একশো বছরের পুরনো জীর্ণ ভবনে ছোট্ট একটা ঘর। এক টুকরো সাদা কাগজে খসখস করে নিদান লিখে দিচ্ছেন ডাক্তারবাবু। আসলে তিনি ফার্মাসিস্ট। আর যিনি প্রেসক্রিপশন দেখে ওষুধ দিচ্ছেন, তিনি চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র নয়, তমলুক শহরে খোদ পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সদর হাসপাতালের একটি বহির্বিভাগের নিত্য দিনের ছবি এটা। চিকিৎসক ও নার্স ছাড়াই চিকিৎসা চলছে খোদ জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের অফিসের পাশে। মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক স্বপন ঝরিয়াতের অবশ্য বক্তব্য, “ফার্মাসিস্টরা ওখানে শুধুমাত্র প্রাথমিক চিকিৎসা করেন। ফলে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না।”
তমলুক শহরের পুরসভা অফিসের সামনে ও তমলুক-পাঁশকুড়া বাসস্ট্যান্ডের ঠিক পাশেই এক ব্যক্তির দান করা জমিতে ১৮৯৭ সালে চালু হয়েছিল অবিভক্ত তমলুক মহকুমার সদর হাসপাতাল। পরবর্তী সময়ে মহকুমা হাসপাতাল স্থানান্তরিত হয়েছে তমলুক শহরের ধারিন্দায় হলদিয়া-মেচেদা রাজ্য সড়কের ধারে। ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি জেলা ভাগের পর তা জেলা সদর হাসপাতালে উন্নীত হয়েছে। এ দিকে পুরনো হাসপাতালের মূল ভবনে এখন চলছে জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের অফিস। কিন্তু দান করা ওই জমির শর্ত ছিল জনস্বার্থেই ব্যবহার করতে হবে। ফলে পুরনো হাসপাতাল ভবনের একাংশে বহির্বিভাগ চালু রাখতে হয়েছে। |
শহরের মানিকতলা, লালদিঘি, স্টিমারঘাট, আবাসবাড়ি, উত্তরচড়া শঙ্করআড়া ছাড়াও আশপাশের ধলহরা, চন্দ্রামেড়, নারায়ণদাড়ি প্রভৃতি গ্রামের বাসিন্দারা এখানে আসেন প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য। আগে জেলা হাসপাতাল থেকে নিয়মিত চিকিৎসক, নার্স, ফার্মাসিস্ট ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরা আসতেন বহির্বিভাগে। কিন্তু দু’বছরের বেশি হল চিকিৎসক, নার্সরা আর আসেন না। এখন রবিবার ছাড়া বাকি ছ’দিন জেলা সদর হাসপাতাল থেকে পালা করে মাত্র একজন ফার্মাসিস্ট ও একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মী আসেন রোগী দেখতে। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত রোগীদের দেখে ফের জেলা হাসপাতালে গিয়ে কাজ করতে হয় তাঁদের। রোগী দেখতে এসে ফার্মাসিস্ট প্রশান্ত ঘড়া মেনে নেন, ‘‘এটা আমাদের কাজ নয়। চিকিৎসকের অভাবে করতে হচ্ছে।” মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক বলেন, “মহকুমা হাসপাতাল থেকে জেলা সদর হাসপাতালে উন্নীত হলেও প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিসক ও কর্মী নেই এখানে। ফলে ওই বহির্বিভাগে চিকিৎসক দেওয়া যাচ্ছে না।”
একশো বছরের বেশি পুরনো এই হাসপাতাল ভবনটির অবস্থাও খুবই খারাপ। মাত্র একটি ঘর বরাদ্দ বহির্বিভাগের জন্য। দীর্ঘ দিন সংস্কারের অভাবে সেই বাড়ির দেওয়াল, ছাদ ফেটে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। বৃষ্টি হলেই ফাটা ছাদ চুইয়ে জল পড়ে। ভিতরে ভাঙাচোরা আলমারি, টেবিলযেন ভূতুড়ে বাড়ি। নেই রোগী পরীক্ষার যন্ত্রপাতি, ওষুধ রাখার জন্য রেফ্রিজারেটার, এমনকী শৌচাগার।
চিকিৎসক ও পরিকাঠামোর এই নিদারুণ অবস্থা সত্ত্বেও রোগীর কমতি নেই। স্বাস্থ্য দফতরের হিসাব অনুযায়ী চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই বহির্বিভাগে ৫৭০০ জন রোগী এসেছেন চিকিৎসার জন্য। মূলত জ্বর, সর্দি-কাশি, মাথার যন্ত্রণা, পেটের অসুখ নিয়ে। আগে যখন চিকিৎসক আসতেন, তখন প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ জন রোগী আসতেন। এখন চিকিৎসক না আসায় রোগী কমে গিয়েছে। শহরের ইন্দিরা কলোনির বাসিন্দা শেখ হাসমত বলেন, “ডাক্তারবাবু কেন আসেন না বুঝতে পারছি না। যিনি আসেন, ওষুধ দেন বটে। তবে, ডাক্তারবাবু এলে একটু ভরসা পেতাম।” |