বিখ্যাত কথা আছে, বিজ্ঞান আমাদের দিয়াছে বেগ, কাড়িয়া লইয়াছে আবেগ। আমরা লক্ষ করি না, বাক্যের মধ্যে নিহিত রহিয়াছে ‘বিজ্ঞান আমাদের বেগ দিয়াছে’। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির হাত ধরিয়া ইদানীং যে মহা ফুর্তির দ্বার আমাদের মুঠোর মধ্যে সাড়ম্বরে খুলিয়া গিয়াছে, তাহাকে বন্ধ রাখা অতিশয় দুষ্কর। এক বার বেগ চাপিলে যেমন তাহার পরিণতি এড়াইবার উপায় মানুষের নাই। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সংসদে দেখা যাইতেছে, অধিবেশন চলাকালীন মন্ত্রীরা তাঁহাদের স্মার্টফোন বা আইপ্যাডে খেলিতেছেন, অনলাইন দোকানের পসরা দেখিতেছেন, পর্নোগ্রাফি উপভোগ করিতেছেন। মার্কিন সেনেটর জন ম্যাকেন তাঁহার আইপ্যাডে পোকার খেলিতেছিলেন, তখন সংসদে সিরিয়ার উপর সামরিক আক্রমণ হানা উচিত হইবে কি না, সেই আলোচনা চলিতেছিল। ভারতীয় জনতা পার্টির তিন সদস্য, কর্নাটক সরকারের মন্ত্রী, গত বৎসর বিধানসভা অধিবেশন চলাকালীন ফোনে পর্নোগ্রাফি দেখিয়া ধরা পড়িয়াছিলেন, তাঁহারা পদত্যাগ করিতে বাধ্য হন। দেশে দেশে বহু সাংসদ নিজ যন্ত্রে কেহ তাস খেলিতেছেন, কেহ কার্টুন দেখিতেছেন, রাজ্যে গর্ভপাতের অধিকার লইয়া বিতর্ক চলিবার সময় কেহ মুক্তবক্ষ নারীদের ছবি অবলোকনে ব্যস্ত। মানুষ কাজের সময় ফাঁকি দিবে, এই সত্য নূতন নহে। শ্রেণিকক্ষে শেষ বেঞ্চিতে বসিয়া গল্পগ্রন্থ পাঠ বা টিফিন-ভক্ষণ প্রায় সর্বজনীন অভিজ্ঞতায় রহিয়াছে। পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্মচারিগণ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা ইহাই যে তাঁহারা কাজের তুলনায় ফাঁকি দেওয়ার প্রতি বহু গুণ মনোযোগ ব্যয় করিয়াছেন বহু যুগ ধরিয়া। |
কিন্তু জনপ্রতিনিধিগণ দেশের, এমনকী পৃথিবীর ইতিহাস গঠন বা পরিবর্তন সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সময় যদি নিজ বিনোদনে মগ্ন থাকেন, তবে বিশ্বের বিয়োগান্তক কাহিনিগুলিও প্রহসন রূপে প্রতীয়মান হইবে। যে কোনও ক্ষমতার সহিত কিছু দায়িত্বও অধিকারীর উপর একই মুহূর্তে ন্যস্ত হয়। অধিকাংশ মানুষ ক্ষমতাটি লইবার সময় দায়িত্বের এই গুরুভারখানি সম্পর্কে অবগত থাকেন না। আত্মতৃপ্তির স্রোতে স্বনিয়ন্ত্রণের গরজ সহজেই ভাসিয়া যায়। কিন্তু এই অসংযম কিছু ক্ষেত্রে চরম অপরাধের শামিল। আসাদ সরকার সত্যই মানবতার শত্রু কি না, তাহা যদি এক জন পোকার খেলিতে খেলিতে হুঁ-হাঁ করিয়া নির্ণয় করিতে ব্রতী হন, তাহা হইলে সেই দিন গৃহীত সিদ্ধান্তের বশে যে মানুষগুলির ভাগ্য বা জীবন চিরতরে নিভিয়া যাইবে, তাহাদের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রশ্নে তিনি কী উত্তর দিবেন? গর্ভপাতের ক্ষেত্রে নারীর আত্মসম্মানের সওয়াল এক জন কী করিয়া বুঝিবেন, যদি তিনি ওই মুহূর্তে নারীকে সামগ্রী রূপে ভোগের অন্যতর পন্থায় লিপ্ত হইয়া থাকেন? ফাঁকি সকলেই দেয়, কিন্তু মানবিকতাকে ফাঁকি দেওয়া অক্ষমণীয়। সংসদের আলোচনা শুষ্ক পণ্ডিতি নহে, এইগুলির ফলাফল লক্ষ মানুষের জীবনে প্রয়োগ হইবে। যে নেতা ‘অন্যমনস্কতা কী এমন অপরাধ’ মর্মে অজুহাত দিতেছেন, তাঁহার শল্যচিকিৎসাকালে বৈদ্য পর্নোগ্রাফি দেখিতে দেখিতে এলেবেলে ছুরি চালাইলে, তাঁহার প্রশ্রয়-সূত্র উড়িয়া যাইবে। তখন তিনি লঘু ও গুরুর পার্থক্য এবং নিজ ক্রিয়ার পরিণাম বিষয়ে সম্যক সচেতনতার তাৎপর্য বুঝিবেন। আসলে, রাজনীতি এখন অন্যতম পেশামাত্র। ক্রিকেট-স্কোরের দিকে তাকাইয়া সমগ্র দেশ উদ্বেলিত, কিন্তু বহু ক্রিকেটার টাকা লইয়া ইচ্ছাকৃত খারাপ খেলিতেছেন। উত্তরাখণ্ডে মানুষ চরম বিপর্যয়ে পড়িল, বিক্রেতাগণ জল ও খাদ্যের দাম বহু গুণ বর্ধিত করিয়া দিলেন, যাহাতে অন্যের কষ্টের মূলধনে নিজেদের লাভ বাড়াইতে পারেন। অসততা, দায়হীনতা যাপনের নিয়ম হইয়া দাঁড়াইয়াছে। সংসদও তো এই পৃথিবীর বাহিরে নহে। সেখানে নিযুক্ত কর্মিগণ চরিত্রে বা পরিণতমনস্কতায় অন্য সকল ক্ষেত্রের কর্মীদের তুলনায় অগ্রসর হইবেন, এই দাবিকে জনগণভাগ্যবিধাতাগণ জুলুম বলিয়া মনে করেন। ফাঁকিবাজির সাম্যে তাঁহাদের বিশ্বাস অটুট। |