প্রবন্ধ ২...
একটি নাটক ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ
ধ্যাহ্নেই অন্ধকার! ‘অন্ধকার’ শব্দটায় আপত্তি থাকবে অনেকের। কিন্তু ‘মধ্যাহ্ন’ অঙ্কের হিসেবেই সত্যি। পশ্চিমবঙ্গে বাম জমানা অস্তগমনের পরে কেটে যেতে চলল দু’বছর চার মাস। পরিবর্তনের এই মধ্যদিনে শহরের মঞ্চে নতুন নাটকে আর এক বাম জমানার গলিঘুঁজির অন্ধকারের গল্প। আর্থার কোয়েসলার-এর উপন্যাস ‘ডার্কনেস অ্যাট নুন’-এর নাট্যরূপান্তর ‘অস্তমিত মধ্যাহ্ন’ অভিনয় করছে ‘পঞ্চম বৈদিক’। নাট্যকার এবং পরিচালক—
একদা পরিবর্তনের সাংস্কৃতিক কাণ্ডারী, ‘সরকার-ঘনিষ্ঠ’ নাট্যকর্মী অর্পিতা ঘোষ।
কোয়েসলারের উপন্যাসের সঙ্গে আপাত ভাবে পশ্চিমবঙ্গের ‘পরিবর্তন’-এর কোনও সম্পর্ক নেই। জার্মান ভাষায় চল্লিশের দশকে প্রকাশিত উপন্যাস। এক পুরনো বলশেভিক রুবাশোভের গল্প। রাশিয়ায় পরিবর্তনে কিছুটা ভূমিকা ছিল তার। কিন্তু তার পরে স্তালিন-জমানায় জেলে যেতে হয় তাকে, পড়তে হয় অন্তর্ঘাতের দায়ে। তথাকথিত মস্কো ট্রায়ালের শিকার হয় সে। সুতরাং উপন্যাসটি আপাত ভাবে নিছক কমিউনিস্ট পার্টির অন্দরের গল্প। স্বাভাবিক ভাবেই, পরিবর্তনের পরের প্রথম বইমেলায় অর্পিতার অন্য দুটি বিতর্কিত রাজনৈতিক নাটকের (‘রাজনৈতিক হত্যা’ ও ‘পশুখামার’) সঙ্গে ‘অস্তমিত মধ্যাহ্ন’ যুক্ত করে প্রকাশিত হয়েছিল তিনটি রাজনৈতিক নাটক। সে বইয়ের অনুবাদকের কথা-য় নাট্যকার আগাম লিখেই রেখেছিলেন, ‘এই নাটকটি কমিউনিস্ট পার্টির গল্প, যেখানে অনেক বেশি করে তত্ত্ব উঠে এসেছে— উঠে এসেছে আত্মসমালোচনা—!’
হ্যাঁ, আত্মসমালোচনা তো বটেই। আর্থার কোয়েসলার ১৯৩১-এ কমিউনিস্ট পার্টি অব জার্মানিতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু স্তালিনের কর্মকাণ্ডে বীতশ্রদ্ধ হয়ে সাত বছরের মধ্যে দল ছেড়ে দেন। তার পরে প্যারিসে দেড় বছর ধরে লেখেন লেখেন ‘ডার্কনেস অ্যাট নুন’। উপন্যাসের ভূমিকায় কোয়েসলার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘এ বইয়ের চরিত্রগুলি কল্পিত। তাদের কার্যকলাপ নির্দিষ্ট করে দেয় যে ঐতিহাসিক পরিস্থিতি, সেটা বাস্তব।’
পশ্চিমবঙ্গের আর এক ঐতিহাসিক বাস্তবতায় সে জন্যই কি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিল কোয়েসলারের দেখা চরিত্রগুলি? উপন্যাস থেকে অর্পিতা যে নাট্যরূপ দিয়েছেন সেখানে প্রোটাগনিস্ট পার্টিজান নিকোলাস সলমনোভিচ রুবাশোভ বলছে, ‘‘খেটে খাওয়া মানুষ’ শব্দটা ‘আমরা’ থেকে বাদ দেওয়াই ভালো। তোমরা তাদের বোঝোনি, বোঝো না। বোধহয় আমিও আর বুঝি না। অথচ একদিন আমরা ওদের বুঝতে চেষ্টা করেছিলাম,... তাদের ভাবনার শরিক হতে