প্রবন্ধ...
গ্রামসমাজ বাঁচতে চায়, সম্মানের সঙ্গে
সে স্বভাবত মৃদুকণ্ঠ নয়। কিন্তু হত্যার অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে সরকারি হোমে বন্দিদশায় বিহ্বল। বীরভূমের বাঁধ নবগ্রামে তার বাড়ি। পঞ্চায়েতি ‘রাজ’ প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় শাসক তৃণমূল দলেরই দ্বিপাক্ষিক ক্ষমতা দখলের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় খুন হলেন স্থানীয় নেতা, আর সেই অভিযোগে আরও অনেকের সঙ্গে গ্রেফতার হল দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রটি। আঠারো বছরের কম বয়সি বলেই তার জায়গা হল বহরমপুরের ‘আনন্দ আশ্রম’ হোমে, আইনভঙ্গকারী কিশোরদের সঙ্গে, যাদের কেতাবি নাম জুভেনাইল ইন কনফ্লিক্ট উইথ ল’। অস্ফুট কণ্ঠেও ঝরে পড়ছিল আত্মবিশ্বাস: জামিনে ছাড়া পেয়েই সে পড়াশুনো করতে লেগে যাবে পুরো দমে, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার দেরি নেই।
এই ছাত্রটি যেন পশ্চিমবঙ্গের সেই গ্রামীণ আওয়ামেরই এক রূপ, যে উলুখাগড়ারা ‘রাজ’ প্রতিষ্ঠার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পিষ্ট হয়, প্রাণ দেয়, আতঙ্কে রাত কাটায়, দিন কাটায় এবং প্রতিষ্ঠিত ‘রাজ’ কর্তৃক অবহেলিত হয়, অথচ নিরাশ হওয়ার উপায় তার থাকে না। তাদেরও সামনে পরীক্ষা— তারাও নিজের মতো করে ক্ষমতার অংশভাক্ হতে চায়, গণতন্ত্রের অনুশীলনে ভোটকেন্দ্রিক ব্যবস্থার যাবৎ সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও তারা এর প্রয়োগকে অধিকার প্রসারের একটা সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। এ অধিকার শুধুমাত্র বিকেন্দ্রীকৃত ক্ষমতার বণ্টনের সঙ্গেই যুক্ত, এমন নয়। এটা সামাজিক গতিপ্রকৃতি বিষয়ে মানুষের যুক্তিপ্রয়োগের এক স্বরূপ, যা প্রণিধানের দাবি রাখে।
সদ্য সমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও ফলাফল থকে আওয়ামের যুক্তিপ্রয়োগের কয়েকটি সুস্পষ্ট ধারা উঠে আসে। প্রথম ধারাটি হল, বহু বিভিন্ন ধারার সমাহার, রাজ্যের প্রান্তবিশেষে ভোটের প্রক্রিয়া ও ফলাফলের চারিত্র-ভিন্নতা। এই বৈশিষ্ট্যেই রাজ্যের কিছু অঞ্চলে, বিশেষত কৃষি-উদ্বৃত্ত সমৃদ্ধ মধ্যবঙ্গে, ভোটই হল না, বর্তমান শাসক দলের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই জিতে গেলেন গোটা পঞ্চায়েত সমিতি। এগুলো আবার ঠিক সেই সব জায়গা, যেখানে বিগত নির্বাচনগুলোতে তৎকালীন শাসকদল সম্পূর্ণ অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। একদলীয় আধিপত্যর এই বৈশিষ্ট্যটির পিছনে নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক শর্ত আছে, যা সমীক্ষা ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

শুধু ভোট নয়, আত্মমর্যাদা। পঞ্চায়েত নির্বাচন ২০১৩। মুর্শিদাবাদ। ছবি: সুদীপ আচার্য
