লোকসান সয়েই লজের বোঝা বইবে পর্যটন
খোদ মন্ত্রীও মানেন যে, ট্যুরিস্ট লজ চালানো সরকারের কাজ নয়। তবু আর্থিক ক্ষতি সয়েও আগের নীতি থেকে বেরিয়ে এসে নতুন পথে হাঁটার সাহস দেখাতে পারল না পশ্চিমবঙ্গের পরিবর্তনের সরকার। কর্তা-কর্মীদের একাংশের বিরোধিতায় উদ্যোগ গোড়ায় হোঁচট খেল।
রাজ্যের কোষাগারে এমনিতেই হাঁড়ির হাল। অর্থাভাবে উন্নয়নের কাজও আটকে যাচ্ছে। এ অবস্থায় লোকসানে চলা ট্যুরিস্ট লজ বেসরকারি হাতে ছেড়ে দিয়ে দায়মুক্ত হওয়ার সুযোগ ছিল। সেই মতো পরিকল্পনা ছকেও শেষমেশ বাতিল করে সরকার ঠিক করেছে, নিজেরাই লজগুলি চালিয়ে যাবে। শুধু তা-ই নয়, ভবিষ্যতে লাভের মুখ দেখার আশায় পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্নয়ন নিগম (ডব্লিউবিটিডিসি) ‘লোকসানের’ দু’টি লজে নতুন করে মোট ৭০ লক্ষ টাকা বিনিয়োগও করতে চলেছে, যার বাস্তবতা ঘিরে ইতিমধ্যে দানা বেঁধেছে সংশয়।
৬ অগস্ট রাজ্যের পর্যটনমন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী ঘোষণা করেছিলেন, তাঁরা লোকসানের ট্যুরিস্ট লজকে চুক্তির ভিত্তিতে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার কথা ভাবছেন। ক্রমাগত লোকসান করছে, এমন চারটি লজ চিহ্নিত করে সেগুলো বেসরকারি পরিচালনায় ছাড়ার জন্য টেন্ডার ডাকার তোড়জোড়ও শুরু হয়। মন্ত্রী তো বটেই, আমলাদের একাংশও তখন আশা প্রকাশ করেছিলেন যে, ধীরে ধীরে সব ক’টি লজই বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া যাবে।
শেষ পর্যন্ত কর্মীদের বড় অংশের বাধা এবং নিগম-কর্তাদের একাংশের আপত্তিতে দফতর এই লক্ষ্যে দু’পা এগিয়েও চার পা পিছিয়ে এসেছে। পরিচালনার সার্বিক দায়িত্বের পরিবর্তে আপাতত কয়েকটি লজে শুধু খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার মতো কিছু দৈনন্দিন কাজ (হাউস-কিপিং) বেসরকারি সংস্থাকে ছাড়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কৃষ্ণেন্দুবাবুর কথায়, “কয়েকটি ট্যুরিস্ট লজের বার-রেস্তোরাঁ চালানো এবং হাউসকিপিংয়ের দায়িত্ব চুক্তির ভিত্তিতে বেসরকারি হাতে দিচ্ছি। ভবিষ্যতে আরও কয়েকটি লজে তা বলবৎ হবে।” পর্যটন উন্নয়ন নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ভীষ্মদেব দাশগুপ্ত বলেন, “ট্যুরিস্ট লজ আমরাই চালাব। ব্যবস্থা নিচ্ছি, যাতে লোকসান কমিয়ে লাভের মুখ দেখা যায়।”

ডুয়ার্সের মূর্তি নদীর ধারে পর্যটন দফতরের কটেজ। —নিজস্ব চিত্র।
এই মুহূর্তে নিগমের অধীনে ২৮টি লজ। তার মধ্যে শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, রায়গঞ্জ ও মালবাজার বছরের পর বছর লোকসান করে যাচ্ছে। ২০১১-১২ অর্থবর্ষে চারটিতে মিলিত ক্ষতির অঙ্কটা ছিল প্রায় ৬৯ লক্ষ টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবর্ষে ৮৫ লক্ষ। অর্থাৎ, এক বছরে ক্ষতি বেড়েছে ১৬ লক্ষ টাকা। পর্যটন-সূত্রের খবর: লোকসানের বহর সর্বাধিক শিলিগুড়ির ‘মৈনাক’ লজে গত দুই অর্থবর্ষে যথাক্রমে ৩১ লক্ষ ও ২৯ লক্ষ টাকা। আর্থিক হাল এতটা নড়বড়ে হওয়া সত্ত্বেও এটি সরকার নিজের হাতেই রাখতে চায়। ছাড়া হচ্ছে শুধু রেস্তোরাঁ ও হাউস-কিপিংয়ের ভার। “শিলিগুড়ির মৈনাকে বার ও রেস্তোরাঁ চালানো এবং হাউস-কিপিংয়ের দায়িত্ব চুক্তির ভিত্তিতে বেসরকারি সংস্থাকে দিচ্ছি। চালসার কাছে মূর্তি নদীর ধারে নতুন ২৬টি কটেজেও তা-ই হচ্ছে।” বলেন এমডি ভীষ্মদেববাবু।
