|
|
|
|
পড়ানোর ফাঁকে ‘শ্রী’ পদ্ধতিও শেখান ‘লবকুশে’র দুই শিক্ষক |
কিংশুক গুপ্ত • ঝাড়গ্রাম |
ছোট্ট স্কুলবাড়িটার ভেতরে অন্য জগৎ! দেওয়াল জুড়ে কচি হাতে আঁকা রঙিন ছবি। স্কুলের অন্দর থেকে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, সবতেই যত্নের ছাপ। প্রত্যন্ত গাঁয়ে এমনটা সচরাচর চোখে পড়ে না।
দু’জন শিক্ষককের দৌলতেই পাল্টে গিয়েছে ঝাড়গ্রাম ব্লকের লবকুশ আংশিক বুনিয়াদি বিদ্যালয়। যত্ন করে লেখাপড়া শেখানো তো আছেই, পড়ুয়াদের সমাজ গড়ার পাঠও দেন প্রধান শিক্ষক রমণীমোহন মণ্ডল ও সহশিক্ষক শুভাশিস মণ্ডল। পড়ুয়ারা শেখে মদের নেশা সর্বনেশে, শ্রী পদ্ধতিতে চাষে কম খরচে অধিক ফলন হয়, আঠারোর আগে মেয়েদের বিয়ে নয়, একটি গাছ-একটি প্রাণ। স্কুলে শ্রী পদ্ধতিতে চাষ নিয়ে কর্মশালা হয়, কখনও হাতেকলমে শেখানো হয় পাপেট তৈরি। গত বছর প্রতীচী ট্রাস্টের সহযোগিতায় স্কুলে ‘বই পড়া উৎসব’ও হয়েছে। |
|
লবকুশ স্কুলে পড়ুয়ারা। |
স্কুলটির জন্ম ১৯৫৪ সালে। এখানে শিশু শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। গ্রামবাসীরাই জানালেন, গোড়ায় আর পাঁচটা প্রাথমিক স্কুলের সঙ্গে এই স্কুলের বিশেষ ফারাক ছিল না। ১৯৯৭ সালে রমণীমোহনবাবু প্রধান শিক্ষক হয়ে আসার পর থেকে পরিবর্তন শুরু। ২০০৭ সালে সহশিক্ষক পদে যোগ দেন শুভাশিসবাবু। জঙ্গলমহলে দীর্ঘ আন্দোলন পর্বে এই স্কুল একদিনও বন্ধ হয়নি। স্কুলছুটের সংখ্যা কমেছে। ৪১ জন পড়ুয়ার মধ্যে দিনে গড়ে ৪০ জন হাজির থাকে। তৃতীয় শ্রেণির শ্রীমন্ত মাহাতো, হরিপ্রিয়া মাহাতো, চতুর্থ শ্রেণির সাগর রানা, কণিকা মাহাতোরা বলে, “লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামকে ভালবাসতে শিখেছি। স্কুল চত্বরে ফুলের গাছ লাগিয়েছি। ছুটি থাকলেও গাছে জল দিই।”
জঙ্গলঘেরা লবকুশ গ্রামের পরিবেশটাই দুই শিক্ষকের আন্তরিক প্রচেষ্টায় বদলে যাচ্ছে। বিশেষ করে নেশার বিরুদ্ধে লড়ে অনেকটাই সফল রমণীমোহনবাবু ও শুভাশিসবাবু। স্থানীয়রা জানালেন, পড়ুয়াদের মাধ্যমে অভিভাবকদের সচেতন করে নেশার প্রভাব অনেকটাই কমাতে পেরেছেন দুই মাস্টারমশাই। এক পড়ুয়ার কথায়, “আগে বাবা মদ খেয়ে বাড়িতে অশান্তি করতেন। মাস্টারমশাইয়ের কথামতো একদিন বাবাকে বললাম, ‘মদ যদি এতই ভাল, তা হলে সবার সামনে আমাকেও খাইয়ে দাও। না হলে নিজে আর খেও না।’ এরপর থেকে বাবা-কাকারা মদ ছেড়ে দেন।” শুভাশিসবাবু বলেন, “অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে একজন মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারান। শিশুরা সেটা বুঝেছে। তাই রুখে দাঁড়াচ্ছে।” |
শিক্ষক শুভাশিস মণ্ডল। |
শিক্ষক রমণীমোহন মণ্ডল। |
|
অপরিণত বয়সে বিয়ে আটকাতেও লড়ে যাচ্ছেন দুই শিক্ষক। আট বছর আগে চতুর্থ শ্রেণি উত্তীর্ণ এক ছাত্রীর বিয়ে আটকান রমণীমোহনবাবু। তার পর থেকে নিয়মিত প্রচার চালাচ্ছেন দুই শিক্ষক। কাজও হচ্ছে। কয়েক মাস আগে পাশের কামারবাঁধি গ্রামে বাসিন্দারাই এক নাবালিকার বিয়ে রুখে দিয়েছেন। কম খরচে বেশি ফলনের পাঠও দিচ্ছেন এই দু’জন। স্থানীয় চাষি হাবু মাহাতো বলেন, “মাস্টারমশাইদের অনুপ্রেরণায় গত মরসুমে ১৫ কাঠা জমিতে শ্রী পদ্ধতিতে ধান চাষ করে ভাল ফলন পেয়েছি।”
লবকুশ গ্রাম শিক্ষা কমিটির সভাপতি নরেন মাহাতোর কথায়, “ওই দুই শিক্ষক শুধু স্কুলের মধ্যে নিজেদের আটকে রাখেননি। গ্রামের জন্যও ভাবেন। ওদের উৎসাহে গ্রামবাসীরা ঝাড়গ্রামে গিয়ে রক্তদান করে আসছেন।”
গত বছরই রমণনীমোহনবাবুকে ‘শিক্ষারত্ন’ সম্মান দিয়ে কুর্নিশ জানিয়েছে রাজ্য সরকার। স্কুল অন্তপ্রাণ এই শিক্ষক অবশ্য পুরস্কারের ২৫ হাজার টাকাই স্কুলের নামে ব্যাঙ্কে জমা করে দিয়েছেন। তার সুদ থেকে প্রতি বছর কৃতী পড়ুয়াদের পুরস্কৃত করা হবে। সামনের অক্টোবরে অবসর নেবেন রমণীমোহনবাবু। হাতে আর এক মাস। গ্রামবাসীদের মন তাই এখন থেকেই খারাপ। রমণীমোহনবাবু অবশ্য আশাবাদী তাঁর অবর্তমানেও কর্মযজ্ঞ চলবে। প্রবীণ এই শিক্ষকের বিশ্বাস, “জীবনে কোনও কিছুই থেমে থাকে না। শুভাশিস ও প্রাক্তন পড়ুয়ারাই বাকি কাজ করবে। এই স্কুলকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।”
|
ছবি: দেবরাজ ঘোষ |
|
|
|
|
|