কলিকাতা হাইকোর্ট রায় দিয়াছে, ইমাম-মুয়েজ্জিনদের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যে মাসিক ভাতা চালু করিয়াছিল, তাহা বৈধ নহে। রায়টি প্রত্যাশিতই ছিল। কেননা কোনও বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কিছু ব্যক্তির জন্য সরকারের তরফে এই ধরনের ভাতা দানের বন্দোবস্ত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সংবিধানের বিরোধী। সরকারের অর্থ যে সরকারের কোষাগারে সমগ্র জনসাধারণের দেওয়া করের অর্থ এবং তাহা যে কোনও একটি সম্প্রদায়ের কিছু ব্যক্তির জন্য বরাদ্দ করা যায় না, এই বোধ স্বাভাবিক শুভবুদ্ধিমাত্র। কিন্তু ভোটব্যাঙ্কে আমানত বাড়াইবার তাগিদ বড় তাগিদ। অতএব বিধানসভায় বিপুল গরিষ্ঠতার জোরে এই অনুদান সংক্রান্ত আইনও পাশ করাইয়া লওয়া হয়। কিন্তু পরিষদীয় গরিষ্ঠতা তথা জনপ্রতিনিধিত্বের বৈধতা সংবিধানকে অগ্রাহ্য করিতে পারে না। কলিকাতা হাইকোর্টের রায় তাহাই আরও এক বার স্মরণ করাইয়া দিল।
রাজ্য সরকারের তরফে আদালতে বলার চেষ্টা হয় যে, সংবিধানের ১৬৬ ধারা মতে আইনসভার সিদ্ধান্তে আদালত হস্তক্ষেপ করিতে পারে না। কিন্তু হাইকোর্ট দেখাইয়া দিয়াছে, নির্বাচিত আইনসভার সিদ্ধান্ত অসাংবিধানিক হইলে আদালত তাহা রদ করিতে পারে। শাসক দলের তরফে সুপ্রিম কোর্টের ১৯৯৩ সালের একটি নির্দেশকে দেখাইয়া ওয়াকফ বোর্ড মারফত ইমামদের ভাতা দানের নির্দেশের কথা বলা হয়। আদালত তখন স্মরণ করাইয়া দেয়, সুপ্রিম কোর্ট ওয়াকফ বোর্ডকে সরকারি অর্থ দিতে বলে নাই, নিজস্ব তহবিল গড়িতে বলিয়াছিল মাত্র। সর্বোপরি, গোটা সম্প্রদায়ের উন্নতির জন্য এই ভাতার ব্যবস্থা বলিয়া শাসকদের যে দাবি, তাহাও খারিজ করিয়াছে আদালত। কারণ সমগ্র সম্প্রদায় নয়, কিছু ব্যক্তির স্বার্থই ইহা সিদ্ধ করিবে। ধর্মের ভিত্তিতে সরকারি অনুদানের বন্দোবস্ত যে অসাংবিধানিক, দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের পরিপন্থী, সে কথাও হাইকোর্ট বলিয়াছে। আদালত এই অসাংবিধানিক ব্যবস্থা খারিজ করিয়া দিলেও তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য সংখ্যালঘু ভোটারদের বলিতে পারিবেন, তাঁহারা তো সাহায্য করিতে চাহিয়াছিলেন, কিন্তু আদালত কেন বাধ্যতে? ভোটব্যাঙ্কও থাকিল, বাজেটও বাঁচিল!
একাধিক তৃণমূল কংগ্রেস নেতা এবং মন্ত্রী আদালতের রায়ের পরেও পরোক্ষ উপায়ে ইমাম-মুয়েজ্জিনদের সরকারি অর্থ বিতরণের বন্দোবস্তটি চালু রাখার ক্ষেত্রে তাঁহাদের জেদ ও সঙ্কল্পের কথা শুনাইয়া রাখিয়াছেন। ইহার অর্থ রাজ্যের সংখ্যালঘুদের কাছে বার্তা দেওয়া যে, তাঁহাদের স্বার্থ কেবল তৃণমূল কংগ্রেসই রক্ষা করিবে। সংখ্যালঘুর স্বার্থ বলিতে ঠিক কী বোঝায়? ইমাম-মুয়েজ্জিনরা ভাতা পাইলে গোটা সংখ্যালঘু সমাজ উপকৃত হয় না, তাহাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, কর্মসংস্থানের সম্ভাবনারও কোনও উন্নতি হয় না। কিন্তু ইমামরা সমাজের মাথা, ফলে তাঁহাদের ভাতা বিলির মধ্যে তাই যেন গোটা সম্প্রদায়ের উপকার করার প্রতীক নিহিত। অবশিষ্ট বৃহত্তর মুসলিম সমাজের জন্য কার্যত কিছু না করিয়াও কেবল ইমাম-মুয়েজ্জিনদের ভাতার ব্যবস্থা করিয়াই ‘তোমাদের জন্য এত করিয়াছি’ বলিয়া বাগাড়ম্বর করা যায়, করা হয়ও। তাই ঘুরপথে ইমাম-মুয়েজ্জিনদের সরকারি ভাতা বিলি করা যায় কি না, রাজ্য সরকার হয়তো এখন তাহার উপায় খুঁজিবে। তেমন উদ্যোগ অনৈতিক। কিন্তু ভোটব্যাঙ্ক এবং নৈতিকতার লড়াই নিতাম্ত অসম লড়াই। |