পেট চালাতে স্কুলছুট, ফেরাচ্ছেন শিক্ষকেরা
স্কুলের বাঁধা রুটিন আছে। কিন্তু তার বাইরে বেরিয়ে দারিদ্র্যের অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েদের টেনে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন কিছু শিক্ষক।
তিন বছর হয়ে গেল, পূর্বস্থলীর নাদনঘাট রামপুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ওঁরা গড়ে তুলেছেন ‘ড্রপ-আউট প্রিভেনশন ক্লাব’। ২০১১ থেকে এ পর্যন্ত স্কুলছুট হওয়া জনা পঁয়ত্রিশ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ১৪ জনকে ফিরিয়ে আনতেও পেরেছেন।
বর্ধমানের পূর্বস্থলী ১ ব্লকের প্রত্যন্ত এলাকার ওই স্কুলে নাদনঘাট, বাঁশবেড়িয়া, শশীপুর, বড়ডেক, কামালপুর-সহ খান বিশেক গ্রামের পড়ুয়ারা পড়তে আসে। প্রায় ১৪০০ ছাত্রছাত্রী। এরই মধ্যে গরিব পরিবারের কেউ-কেউ পড়া ছেড়ে চলে যায় সুরাট, বরোদা, মুম্বই বা কেরালায়। কেউ গয়নার দোকানে কাজ নেয়, কেউ রাজমিস্ত্রির হেল্পার।
এই স্রোত আটকাতেই স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক অরূপ চৌধুরী ও বাগবুল ইসলাম, বিজ্ঞানের অশোক রায় ও ইয়ারবক্সের মতো জনা সাতেক মিলে ‘ক্লাব’ গড়েছিলেন। আস্তে-আস্তে পূর্ণ সময়ের মোট ২৯ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা, এমনকী পার্শ্বশিক্ষকেরাও এতে যোগ দিয়েছেন। কেমন তাঁদের অভিজ্ঞতা?
গত ২৭ অগস্ট সপ্তম শ্রেণিতে স্কুলছুট রিন্টু গড়াইয়ের বাড়ি গিয়েছিলেন শিক্ষকেরা। তার বাবা হরিসাধন গড়াই খেতমজুরি করে সংসার টানতে না পারায় সে মিষ্টির দোকানে কাজ নিয়েছিল। হরিসাধনবাবু প্রথমে ছেলেকে কাজ ছাড়াতে রাজি হননি। তাঁর যুক্তি ছিল, ছোট থেকে কাজ করলে রিন্টু তাড়াতাড়ি দক্ষ হয়ে উঠবে। বেশি রোজগার করতে পারবে। শিক্ষকেরা পাল্টা বোঝান, ন্যূনতম পড়াশোনা না করলে কোনও দিনই বেশি রোজগার করতে পারবে না সে। এক জায়গাতেই পড়ে থাকবে। রিন্টুর পড়ার খরচ বহন করবেন বলেও তাঁরা জানান। শেষমেশ হরিসাধনবাবু ছেলেকে স্কুলে পাঠাতে রাজি হয়েছেন।
পড়ুয়াদের ফেরাতে বাড়ি-বাড়ি ঘুরছেন ওঁরা। —নিজস্ব চিত্র।
গত বছর মার্চে পড়া ছেড়ে গ্যারাজে কাজ নিয়েছিল সপ্তম শ্রেণির রাকিবুল শেখও। নাদনঘাটের ইসলামপুরে তার বাড়িতেও বোঝাতে যান শিক্ষকেরা। বাড়ির লোকজন প্রশ্ন করেন, রাকিবুল কাজ ছাড়লে তার রোজগারের কী হবে? শিক্ষকেরা বলেন, আর কয়েকটা বছর কষ্ট করলে ভবিষ্যতে সে অনেক ভাল কাজ পাবে। বাড়ির লোকেরা দাবি করেন, যে চুক্তিতে রাকিবুল কাজে ঢুকেছে তাতে গ্যারাজ মালিক তাকে এখনই ছাড়বে না। তা শুনে শিক্ষকেরা সোজা গ্যারাজে গিয়ে মালিককে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনার ছেলেমেয়ে স্কুলে যায় না?’ তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, যায় তো!’ রাকিবুলকে দেখিয়ে শিক্ষকেরা বলেন, ‘তা হলে ও স্কুল যাবে না?’ থতমত খেয়ে খানিক চুপ করে থাকেন গ্যারাজ মালিক। তার পরে বলেন, ‘কালই ওকে ছেড়ে দেব। ও স্কুল যাক। দরকারে আমিও পাশে থাকব।’
রাকিবুল এ বছর অষ্টম শ্রেণিতে উঠেছে। তার বাবা, শাহামত শেখ মেনে নেন, “ভালমন্দ না বুঝেই ওকে স্কুল ছাড়িয়েছিলাম।” গত বছর স্কুলে ফিরেছে পাশের বগপুর পঞ্চায়েতের ঘোলা গ্রামের মুসারজিত মণ্ডলও। খেতমজুর বাবা-মা তার পড়ার খরচ জোগাতে না পারায় সে স্কুল যাওয়া বন্ধ করেছিল। তার বদলে খেতে যাওয়া শুরু করেছিল সে। তার পড়ার খরচ শিক্ষকেরাই চাঁদা তুলে জোগাড় করে দেন। তার পর থেকে সে আর স্কুল কামাই করেনি। শুধু মুসারজিৎ বা রাকিবুলই নয়, যারা এক বার স্কুলে ফিরেছে তারা আর মাঝপথে লেখাপড়া বন্ধ করেনি। কিন্তু সবাইকে ফেরানো যায়নি।
অরূপবাবুর মতে, “যে ছেলেমেয়েদের রাজ্যের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের কারণেই দীর্ঘ হচ্ছে ড্রপ-আউটের তালিকা।” অষ্টম শ্রেণির তাপস দাস যেমন হঠাৎই এক দিন স্কুলে আসা বন্ধ করে হায়দরাবাদে এক ইস্পাত কারখানায় কাজ করতে চলে গিয়েছে। শিক্ষকেরা তার বাড়িতে গিয়েও পড়ার খরচ দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু রোজগার ছেড়ে সে আসবে কেন, বারবার এই প্রশ্নই তুলেছেন তার বাড়ির লোকজন। অনেক বোঝানোর পরে তাঁরা বলেন, ছেলেকে ফিরিয়ে এনে ফের স্কুলে পাঠানোর চেষ্টা করবেন। তবে আজও তা হয়নি।
সাফল্য-ব্যর্থতা মিশিয়ে এই চেষ্টা কিন্তু অনুপ্রেরণা দিচ্ছে অন্যদেরও। শিক্ষকদের দেখাদেখি যেমন এগিয়ে এসেছেন স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রী হিরা মান্ডিও। তিন বছর আগে স্নাতক হয়ে বেরিয়ে এখন তিনি একটি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে কাজ করেন। আদিবাসী গ্রামগুলিতে গিয়ে সরাসরি সাঁওতালি ভাষায় তিনি অভিভাবকদের বোঝাচ্ছেন। বগপুর পঞ্চায়েতের রাজীবপুর গ্রামের দুই আদিবাসী ছাত্রীকে কাছাকাছি দু’টি স্কুলে ফেরতও পাঠানো গিয়েছে।
রামপুরিয়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সুকুমার গড়াইয়ের কথায়, “যে ভাবে সকলে কোমর বেঁধে নেমেছেন, হয়তো বেশি দিন স্কুলের বাইরে বেশি ছাত্রছাত্রী থাকবে না।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.