গণু মানে গণেশ ইদানীং ইলেকট্রিকের কাজ শিখে এ বাড়ি ও বাড়ি মেশিন সারিয়ে বেড়াচ্ছে। খুব যে রোজগার হচ্ছে তা নয়, তবু কাঠবেকারের চেয়ে তো ভাল।
মধুসূদনবাবুর মাইক্রোওভেন সারাতে এসেছে আজ গণু। ওভেন সারাবে কী? এই বাড়ির বউদি গ্যাসে মাংস রাঁধছে, আহা কী গন্ধ! কাজে সে মন দিতেই পারছে না। জিভের জলে বুকপকেট ভিজে যায় আর কী!
মধুসূদনবাবুর ছেলে পুপুল বায়না জুড়েছে, ‘আজ গুডফ্রাইডে, আমার ছুটি। আমাকে ‘হ্যারি পটার’ দেখাতে নিয়ে যাবে বলেছিলে, কিন্তু যাচ্ছ না!’
রান্নাঘর থেকে বউদি বলল, ‘পুপুল সোনা দেখ, অফিস থাকা সত্ত্বেও কত কষ্ট করে তোর জন্য মাংস রেঁধে রেখে যাচ্ছি। তোর ছুটি বুঝি খারাপ কাটবে?’
‘হ্যারি পটার’-এর বদলে মাংস? চাই না খেতে।
মধুসূদনবাবু টাই বাঁধতে বাঁধতে বললেন, ‘তোকে কথা দিচ্ছি পুপুল, যত তাড়াতাড়ি পারি ‘হ্যারি পটার’ দেখাব।’
‘আজই দেখাতে হবে। তুমি না পার, মা নিয়ে চলুক।’ পুপুলের মায়ের দিকে তাকিয়ে মধুসূদনবাবু বললেন, ‘আজ ছুটি নিতে পারো না?’
‘অসম্ভব। সেক্টর ফাইভে কারও ছুটি নেই আজ। আমি কি স্কুলে পড়াই? এখনই অফিস যাব। পুপুল, মাংসটা গরম, ডাইনিং টেবিলেই রইল।’
গণু জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটল। সত্যি, পুপুলটা কী? খেয়েদেয়ে রাগ কর বাপু। |
পুপুলের মা যাওয়ার সময় বলে গেল, ‘ফ্ল্যাটের চাবি টেবিলে রইল। যদি তুমি পুপুলকে নিয়ে বেরোও, তা হলে কেয়ারটেকারকে চাবিটা দিয়ে যেয়ো।’ ‘যাবে বাবা? প্লিজ! ‘হ্যারি পটার’ সবার দেখা হয়ে গিয়েছে।’ ‘আজ হবে না পুপুল, অফিসে অনেক কাজ।’ ‘আমি একা একা যাব, বাবা? হলটা তো বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়।’ ‘একা? না, পারবি না। এখন এইট। টেন-এ উঠলে পারমিশন দিয়ে দেব।’
পুপুল অভিমানে মুখ কালো করে বসে রইল। গণেশ মিস্ত্রি মাইক্রোওভেন সারিয়ে বেরিয়ে গেল। মধুসূদনবাবু তাকে দুশো টাকা দিয়ে দিলেন।
তখন দুপুর আড়াইটে বাজে। দরজায় ডোরবেল শুনে পুপুল অবাক। এখন আবার কে এল? দরজা খুলে ও দেখল অপরিচিত এক জন দাদা দাঁড়িয়ে আছে।
দাদাটি হেসে বলল, ‘পুপুল, আমার নাম ভবনাথ। ভবাদা বলতে পারো। অফিস থেকে তোমার বাবা আমাকে পাঠিয়েছেন। একটা সিনেমার টিকিট দিয়েছেন। আমার সঙ্গে যেতে পারবে?’ ‘‘হ্যারি পটার’-এর টিকিট? বাবা পাঠিয়েছেন? হু-র-রে, নিশ্চয়ই পারব।’’ ‘একটু তাড়াতাড়ি করবে ভাই। শো শুরু হয়ে যাবে।’ ‘বাবা যাবে না?’ পোশাক পরতে পরতে পুপুল জিজ্ঞেসা করল। ‘হ্যাঁ, যাবেন তো। স্যর সোজা হলে চলে যাবেন।’ পুপুল উৎসাহে টগবগ করে ফুটছে। দু’মিনিটেই সে রেডি।
