প্রবন্ধ ১...
মামণি অ্যাসিড নাও
কোথায় যাচ্ছ মামণি? ইস্কুল?— বোরখার আড়াল সরিয়ে ফুটফুটে লাল-গোলাপি গোবলা গালের মেয়েটা যেই না মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলেছে, অমনি কোথা থেকে জানি উড়ে আসে দু-চার রাউন্ড স্প্রে। লাল-গোলাপি গালটায় ঝলসে ঝলসে নকশা তোলে মারণ অ্যাসিড, চোখ দুটো পুড়ে খাক হয়ে যায়, গালে হাত দিতেই লাল-গোলাপি চামড়া উঠে আসে ফর্সা হাতটায়, অসহ্য জ্বালাব্যথাযন্ত্রণা, ছটফটিয়ে বেঁকে যায় তুলতুলে শরীরটা, গা গুলিয়ে ওঠে, ভয়ে আর যন্ত্রণায় জ্ঞান হারানোর ঠিক আগে বোঝা যায় জীবনটা ফসকে ফসকে গড়িয়ে যাচ্ছে ঊষর, ধূসর, সিনেম্যাটিক আফগানিস্তানের এবড়োখেবড়ো ল্যান্ডস্কেপে।
মিশন অ্যাকমপ্লিশ্ড।
মেয়ে হয়ে স্কুলে যাচ্ছ, মাসুল তো দিতেই হবে। তালিবানি ফতোয়া মানবে না, স্কুলে যাবে, পড়াশোনার মতো পাপ করবে, প্রায়শ্চিত্ত কমপালসরি।
এ রকম গল্পের বয়স দু’দশক হয়ে গেল, আফগানিস্তানের মেয়েরা প্রায়শ্চিত্ত করেই চলেছে। কোথাও অল্প-বিস্তর, কোথাও বেশি-বিস্তর। গাঁ-গঞ্জের মেয়েদের স্বাধীনতা বলে কিস্যু ছিল না বড় একটা। কিন্তু শহুরে আফগান মেয়েরা পশ্চিমি ফ্যাশন থেকে জীবনযাত্রা— কিছুটা পেয়েছিল ১৯৩০-এর দশকে আমানুল্লা খান-এর জমানা থেকে। তার পর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবে আরও কিছুটা গতি পেয়েছিল এগিয়ে যাওয়ার। কিন্তু নব্বইয়ের দশক ছুঁতেই ছ্যাঁকা লাগল। সময় উল্টো দিকে হাঁটা লাগাল। ১৯৯৬ সেপ্টেম্বরে তালিবান শাসন জারি হল দেশে। শুরু হল সমাজ সাফ-সাফাই পর্ব। ৯/১১’র পরে তালিবানি জমানা শেষ হয়। কিন্তু অচিরেই তাদের দাপট আবার বাড়তে থাকে।
প্রেসিডেন্ট হয়ে হামিদ কারজাই মেয়েদের জন্য জানলাগুলো কিছুটা খুলে দিয়েছিলেন। নতুন সংবিধান অন্তত মেয়েদের সমান অধিকার মেনেছিল। কিন্তু তালিবানরা ক্রমশই দাঁতনখ বের করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, কারজাইয়ের হাঁটু মুড়ছে। গত মার্চে তিনি ধর্মীয় কাউন্সিলের এক ডিক্রিতে সই করেছেন, যেখানে লেখা রয়েছে, মেয়েরা গৌণ, পুরুষই আসল! মেয়েদের দুমড়েমুচড়ে রাখাই তালিবানদের উদ্দেশ্য। হবেই তো! সমাজের পবিত্রতা ধারণ করার বদলে জাহান্নমে ঠেলে দিচ্ছে এই মেয়েগুলো। বড় বাড় ওদের। অতএব আঁটুনি লাগাও বজ্র-মাফিক: খুউউব প্রয়োজন না থাকলে মেয়েরা বাড়ি থেকে বেরোবে না। বেরোলেও এক জন পুরুষ সঙ্গী থাকতে হবে। সব সময় ‘চাদ্রি’ পরতেই হবে, বোরখার নামে মাথাটুকু ঢাকলেই চলবে না। চাদ্রি— বড় চাদরের মতো একটা জিনিস, মাথা থেকে পা অবধি ঢেকে রাখে। ফতোয়া শুনে কাবুল, কান্দাহার, হেরাত-এর মেয়েরা তো থ। তারা এত দিন হেডস্কার্ফ পরেছে বটে, কিন্তু এ কী নিয়ম? আর মেয়েরা বাড়ি থেকে না বেরোলে তাদের লেখাপড়া, কাজকর্মের কী হবে? তাদের স্বাধীনতার কী হবে? স্বাধীনতা থাকবে না। এটাই তালিবানদের প্রোজেক্ট। মেয়েদের ধর্মকর্ম তিনটি: পুরুষকে যৌনতা দেওয়া, পুরুষকে সন্তান দেওয়া আর পুরুষের সেবা করা। আবার কী চাই?
