|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
ফুটে উঠেছে মানবী অস্তিত্বের আরও এক বিপন্নতা |
অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত হল ‘পার্সপেক্টিভ’ শীর্ষক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ |
অনেকেই মনে করছেন কলকাতায় চিত্রকলার আবহমণ্ডল এখন খুব ভাল নেই। কেননা বাজার ভাল নেই। তাই অনেক গ্যালারিই স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে। উৎসাহে ভাঁটা পড়ছে বাজার-নির্ভর অনেক শিল্পীরও। শুধু ভালবাসার টানে অনেক শিল্পী কাজ করছেন। ‘পার্সপেক্টিভ’ শিরোনামে এ রকমই সম্মেলক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল সম্প্রতি অ্যাকাডেমিতে। ছ’জন শিল্পী অংশ নিয়েছেন। তাঁদের এক জন ভাস্কর। প্রত্যেকেই স্বভাবতই স্বতন্ত্র। আপাত ভাবে মনে হয় কোনও কেন্দ্রীয় ঐক্য নেই তাঁদের কাজে। কিন্তু একটু গভীরে গেলে বোঝা যায়, প্রবহমান জীবনের প্রচ্ছন্ন সমালোচনা রয়েছে তাঁদের অনেকেরই কাজে। রয়েছে প্রতিবাদী চেতনা এবং আদর্শ জীবনের স্বপ্ন। তন্নিষ্ঠ দায়বোধই তাঁদের সম্মিলিত উপস্থাপনাকে তাৎপর্যপূর্ণ করেছে।
এঁদের মধ্যে ইন্দিরা হালদারের অবস্থান একটু স্বতন্ত্র। কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া কেবল ভালবাসার টানে তিনি এসেছিলেন ছবির জগতে। কার্তিক চন্দ্র পাইনের কাছে এক সময় ছবির প্রকরণ শিখেছেন। ২০০০ সালে তাঁর প্রথম এককে স্নিগ্ধ যে কল্পরূপের প্রকাশ ছিল, ধীরে ধীরে তা মগ্ন জীবনবোধে পরিশীলিত হতে থেকেছে। ইতিমধ্যে ব্যক্তিগত জীবনে কঠিন এক শারীরিক অসুস্থতার সঙ্গে নিরন্তর সংগ্রাম তাঁর ছবিতেও প্রত্যয়ী এক প্রতিবাদী চেতনা এনেছে। এই প্রদর্শনীতে অন্তর্ভুক্ত তাঁর সাতটি ছবি তাঁর আত্মপ্রত্যয়ের দৃষ্টান্ত। ছ’টি ছবি অ্যাক্রিলিকে আঁকা, একটি জলরঙে। আজকের জীবনে নারীর বিপন্নতা তাঁর অধিকাংশ ছবির বিষয়। ‘নেকেড শেম বিফোর উইটি ওয়াইল্ডলি ড্রেসড’ ছবিতে দণ্ডায়মান ওরকমই বিপন্ন ছ’টি মানবী। একটি ব্যাঙ লাফিয়ে যাচ্ছে তাদের সামনে দিয়ে। মানবী অস্তিত্বের এই নিঃসীম বিপন্নতাকেই তিনি নানা ভাবে অভিব্যক্ত করেছেন তাঁর অন্যান্য ছবিতে। |
|
শিল্পী: ইন্দিরা হালদার
|
দিলীপ দাস ১৯৮০-র দশক থেকে নিয়মিত কাজ করছেন। দেশে বিদেশে অজস্র প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে জলরঙের নিসর্গ রচনায় মূর্ত-বিমূর্তের সম্মিলনে স্বকীয় এক রূপভঙ্গি তৈরি করেছেন। নদীর জলে প্রতিফলিত আলো-ছায়ার দ্বৈতের ভিতর দিয়ে চেতনারই নিবিষ্ট ধ্যানমগ্নতার প্রতীক নির্মাণ তাঁর এ বারের ছ’টি ছবিরও বৈশিষ্ট্য।
অনিলকুমার যাদব একবিংশ শতকের উদীয়মান তরুণ শিল্পী। বিড়লা অ্যাকাডেমিতে ছবি আঁকা শিখেছেন। এই প্রদর্শনীর আটটি ছবিতে তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন আজকের উন্নয়ন বা অগ্রগতির সারবত্তা নিয়ে। ‘পাথ অব প্রগ্রেস’ চিত্রমালার কয়েকটি ছবিতে মহাত্মা গাঁধীর প্রতিমাকল্প ব্যবহার করেছেন। বিন্যস্ত করেছেন ডাকটিকিটের জ্যামিতিক মোজাইক। পরিশীলিত আঙ্গিকের দিকে যেতে তাঁর আরও নিমগ্ন অনুশীলন প্রয়োজন।
পরেশ সাহা জলরঙের ছ’টি ছবিতে এঁকেছেন জলাশয়ে প্রস্ফুটিত শাপলা ও শালুক ফুল। স্বাভাবিকতাবাদী রূপরীতিতে তাঁর দক্ষতা অনস্বীকার্য। কিন্তু ছবি তো আরও গভীরের বার্তা তুলে আনতে চায়, যেমন আমরা দেখেছি প্রথম দুই শিল্পীর রূপায়ণের ক্ষেত্রে। আরও চর্চার মধ্য দিয়ে পরেশ হয়তো সেই গভীরকে ছুঁতে পারবেন।
পাভেল বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর পাঁচটি অ্যাক্রিলিকের ক্যানভাসে আরও সংকীর্ণ এক পরিসর নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর ছবির প্রধান বিষয় নগ্ন মানবী বা মানবীর নগ্নতা। অনুপুঙ্খ স্বাভাবিকতার সঙ্গে একটু প্রতিচ্ছায়াবাদী সরলীকরণ মিলিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন তাঁর আঙ্গিক। কিন্তু কেবল নারীর শরীরকে এ ভাবে প্রকট করে তোলা সামগ্রিক মানবীচেতনার প্রতিই অসম্মান। সেই অবমাননা থেকে তিনি নারীকে মুক্ত করুন, এই তাঁর কাছে প্রার্থনা। সুবীর কুমার মণ্ডল রবীন্দ্রভারতী থেকে ২০০২-এ ভাস্কর্যের স্নাতক। নানা আঙ্গিকে তিনি ১৪টি কাজ করেছেন এই প্রদর্শনীতে। এই বহুমুখী বিস্তৃত সন্ধান তাঁর রচনায় বিশেষ তাৎপর্য এনেছে। কাঠ ও ধাতু মিলিয়ে বাবুই পাখির বাসার আদলে গড়া রচনাটিতে ঐতিহ্যগত আঙ্গিকের সন্ধান তাঁর রচনার একটি বৈশিষ্ট্য। ‘পোলো’ শিরোনামে মাছ ধরার জালের প্রতিমাকল্পটিও এদিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ। ‘নেস্ট’ শীর্ষক এনামেল রং করা ধাতব রচনাটিও রূপাবয়ব নিয়ে তাঁর নিজস্ব নিরীক্ষার দৃষ্টান্ত। কিন্তু কাঠের একটি পাখি বা কাঠ ও ধাতুতে তৈরি অনামা একটি মুখাবয়বে তাঁর রূপারোপ যান্ত্রিক জ্যামিতিকতায় সীমিত হয়ে গেছে। |
|