আসলে গোটা এলাকাটাই আনুগত্য বদল করে সিপিএম থেকে তৃণমূল হল, না কি যে গ্রামীণ উদ্বৃত্ত স্থানীয় সিপিএমকে পরিচালিত করে এসেছে, তা-ই এখন স্থানীয় তৃণমূলের চালিকাশক্তি হয়ে উঠল, তা স্পষ্ট নয়। কিন্তু যেটা খুবই স্পষ্ট, তা হল, একাধিপত্য নিজেই তার বৃহত্তম শত্রু: যেখানে যেখানে সিপিএম-এর নিরঙ্কুশ দখল ছিল, সেখানে সেখানেই দলটি প্রায় উচ্ছিন্ন। আবার এটাও স্পষ্ট যে, বিরোধী পরিসরই গণতন্ত্রের প্রাণবায়ু: যে সব জায়গায় বিরোধী রাজনীতির অস্তিত্ব থেকে এসেছে, সেখানে প্রবল তৃণমূল ঝড়ের মুখেও সিপিএম নিজেকে উপস্থিত রাখতে পেরেছে। উদাহরণ, জঙ্গলমহল, যেখানে গত পাঁচ বছরে সিপিএম-এর বহু কর্মী-সমর্থক খুন হয়েছেন, ঘরছাড়া হয়েছেন। কিন্তু, তা সত্ত্বেও দলটা প্রার্থী দিতে পেরেছে, যেটা তারা গোঘাট, খানাকুল, কেশপুরের মতো তাদের অতীত প্রতাপের জায়গাগুলোতে পারল না। প্রসঙ্গত, জঙ্গলমহলে সিপিএম-এর সমর্থন কখনওই কম ছিল না, কিন্তু অপ্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিস্থিতি বিশেষ দেখা যায়নি।
এটা ঠিক যে, জঙ্গলমহল এলাকাতেই তৃণমূল সব থেকে ভাল ফল করেছে। সিপিএম নেতৃত্বের একাংশ এটাকে সন্ত্রাসের অবদান হিসেবে দেখার আত্মপ্রবঞ্চক মোহে আচ্ছন্ন। ‘রাজ’ প্রতিষ্ঠার রাজনীতিতে সন্ত্রাস এক অনিবার্য ব্যাপার, এবং হাহাকার একটি মূল্যবিশেষ। কিন্তু, নীরব অথচ মেরুদণ্ডে হিমপ্রবাহ বইয়ে দেওয়া সন্ত্রাস দিয়েই যেমন বামফ্রন্ট বিপুল জয় পেত না, তেমনই তৃণমূলের সাফল্যটাকেও কেবল সরব, শোণিতস্রোত সৃষ্টিকারী হিংস্রতার ফসল হিসেবেও দেখা চলে না। বরং জঙ্গলমহলের নির্বাচনী ফলাফল, আজকের রাজনীতিতে সামাজিক ন্যায্যতার দাবির প্রাসঙ্গিকতাকেই তুলে ধরেছে। দারিদ্র ও ক্ষুধা যেখানে বীভৎস বাস্তব, সেখানে প্রতি পরিবারকে নির্বিচার দু’টাকা কিলো দরে চাল দেওয়ার ব্যবস্থা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ক্ষুধার্তের কাছে এটা একটা জীবনরক্ষার গ্যারান্টি প্রকল্প। এরই সঙ্গে হল কয়েক হাজার এন ভি এফ নিয়োগ, যা একই সঙ্গে দুটো বিষয়কে যোগ করল। প্রথমত, বহুকাল ধরে এখানকার লোকেদের অভিযোগ এই যে, এখানে দরোয়ানের চাকরিও পেয়ে থাকেন ভিনদেশীয়রা, স্থানীয় লোকেদের মধ্যে চাকরি একটা অধরা স্বপ্ন। অতএব, স্বল্প বেতনের এবং চুক্তিনির্ভর হলেও এই চাকরিগুলো এক দিকে যেমন কর্মসংস্থান প্রশ্নটাতে গুরুত্ব দিল, তেমনই আবার স্থানীয় পরিচিতিকেন্দ্রিক আবেগকেও কিছুটা মূল্য দিল, যেটা বাম জমানায় সম্পূর্ণত অবহেলিত ছিল। কেবল দারিদ্র বা ক্ষুধাই নয়, পরিচিতিগত বঞ্চনার প্রশ্নটিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ থেকেছে।
তৃতীয় ধারাটিও কার্যত সামাজিক ন্যায্যতার সঙ্গে যুক্ত, যদিও একটু অন্য ভাবে। নির্বাচনী ফলাফল দেখাচ্ছে, বেশ কিছু মুসলিম সংখ্যাবহুল এলাকায় শাসক তৃণমূল কংগ্রেস প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। মুর্শিদাবাদ, মালদহ, উত্তর দিনাজপুরের মতো মুসলিমবহুল জেলায় তৃণমূলের সংগঠন সবল নয়, এটা ঠিক। কিন্তু, পঞ্চায়েত নির্বাচন সেই সংগঠন গড়ার যে সুযোগ দিল, শাসকদল হওয়া সত্ত্বেও তৃণমূল যে সেটা তেমন ভাবে কাজে লাগাতে পারল না, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। শুধু তাই নয়, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং বীরভূমের উত্তরাংশে বিরোধী বামফ্রন্ট যে-সব জায়গায় তুলনায় ভাল ফল করল, সে-সব এলাকার বেশির ভাগটাতেই মুসলিম বসতি। মুখ্যমন্ত্রীর মুসলিম-প্রীতির পোশাকি প্রকাশ, মুসলিম মন জয় করার জন্য বিভিন্ন ধর্মাশ্রয়ী ঘোষণা সত্ত্বেও শাসক দলের পক্ষে প্রত্যাশিত ফল হল না কেন?