অতএব, ইস্কুল যেতে চাও? এসো মামণি, অ্যাসিড-স্নান করো, কিংবা মাথায় গুলি খাও। বাচ্চা অসুস্থ হলেও পুরুষ-সঙ্গী ছাড়া তাকে ডাক্তারের কাছে বা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি নেই। মা বসে বসে সন্তানের মৃত্যু দেখতে পারে কিন্তু ওষুধ আনতে পারে না, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে পারে না। বাচ্চাটা না খেয়ে থাকতে পারে কিন্তু মা পাশের বাড়ির কাকাকে গলা বাড়িয়ে বলতে পারে না, দুটো রুটি এনে দেবে গো? বললে জেল হবে। কারণ পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলেছে, সে তো দুশ্চরিত্রা।
আর কোনও মেয়ে যদি বলে, জনাব, আমায় ওরা নৃশংস ধর্ষণ করেছে, তবে তাকে ভয়ানক মার খেতে হবে, জেলে যেতে হবে, নাক-কান কেটে নেওয়া হবে তার। কিংবা তত ক্ষণ সবাই মিলে পাথর ছুড়বে তাকে, যত ক্ষণ না প্রাণটা নিকেশ হয়।
প্রাণ দিয়েছে, জ্বালা সয়েছে, নাক-কান খুইয়েছে, কিন্তু থেমে থাকেনি, আফগান মেয়েরা এগিয়েছে। খুব অল্প অল্প করে, বোমার ধোঁয়া, গরিবির ধুলো সরিয়ে, বোরখায় মুখ ঢেকেই স্কুলের দিকে এগোচ্ছে শামসিয়ারা। সেই শামসিয়া, যার মুখে অ্যাসিড ছুড়েছিল তালিবান মাস্তানরা। কান্দাহারের মিরওয়াইস-এ ঘাঁটি গেড়ে বসেই ওরা পোস্টার সেঁটেছিল: বাড়ির মেয়েদের স্কুলে পাঠিয়ো না। শামসিয়া আর তার মা-বাবা অবাধ্যতার মাসুল দিয়েছে। ‘এখনও পড়তে গেলে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে’, মুখের পোড়া দাগে হাত বোলাতে বোলাতে বলেছিল শামসিয়া। ‘আমার মা-বাবা বলেছিল যদি আমরা মরেও যাই, তুমি স্কুল যাওয়া বন্ধ করবে না।’
আফগানিস্তানের শহরে যখন আধুনিকতার হাওয়া ছিল, তখন বহু শিক্ষিত, চাকুরে মেয়ে ছিল, তালিবানি দৌরাত্ম্যে যারা হঠাৎ গৃহবন্দি হয়। যে মেয়েরা কিছুটা লেখাপড়া শিখেছে, তারা অনেকেই চোরাগোপ্তা স্কুল খুলেছে। অনেক মেয়ে পড়তে যাচ্ছে সেখানে। নিজেদের একটা জীবন তৈরি করেছে তারা। খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে, নিজেদের কমিউনিটিতে চুটিয়ে বাঁচছে। বোরখা পরেই স্কুলে যাচ্ছে, কিন্তু বোরখার তলায় লুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে খাতা-বই, শিখে নিচ্ছে আত্মরক্ষার, নিজেদের উন্নত করার, তীক্ষ্ণ, তীব্র করার কলাকৌশল। তালিবান ভাবছে বোরখা পরিয়ে মেয়েদের বন্দি রেখেছে, আর মেয়েরা? বোরখার তলায় তৈরি করছে বিন্দু বিন্দু বিপ্লব, তীব্র অস্বীকার।
শাবানা বাসিজ রাসিখ কয়েক জনের সঙ্গে মিলে একটা স্কুল খুলেছে কাবুলে। স্কুল অব লিডারশিপ। শাবানা যখন ছয়, তালিবান এল ক্ষমতায়। স্কুল বন্ধ হল। সে আর তার দিদি চুপিচুপি যাওয়া শুরু করল একটা গোপন স্কুলে। কিন্তু দিদি তো একা একা বেরোতে পারবে না। তাই শাবানা সাজল ছোট্ট ছেলে। দিদিকে গার্ড দিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। ভয় হত, যদি কেউ জেনে ফেলে? তালিবানরা ফলো করছে না তো? এ ভাবেই লেখাপড়া করেছে ওরা। বাবা মা সাহস জুগিয়েছিলেন। সেই সাহসী মেয়েটাই বড় হয়ে তৈরি করেছে তার স্কুল।
মনে হতে পারে, এই তো বাঘের বাচ্চা সব, এগিয়ে যাও। কিন্তু ফের ব্রেকিং নিউজ— সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেহে দু’ডজন বুলেট। তালিবানরা দায় এড়িয়েছে। যে বধ্যভূমিতে সুস্মিতার প্রাণ গেল, তার দায় কে এড়াবে?
তালিবান উইল বি তালিবান। ইতিহাস ঢুঁড়ে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে, চরমপন্থীদের গায়ের ডোরা উবে গেছে? কিন্তু নদী যেমন পর্বতের কোলে ধাক্কা খেয়ে নতুন গতিপথ খুঁজে নেয়, আফগান মেয়েরাও তেমন নিয়েছে। যত অত্যাচার চলছে, মেয়েরা তত নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার রাস্তা খুঁজছে। ‘শোলে’ সিনেমায় একটা দারুণ ডায়লগ ছিল, ‘গব্বর সিং তুম অগর এক মারোগে তো হাম চার মারেঙ্গে’। আফগান মেয়েরা বলেছে— তোমরা একটা সুস্মিতাকে মারবে, আমরা চারটে শামসিয়া তৈরি করব।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.