ঘোষণার দিন থেকেই বিতর্ক পিছু নিয়েছিল। ইমামদের ভাতা দেওয়ার রাজ্য সরকারি সিদ্ধান্তকে অসাংবিধানিক অ্যাখ্যা দিয়ে সোমবার খারিজ করে দিল হাইকোর্ট। যদিও সরকার এখনই প্রক্রিয়াটিতে দাঁড়ি টানবে না বলেই ইঙ্গিত।
ভোটের রাজনীতির কারণে বিরোধীরা সরাসরি আদালতের সিদ্ধান্তকে স্বাগত না-জানালেও সরকারকে বিঁধে বলেছে, ভাতা বাতিল হওয়া প্রত্যাশিতই ছিল। ব্যতিক্রম বিজেপি। ভাতা বাতিলের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন দলেরই এক রাজ্য নেতা।
দেড় বছর আগে রাজ্য সরকার ইমামদের ভাতা দেওয়ার ব্যাপারে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। বলা হয়, তাঁদের মাসে আড়াই হাজার টাকা ভাতা দেওয়া হবে। এ নিয়ে জনস্বার্থ মামলা হয়। সেই মামলায় সরকারের তরফে দাবি করা হয়, সংবিধানের ২৮২ ধারা অনুযায়ী জনস্বার্থেই ইমামদের ভাতা দেওয়া হচ্ছে। বিচারপতি প্রণব চট্টোপাধ্যায় ও বিচারপতি মুরারিপ্রসাদ শ্রীবাস্তবের ডিভিশন বেঞ্চ এ দিন সরকারের যুক্তি খারিজ করে জানিয়ে দিয়েছে, এর সঙ্গে জনস্বার্থের কোনও সম্পর্ক নেই। মোয়াজ্জিনদেরও মাসিক দেড় হাজার টাকা ভাতা দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছিল রাজ্য। বেঞ্চের বক্তব্য, ওই বিষয়ে মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত হলেও কোনও সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি হয়নি। তাই সেটিও অবৈধ। |
তর্ক-যুক্তি |
রাজ্যের দাবি |
কোর্টের মত |
• সংবিধানের ২৮২ ধারা অনুযায়ী
জনস্বার্থেই ইমাম-ভাতা।
• বিধানসভায় এই সংক্রান্ত বাজেট বরাদ্দ পাশ
হয়েছে।
আর সংবিধানের ১৬৬ নম্বর ধারা মতে,
আইনসভার
কোনও সিদ্ধান্তে আদালত
হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
• সুপ্রিম কোর্ট ১৯৯৩-এর নির্দেশে ওয়াকফ
বোর্ড মারফত ইমামদের ভাতা দিতে বলেছে।
• একটি সম্প্রদায়ের
(কমিউনিটি) জন্য এই ভাতা। |
• ২৮২-তে জনস্বার্থ হিসেবে যা
যা চিহ্নিত, এটি তার বাইরে।
• ১৬৬-তে স্পষ্ট, রাজ্য কী ধরনের নির্দেশ দিতে
পারে। এ ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। এবং
আইনসভার অসাংবিধানিক সিদ্ধান্ত রদের
ক্ষমতা কোর্টকে দিয়েছে ২২৬ ধারা।
• জাতীয় ওয়াকফ বোর্ডকে তহবিল গড়তে বলেছিল
সুপ্রিম কোর্ট। সরকারি টাকা দিতে নয়।
• সংবিধানের ১৪, ১৫ক এবং ২৮৩ ধারায় ধর্মের
ভিত্তিতে
সরকারি অনুদান নিষিদ্ধ। ইমামেরা
সম্প্রদায়ও নন, ব্যক্তিবিশেষ। |
|
ডিভিশন বেঞ্চের রায় ঘোষণার পরে সরকারের তরফে স্থগিতাদেশ চাওয়া হয়। আদালত তা মানেনি। তারা বলেছে, নির্দেশ অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে। তা-ও সরকার এখনই ভাতা বন্ধ করবে না, মহাকরণ সূত্রে তেমনই ইঙ্গিত মিলেছে। পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এ দিন বলেন, “ইমাম-মোয়াজ্জিন ও সংখ্যালঘু মানুষকে বলতে চাই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যত ক্ষণ মুখ্যমন্ত্রী, তত ক্ষণ তাঁদের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকবে। আর্থিক ভাবে যাঁরা কমজোরি, মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের এক সঙ্গে তুলে আনার চেষ্টা করছেন।”
কিন্তু হাইকোর্ট যে ইমাম-মোয়াজ্জিনের ভাতা বন্ধ করতে বলেছে? পুরমন্ত্রীর জবাব, “রায় এখনও আমাদের কাছে আসেনি। এলে বিবেচনা করব। হাইকোর্ট কোনও কিছুকে অসাংবিধানিক মনে করে কিছু পরিবর্তন করতে বললে নিশ্চয়ই করব। তবে আমরা চাই না, গরিব ইমাম ও মোয়াজ্জিনদের স্বার্থে আঘাত লাগুক। তাঁদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের কতর্ব্য।” তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের মুখেও ভাতা বন্ধ না-হওয়ার আশ্বাস শোনা গিয়েছে। “আমরা দলে আলোচনা করেছি। ওঁরা (ইমাম-মোয়াজ্জিন) যে সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন, তা পাবেন। চিন্তার কারণ নেই।” বলেছেন মুকুলবাবু।
অর্থ দফতর-সূত্রের খবর: রায় জানার পরেই মুখ্যমন্ত্রী অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রকে নির্দেশ দেন, ইমাম-মোয়াজ্জিনদের ভাতা যেন বন্ধ না হয়। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই সংখ্যালঘু দফতরের মন্ত্রী। তিনি এ দিন দার্জিলিঙে ছিলেন। কোর্টের নির্দেশ সম্পর্কে অবশ্য তিনি কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
প্রক্রিয়াটি কী ভাবে চালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছে সরকার?
