বড়োল্যান্ড আঞ্চলিক পরিষদকে আরও স্বায়ত্তশাসন দিবার সিদ্ধান্ত হইয়াছে। কেন্দ্রীয় সরকার, অসম সরকার এবং বড়ো পরিষদের মধ্যে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে স্থির হইয়াছে, স্বরাষ্ট্র (পুলিশ প্রশাসন) ও অর্থ দফতর রাজ্য সরকার পরিষদের হাতে ছাড়িয়া দিবে, যাহাতে পরিষদের পক্ষে যথার্থ স্বশাসন অনুশীলন সহজ হয়। জনজাতীয় আত্মপরিচয়ের সমস্যাটিকে আত্মশাসনের যুক্তরাষ্ট্রীয় ক্ষমতাবিন্যাস দিয়াই সমাধান করা যায়। সে জন্যই দেশের বিভিন্ন অনগ্রসর জনজাতি-অধ্যুষিত অঞ্চলে স্বশাসিত পরিষদ গঠনের বন্দোবস্তটি প্রণয়ন করা হইয়াছিল। ত্রিপুরায়, অসমে, পার্বত্য দার্জিলিঙে স্বশাসিত পরিষদই হিংসা, রক্তপাত, বিদ্বেষ ও জাতিবৈরর অবসান ঘটাইয়া জনজাতিগুলির সহিত অ-জনজাতীয়দের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পটভূমি রচনা করে। বড়োল্যান্ড পরিষদ যেমন বড়ো লিবারেশন টাইগারদের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাস ও রক্তক্ষয়কে নিয়ন্ত্রণ করিয়াছে।
কিন্তু তেলঙ্গানাকে পৃথক রাজ্যের মর্যাদা দিবার সিদ্ধান্ত দেশের নানা স্থানে ছড়াইয়া থাকা জনজাতীয় স্বশাসনের এলাকাগুলিতে বর্ধিত স্বাধিকারের দাবি নূতন অশান্তি সৃষ্টি করিয়াছে। মুখে এই সকল স্বশাসিত পরিষদই তেলঙ্গানার মতো পৃথক রাজ্যের দাবি তুলিলেও সেই দাবি আসলে দর-কষাকষির আয়ুধ— প্রকৃতপক্ষে তাহারা স্বায়ত্তশাসনের সীমান্ত প্রসারিত করিতেই ব্যগ্র। নহিলে বড়ো জনজাতির প্রতিনিধিত্বকারী বিভিন্ন সংগঠন তেলঙ্গানা-উত্তর পর্বে যে তুমুল আন্দোলন শুরু করিয়াছিল, তাহা এত সহজে প্রশমিত হইত না। ঘটনা ইহাই যে, দেশে অধিকাংশ স্বশাসিত পরিষদই যথার্থ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে না। কারণ: ক্ষমতার কেন্দ্রাভিগ কাঠামোর প্রতি দুর্মর আকর্ষণে অভ্যস্ত ভারতীয় শাসকরা বিকেন্দ্রীকরণে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। রাজ্যগুলির হাতে তাহাদের প্রাপ্য ক্ষমতা ও তহবিল বিকেন্দ্রীভূত করিতে যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের আপত্তি, রাজ্যগুলির সরকারও সহসা আঞ্চলিক পরিষদগুলির হাতে প্রাপ্য ক্ষমতা অর্পণ করিতে চাহে না। সর্বদাই রাজ্য সরকারের নিয়ামকদের ভাবনা থাকে, পরিষদের কতটা ক্ষমতা নিজেদের হাতে রাখিয়া দেওয়া যায়। পরিষদ যেন রাজ্যের সরকারের উপর পদে-পদে নির্ভরশীল হইয়া থাকে। এই ভাবনা কিন্তু স্বায়ত্তশাসনের ধারণাটিকেই নস্যাৎ করিয়া দেয়।
এই কারণেই অধিকাংশ স্বশাসিত পরিষদ সফল হয় নাই। প্রায়শ রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণের বজ্র-আঁটুনি তাহাদের স্বাধীন ভাবে কাজ করার পথে অন্তরায় হইয়াছে, ফলে স্বশাসনের সীমা প্রসারিত করার অর্থাৎ আরও ক্ষমতা ও অর্থ পরিষদকে অর্পণের দাবিতে নূতন অশান্তির আগুন জ্বলিয়াছে। দৃষ্টান্ত: বড়োল্যান্ড এবং গোর্খাল্যান্ড। বড়োল্যান্ডের জনজাতীয়দের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে যে সূত্র প্রণীত হইয়াছে, তাহা অন্যত্রও প্রয়োগ করা যায় কি না, ভাবা যাইতে পারে। স্বরাষ্ট্র এবং অর্থএই দুইটি দফতরই যে প্রশাসন চালাইবার পক্ষে সর্বাধিক জরুরি, তাহাতে সন্দেহ নাই। এগুলি স্বশাসিত পরিষদের হাতে তুলিয়া না দেওয়ার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ নাই। মূল স্রোতের রাজনীতিকরা যদি সত্য সত্যই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আত্মশাসনের আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করিতে আন্তরিক হন, তবে এই দুইটি দফতর কেন তাঁহারা রাজ্যের হাতে রাখিয়া দিতে চাহিবেন, বোঝা দুষ্কর। হাজার হউক, একটি অক্ষম পরিষদ কোনও জনগোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসনের অভীপ্সাকে পূরণ করিতে পারে না। |