর উপযুক্ত যে শব্দটা, সেটা হল ‘ইন্টারভেনশন’। রিয়েল-এর তাঁবুর মধ্যে দিব্য খাচ্ছিদাচ্ছি বগল বাজাচ্ছি, হঠাৎ একই রকম সত্যি নিয়ে যদি প্রথমে নাক, পরে লম্বা গলা, তারও পরে গোটা শরীরটাই নিয়ে ঢুকে পড়ে ভার্চুয়ালের উট, সে তো চরম এক ইন্টারভেনশনই বটে। একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যায়, ইংরেজি শব্দ ‘ইন্টারভেনশন’-এর মানে হস্তক্ষেপও হয়, আবার মধ্যস্থতাও হয়। ‘এ আর’ অ্যাক্টিভিস্টদের শিল্পকৃতিতে এই দু’পিঠই আছে। ওঁরা বাগড়াও দেন, আবার মেলানও। মগ্নচৈতন্যে তৈরি করেন উদ্দীপন, যা কখনও নান্দনিক, কখনও পুরোদস্তুর রাজনৈতিক। মজাটা এখানেই, পুরো ব্যাপারটাই যন্ত্র ও প্রযুক্তি-নির্ভর, অনলাইন-অফলাইন নেটওয়ার্কিং-কেন্দ্রিক। ওঁরা এই উদ্দীপনার নাম দিয়েছেন ‘টেকনো-ডিস্টার্বেন্স’। যন্ত্র আর যান্ত্রিকতার হাত ধরে একটা ভার্চুয়াল মিডিয়া ভাইরাসের মতো হু হু ঢুকে পড়ে রিয়েল চারপাশটায়, মিশে যেতে থাকে, আর নিরন্তর বদলে যেতে থাকে তথাকথিত রিয়েল জগতের রিয়েল মানচিত্র। চেনা চেনা হাসিমুখের পরিবার-পার্ক-আপিস-রাজপথ-চার্চ সহ যত সামাজিক প্রতিষ্ঠানের খোলনলচে পালটাতে থাকে, ফেটে-ভেঙে ছড়িয়ে-গড়িয়ে যায়। যে সব অস্তিত্ব-পরিচয়, যে সব জিনিস অ্যাদ্দিন রিয়েল পৃথিবীতে কেবল এলিটদেরই একচেটিয়া গণতান্ত্রিক-নান্দনিক অধিকার ছিল, তা হয়ে যায় ট্যাগবিহীন উন্মুক্ত, বিশ্ব-মালিকানার। গোদা হায়ারার্কির মধ্যে গুমরে-মরা বদ্ধ সামাজিক কাঠামোগুলোকে আচমকা নাড়া দেওয়াটাই ‘এ আর’ অ্যাক্টিভিস্টদের কাজ। |
|
|
|
|
|