অর্থ দফতর সূত্রে আভাস মিলেছে, এই রায়ের প্রেক্ষিতে রাজ্য নয়া নির্দেশিকা জারি করবে। যাতে বলা হবে, মুসলিমদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সরকার ওয়াকফ বোর্ডকে টাকা দেয়। তা দিয়ে কী করা হবে, ওয়াকফ বোর্ডই ঠিক করবে। সূত্রের ইঙ্গিত, নয়া নির্দেশিকায় ইমাম-ভাতার সরাসরি উল্লেখ থাকবে না। যদিও ওয়াকফ বোর্ডকে জানিয়ে দেওয়া হবে, ওই টাকা দেওয়ার মূল উদ্দেশ্যটা কী।
অর্থাৎ, আদালতের বাধা কাটাতে সরকার এখন অন্য ভাবে ইমাম-মোয়াজ্জিনদের ভাতা জোগানোর পরিকল্পনা করছে বলে সূত্রের দাবি। রাজ্যের বিভিন্ন মুসলিম সংগঠনও ভাতা চালু রাখার পক্ষে। তাদের একাংশের মতে, সরকারের আইনি অসুবিধা থাকলে ওয়াকফ সম্পত্তির আয় থেকে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান হতে পারে। মহাকরণের খবর, গত ১ বৈশাখ চালু হওয়া ইস্তক এ পর্যন্ত রাজ্যের মোট ২৭ হাজার ৭৮৪ জন ইমাম ভাতা পাচ্ছেন। ভাতাপ্রাপ্ত মোয়াজ্জিনের সংখ্যা ১৮ হাজার ৫৯৩। চলতি অর্থবর্ষে সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতরের বাজেটে ভাতা বাবদ বরাদ্দ ১২৬ কোটি টাকা। তার ৯৪ কোটি ইতিমধ্যে ওয়াকফ বোর্ডের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
গত বছরের ৯ এপ্রিল ইমাম-ভাতার বিজ্ঞপ্তি জারি হয়। তা কার্যকর হয় ছ’দিন বাদে, ১ বৈশাখে। এর পরেই বিজ্ঞপ্তিকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে জনস্বার্থ-মামলা রুজু হয়। বাদীপক্ষের অন্যতম কৌঁসুলি কৌশিক চন্দের অভিযোগ ছিল, ইমামদের ভাতা দেওয়ার সঙ্গে জনস্বার্থের সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নানা ব্যক্তি কাজ করেন। অথচ রাজ্যের সরকার শুধু একটি সম্প্রদায়ের পদাধিকারীদের ভাতা দিচ্ছে, আইনের চোখে যা বৈষম্যমূলক আচরণ ছাড়া আর কিছু নয়। সুপ্রিম কোর্টের রায় দেখিয়ে সরকার পক্ষের কৌঁসুলি জয়ন্ত মিত্র পাল্টা যুক্তি দেন, মসজিদের ইমাম ও অন্যদের বেতন ইত্যাদি বিষয়ে সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড নীতি প্রণয়ন করতে পারে। তা মেনে রাজ্য ওয়াকফ বোর্ড টাকার সংস্থান করে বেতন দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে তা-ই হচ্ছে বলে দাবি করেন সরকারি আইনজীবী। সওয়ালে রাজ্য এ-ও বলেছিল, অনেক মসজিদের দরিদ্র ইমামেরা সংখ্যালঘু মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে সাহায্য করলেও নিজেদের সন্তানদের পড়াতে পারেন না। ওঁদের কথা ভেবে জনস্বার্থেই রাজ্যের এই সিদ্ধান্ত।
সরকারের যুক্তি অবশ্য ধোপে টেকেনি। বস্তুত শুনানি চলাকালীন রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে বাদীপক্ষ তো বটেই, খোদ আদালতের তরফেও নানা প্রশ্ন উঠেছে। ডিভিশন বেঞ্চ বলেছে, কোনও বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায় বা ব্যক্তিকে সরকারি অনুদান দেওয়াটা জনস্বার্থ হতে পারে না। “সরকারের ভূমিকা হওয়া উচিত নিরপেক্ষ।” মন্তব্য বেঞ্চের। তাদের মতে, ওয়াকফ বোর্ডের নিজস্ব তহবিল থেকে ভাতা দেওয়া, আর সরকারি কোষাগারের টাকা ওয়াকফ বোর্ডের হাত দিয়ে ভাতা হিসেবে দেওয়া এক জিনিস নয়। |