বিনিময়ে সংস্থাগুলো বছর শেষে নিগমকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দেবে বলে জানান এমডি। কিন্তু রেস্তোরাঁ-বার বা হাউসকিপিংয়ের কাজের জন্য বর্তমানে ওই সব লজে যে সব কর্মী আছেন, তাঁদের কী হবে? নিগম-সূত্রের খবর: অধিকাংশকে মূর্তির নয়া কটেজে সরানো হবে। নিগমের এক কর্তার দাবি, “এমনিতেই আমাদের লজগুলোয় কর্মীর অভাব। অনুমোদিত মোট পদ যেখানে পাঁচশো, সেখানে আছেন শ’তিনেক। ফলে বেসরকারি সংস্থা এলেও কর্মীরা চাকরি হারাবেন না। বড়জোর অন্যত্র বদলি হবেন।” কিন্তু ক’জন রাজি হবেন, এবং তার জেরে ‘আংশিক বেসরকারিকরণের’ উদ্যোগ থমকে যাবে কি না, সংশয় রয়েছে নিগমেরই অন্দরে। একই ভাবে জলপাইগুড়ির তিস্তা পর্যটক আবাস ও রায়গঞ্জ ট্যুরিস্ট লজে লোকসান মোকাবিলায় ৭০ লক্ষ টাকা নতুন লগ্নির সিদ্ধান্ত ঘিরেও সংশয় জেগেছে। রায়গঞ্জ লজে তৈরি হচ্ছে ব্যাঙ্কোয়েট হল, বাচ্চাদের খেলার পার্ক, সুইমিং পুল, ওয়াটার পার্ক। ট্যুরিজম ইনফরমেশন সেন্টার ও ডরমিটরি গড়ে উঠছে তিস্তা পর্যটক আবাসে। এ সবের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নিগম-কর্মীদের একাংশ। কী রকম?
ওঁদের বক্তব্য: শহুরে অবস্থানের সুবাদে তিস্তা পর্যটক আবাস কখনওই পর্যটক আকর্ষণের অনুকূল হয়নি। আবার রায়গঞ্জ লজ কুলিক পক্ষীনিবাসে হলেও প্রচারের অভাবে পর্যটকের আনাগোনা কম। এই পরিস্থিতিতে ওখানে ব্যাঙ্কোয়েট, সুইমিং পুল বা ডরমিটরি গড়ার যুক্তি ওঁরা খুঁজে পাচ্ছেন না। জলদাপাড়া ট্যুরিস্ট লজে ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ প্রকল্পের ব্যর্থতার উল্লেখও করেছেন অনেকে। “এক কোটি টাকা খরচ করে চালু হয়েছিল। স্রেফ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বন্ধ করে দিতে হল!” আক্ষেপ এক পর্যটন-অফিসারের।
সত্তরের দশকে রাজ্য পর্যটন উন্নয়ন নিগম পত্তনের পিছনে মূল লক্ষ্য ছিল নিত্য নতুন জায়গায় ট্যুরিস্ট লজ তৈরি করা, যাতে তাকে ঘিরে পর্যটন-পরিকাঠামোর বিকাশ ঘটতে পারে, এলাকায় উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হয়। বিগত ক’দশক জুড়ে নিগম সেই ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করছেন সরকারি কর্তাদের অনেকে। এ বার ভূমিকা পরিবর্তনের সময় এসেছে কিনা, সেই প্রশ্নে বিতর্ক চলছে কর্মী-অফিসারদের মধ্যে। একাংশের অভিমত, এখন সর্বত্র পর্যটন শিল্পে বেসরকারি উদ্যোগের রমরমা। এই সুযোগে ট্যুরিস্ট লজের বোঝা ঝেড়ে নিগমকে অন্য লাভজনক কাজে নিয়োজিত করা উচিত। অপর অংশের যুক্তি: কেরল, অন্ধ্র বা রাজস্থানে রাজ্য পর্যটন উন্নয়ন নিগমের ট্যুরিস্ট লজ থেকে সরকারের বিপুল আয় হয়। পশ্চিমবঙ্গে কেন হবে না?
শান্তিনিকেতন, জলদাপাড়া, দার্জিলিঙের মতো লাভজনক ট্যুরিস্ট লজের দৃষ্টান্ত দিচ্ছে এই মহল। যার পাল্টা হিসেবে এক কর্তা প্রশ্ন তোলেন, “নিগম ‘রূপসী বাংলা’র স্লেগান দিচ্ছে। অথচ দেশি-বিদেশি পর্যটক টানতে যে রূপ থাকা দরকার, হাতে গোনা কয়েকটাকে বাদ দিলে অন্যান্য লজের তা আছে কি?”
রূপ-পরিষেবার যুগপৎ আকর্ষণ ফেরাতে হলে লোকসানের লজ বেসরকারি হাতে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই বলে মনে করছেন ওঁরা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.