ভবা বলল, ‘ঘরে চাবি দেবে না?’ ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভুলে গিয়েছিলাম। এই যে চাবি।’ চাবি হাতে করে বাইরে এসে জুতোয় পা গলাল পুপুল। চাবিও লাগাল তাড়াতাড়ি করে, তার পর বলল, ‘ভবাদা, তুমি এক কাজ করো। এই চাবিটা কেয়ারটেকারকে দিয়ে দাও। মা যদি আগে এসে যায়!’ ‘বেশ, তাই দিচ্ছি। কিন্তু স্যর বলেছিলেন, তোমাকে হল অবধি পৌঁছে দিতে।’ ‘কিচ্ছু পৌঁছে দিতে হবে না। আমি যে একাই যেতে পারি বাবাকে দেখিয়ে দেব।’ ভবনাথের থেকে সিনেমার টিকিটা নিয়ে পকেটে ভরল পুপুল। তার পর দুদ্দাড় করে সিঁড়ি ভাঙতে লাগল।
চার তলার ল্যান্ডিংয়ে লুকিয়ে বসেছিল গণু মানে গণেশ।
সে সুড়সুড় করে নেমে এসে ভবার সঙ্গে পুপুলদের ফ্ল্যাটে ঢুকে গেল।
ভেতর থেকে ছিটকিনি আটকেই গণু রান্নাঘরে ছুটল।
ভবা বলল, ‘ও দিকে কোথায় যাচ্ছিস?’ ‘আমি জানি, ওটা ডাইনিং টেবিলেই আছে।’ ‘বড্ড লোভী তুই গণা, আগে এ দিককার কাজ সারি। সময় নেওয়া চলবে না বেশি।’ ‘অনেক সময় আছে। আগে খেয়ে নিই চল।’
গণু মাংসের পাত্র ছুঁয়ে দেখল, ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। বলল, মাইক্রোটা কেমন সারালাম দেখি পরীক্ষা করে। যাই বলিস, মাংস ঠান্ডা খাওয়া যায় না।’
গণু মাইক্রো ভালই সারিয়েছে। ভাতও গরম হয়ে গেল এক মিনিটে।
হাপুস-হুপুস মাংস ভাত সাবাড় করতে গণু আর ভবার মিনিট পনেরো লাগল।
পেট এত ভরে গিয়েছে যে আর নড়তে পারছে না ওরা।
ঘরে এসে সোজা বিছানায় শুয়ে পড়ল দু’জনে।
নরম বিছানায় ডুবে যেতে যেতে দু’জনেই দু’জনকে সাবধান করল, ‘ঘুমোবি না।’ সন্ধের একটু আগে ভবা ধড়মড় করে উঠে পড়ল। ঠেলে তুলল গণাকে।
তার পর দ্রুত হাতে কাজ সারল ওরা।
বেরনোর আগে গণু ফোঁপাতে লাগল।
ভবা বলল, ‘কাঁদছিস কেন? কী ঝামেলা!’ ‘আমি যাব না। এখানেই থাকব। কাল আবার মাংস খাব। চুরি করতে চাই না।’ ‘চো-প। আবার মাংস খাবে? একখানা সিনেমার টিকিট দিয়ে অনেক কিছু পাওয়া গিয়েছে। আর চুরি করেছি কে বলল? আমরা ব্যবসা করেছি। ব্যবসার নিয়ম হল কম ইনভেস্টমেন্ট, বেশি লাভ। তাই না! একটা সিনেমার টিকিটের বদলে মাংস-ভাত, সোনার চেন, দুটো ঘড়ি, স্নিকার জুতো, হাজার তিনেক টাকা। খারাপ ব্যবসা হল?’ গণু মাথা নাড়ল।
তার পর দু’জনেই বেরিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ গণু বলল, ‘দাঁড়া। একটা সিনেমায় দেখেছিলাম, নায়ক চুরি করে যাওয়ার সময় আয়নায় লিখে গেছিল, ধন্যবাদ। আমিও একটা কথা লিখে যাই।’ ড্রেসিং টেবিল থেকে একটি লিপস্টিক তুলে গণু লিখল, ‘বউদি, মাংসটা হেব্বি হয়েছিল।’ |