এর একটা প্রধান কারণ মনে হয় এই যে, মুসলমানদের মধ্যে সামাজিক ন্যায্যতার চেতনা, যা এক ধর্মনিরপেক্ষ যুক্তিপ্রকরণকে অনুসরণ করে। এ রাজ্যে মুসলমানরা যে নানান সামাজিক অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকার, সে বোধটা তাঁদের মধ্যে তীব্র, বামফ্রন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সে তীব্রতার বড় রকম অবদান ছিল। তাঁদের প্রত্যাশা ছিল যে, নতুন সরকার তাঁদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মনিয়োজন, সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব সংক্রান্ত সমস্যা ও বঞ্চনাগুলো দূর করার জন্য একটা ন্যায্যতাপ্রসারী পথ নেবে। কিন্তু তাঁদের সামনে ধর্মীয় আবেগের পথে যে সমাধান তুলে আনার চেষ্টা করা হল, তার সঙ্গে ন্যায্যতার যে কোনও যোগ নেই, সেটা মুসলমানদের কাছে দুর্বোধ্য নয়। ধর্ম ও রাজনীতির সংমিশ্রণে যে বাংলার গ্রামীণ মুসলমানের রুচি নেই, এটা সুপ্রতিষ্ঠিত। তার একটা স্পষ্ট দৃষ্টান্ত হাতের কাছেই আছে। সিদ্দিকুল্লা চৌধুরি এখনও গ্রামীণ মুসলমানদের কাছে এক জন তারকা বক্তা, তাঁর যে-কোনও সভায় হাজার হাজার লোকের ভিড় জমে, কিন্তু সেই চৌধুরি সাহেবই নির্বাচন প্রার্থী হয়ে নির্মম ভাবে প্রত্যাখ্যাত হন।
এই ব্যাখ্যাকে শতকরা একশো ভাগ সত্য বলে দাবি করার কোনও কারণ নেই। একশো ভাগ সত্য কোনও ব্যাখ্যা বোধহয় সম্ভবও নয়। তার দরকারই বা কী? এটা একটা ধারণা, পঞ্চায়েতের ফল যে ধারণাকে উৎসাহিত করে। এই ধারণার পিছনে সামাজিক ঐতিহাসিক কারণও আছে। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ মুসলমান প্রধানত শ্রমজীবী এবং বাঙালি আজও যে ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য গর্ববোধ করতে পারে, তাতে এই শ্রমজীবী চৈতন্যের অবদান অবিস্মরণীয়। বামপন্থীরা মুসলমানদের মুসলমানত্বকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করেছেন, আর বর্তমান সরকার মুসলমানদের বাঙালি এবং শ্রমজীবী পরিচিতিটাকেই অসম্মান করেছেন। পরিচিতির বহুত্ব ও সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট নাগরিকদের সচেতন যুক্তিপ্রয়োগ, এটাই হয়তো ২০১৩-র পঞ্চায়েত নির্বাচনের একটা বড় শিক্ষা।
এটাও বোধহয় একটা শিক্ষা যে, গ্রামীণ লোকসাধারণ শুধু বেঁচে থাকতেই চায় না, চায় সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকতে। যে পঞ্চায়েত তাকে অবহেলা করে, সেই পঞ্চায়েত নির্বাচনেই তার যে আগ্রহ, সেটা তার সক্ষমতার দিকে অগ্রসর হওয়ার একটা যৌথ প্রয়াস। গ্রামীণ শ্রমজীবীর এই সংগ্রামধর্মী চরিত্রটাকে স্পষ্ট বুঝতে পারার মতো সংবেদনশীলতা ছাড়া পঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রকৃতই জনগণের ‘রাজ’ হয়ে ওঠা কঠিন।

প্রতীচী ইনস্টিটিউটে গবেষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.