পেরেছিলাম আর তাই আমরা আমাদের আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ইতিহাস গড়তে সক্ষম হয়েছিলাম— আর আজ তোমরা সব শেষ করে ফেলেছ!... আজ তোমরা শুধুই রাজনীতি করছ।” সক্রিয় পার্টিকর্মী ছিলেন রুবাশোভ। বীতশ্রদ্ধ হয়ে ছেড়ে দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টি। আর তার পরে পৃথিবীখ্যাত ওই উপন্যাসটি লেখেন। কমিউনিস্ট পার্টির এমন তাত্ত্বিক ময়নাতদন্ত বিশ্ব জুড়েই খুব কম হয়েছে।
কিন্তু সেটুকুতেই যদি থেমে যেতেন কোয়েসলার, হয়তো সে উপন্যাস নিছক আধুনিক পার্টিকর্মীর অবশ্যপাঠ্য হয়েই থাকত। হয়ে থাকত কেবল এক পার্টিকর্মীর উপন্যাস। তিনি থামেননি। গোটা উপন্যাসে কোথাও ‘রাশিয়া’ বা ‘ইউ এস এস আর’ লেখেননি। কেবল চরিত্রগুলির নাম দিয়েছিলেন রাশিয়ান ধাঁচে। দেশ-কালের সীমা ডিঙিয়ে এ ভাবেই তিনি ব্যক্তিমানুষের স্বাধীনতার কথা বলতে চেয়েছেন। জনসাধারণকে শুধু সংখ্যা হিসেবে দেখেননি, তার চরিত্র বুঝতে চেয়েছেন। তাই কি তাঁর উপন্যাসটির নাট্যরূপ অভিনয়ের প্রয়োজন হল ‘পরিবর্তিত’ পশ্চিমবঙ্গের মধ্যাহ্নে? সরাসরি প্রশ্নটায় অর্পিতা হাসলেন। বললেন, ‘‘নাটকটা কমিউনিস্ট পার্টিরই ভিতরে ঘুন ধরে যাওয়ার গল্প। গণতন্ত্রের পক্ষে যে বিশেষ দল এখন গলা ফাটান তাঁদের তত্ত্বগত অগণতান্ত্রিক চেহারাটা বিশ্লেষণ করতে চেয়েছি এই নাটকটার মধ্য দিয়ে। তবে হ্যাঁ, আমি এটাও বিশ্বাস করি, যে কোনও রাজনৈতিক দলই দীর্ঘ দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকলে ভিতরে ভিতরে পচে যেতে বাধ্য। তা সে যেই হোক না কেন। আসলে, গণতন্ত্রের কিছু সূক্ষ্ম জায়গা রীতিমতো লালনপালন করতে হয়। সেটা আমি মনে করিয়ে দিতে চেয়েছি।”
সংখ্যার গণতন্ত্রের বাইরের সেই সূক্ষ্ম জায়গাগুলো মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিল রুবাশোভও। নাটকে এক জায়গায় তার সংলাপে, ‘একজন গণিতজ্ঞ একবার বলেছিলেন অ্যালজেব্রা আসলে অলস লোকেদের বিজ্ঞানচর্চা— সেখানে X-কে কখনও ডিফাইন করা হয় না, সেটাকে স্থির ধরে নিয়ে বাকি অঙ্কটা কষা হয়... আমাদের ক্ষেত্রে X হচ্ছে জনসাধারণ— Mass. রাজনীতি করা মানে এই X অর্থাৎ জনসাধারণের চরিত্র না বুঝেই কার্য সমাধা করতে যাওয়া আর ইতিহাস গড়ার অর্থ এই X-এর চরিত্র যথাযথভাবে চিহ্নিত করে তাদের সঙ্গে নিয়ে পথ চলা।’ পরিবর্তনের মধ্যাহ্নেও কি রয়ে গেল না ওই X-ফ্যাক্টর? কোন দিক থেকে তাকে দেখবেন, নাট্যকারই জানেন। দর্শকরাও। ‘অনুবাদকের কথা’র ‘আত্মসমালোচনা’ শব্দটির পরের বিস্ময়চিহ্নে ছিল কি, সেই দেখার কোনও ইঙ্গিত?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.