প্রবন্ধ ২...
ওই দৃষ্টি থেকে এই ধর্ষণ, এক সুতোয় বাঁধা
ড় তুলেছেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রোজ চাজ্ম । ১৮ অগস্ট সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোতে একটা পোস্ট লিখেছেন পড়াশোনার কাজে তিন মাসের জন্য ভারতে এসেছিলেন। ভারত সম্বন্ধে তাঁর দুটো বিশেষণ: এক, ‘ওয়ান্ডারফুল’, দুই, ‘মেয়েদের জন্য অসম্ভব বিপজ্জনক’। ফিরে গিয়ে তাঁর ‘পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার’ হয়। হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। মার্কিন মুলুকে এমন একাধিক মেয়েকে ঠিক এ রকমই ট্রমার শিকার হয়ে ভারত থেকে ফিরে সাইকোথেরাপি করতে হয়েছে, জানেন রোজ।
ভারতীয় পুরুষদের কী কী অসভ্যতার শিকার হয়েছেন বিদেশিনি ট্যুরিস্ট রোজ? তালিকাটা পড়ে আমরা ভারতীয় মেয়েরা মোটেও শিউরে উঠব না। কারণ, আমার মতো প্রতিটি মেয়ের কাছেই এ সব প্রত্যক্ষ ও দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা। পুরুষের স্টকিং, অর্থাৎ পিছু নেওয়া। সুযোগ পেলেই অপরিচিত মেয়ের শরীর ‘খারাপ ভাবে’ ছুঁতে চাওয়া। এ ছাড়া রোজ আলাদা করে উল্লেখ করেছেন, ভারতে পথে-ঘাটে পুরুষের লোলুপ দৃষ্টির কথা, যে দৃষ্টির সামনে একটি মেয়ের মনে হয় তার গা থেকে মাংস খুবলে নেওয়া হচ্ছে, তার আপাদমস্তক ঢেকে ফেলতে ইচ্ছে করছে নিজেকে। ভারতে আসার আগে রোজকে বলে দেওয়া হয়েছিল, রক্ষণশীল জামাকাপড় পরো, কারও দিকে চেয়ে হেসো না, কাউকে ‘সেক্স সিগনাল’ দিয়ো না। রোজ বলেছেন, কাউকে সিগনাল দিতে হয় না ভারতে, একটি মেয়ের শরীরই এ দেশে যথেষ্ট সিগনাল।
ব্লগটি বিরাট ঝড় তুলেছে নেট দুনিয়ায়। স্বাভাবিক। এই প্রথম এই ভাবে খোলাখুলি ভারতীয় পুরুষের এই ব্যাধি সম্বন্ধে এক জন বিদেশি লিখেছেন, সারা পৃথিবীর লোক পড়ছেন। ভারতীয় পুরুষেরা তো চটে গেছেনই, চটে গেছি মেয়েরাও। প্রথম প্রতিক্রিয়া, এ আর নতুন কথা কী? আমরা তো ছোট্টবেলা থেকেই এই নিয়ে বড় হয়ে উঠেছি। ৭-৮ বছর থেকে ১৯-২০ হয়ে ওঠা পর্যন্ত ভয়ে, অস্বস্তিতে বাবা-মা’কে বলতে পারিনি, নিজেকে খারাপ ভেবেছি। সমঝোতা করেছি। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও প্রতি দিন এই সব অযাচিত স্পর্শ, চাপ, দৃষ্টি, আদিরসাত্মক টিটকিরি, ইয়ার্কি, ‘আওয়াজ’ (রোজ ভিন্ভাষী বলেই হয়তো এগুলোর উল্লেখ করেননি!) নিতে নিতে চলছি। কেউ প্রতিবাদ করি, কেউ সরে যাই নীরবে, কেউ চেষ্টা করি এড়িয়ে চলার। বাসে উঠলে অসুবিধা হয় তো ট্যাক্সি চেপে যান কথাটা কত বার শুনেছি! নিজের নিজের রেস্ত অনুসারে কত বার সত্যিই ট্যাক্সি বা গাড়িতে চেপেওছি নিজেকে বাঁচাতে! আমাদের মধ্যে যারা বিদেশে গিয়ে থাকি, দেশে ফিরে বিমানবন্দরে পা রেখে কীসে ‘অ্যাট হোম’ ফিল করি? সিকিয়োরিটি, কাস্টমস বা এয়ারপোর্ট অফিশিয়ালদের চটচটে চেনা চাউনিগুলো দেখে! সে জন্য কি আমাদের ট্রমাটিক ডিসঅর্ডার হয়েছে? বিদেশিনিদের সবটাতেই বাড়াবাড়ি।
প্রতিক্রিয়া দুই। রোজ বড্ড বাড়িয়ে বলছেন। ভারতে পুরুষদের ও সব আচরণ সত্য, কিন্তু ভারতকেই আলাদা করে চিহ্নিত করাটা বাড়াবাড়ি। আহা, যেন বিদেশে স্টকিং বা স্টেয়ারিংয়ের মতো অসভ্যতা হয় না! আমেরিকায় তো ধর্ষণ হরদম। তা হলে?
উপর্যুপরি ধর্ষণকাণ্ড নিয়ে মিডিয়া তোলপাড় হওয়ার পর, ভারতীয়দের অস্বস্তি যে রোজ চাজ্ম বাড়িয়ে দিয়েছেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু অস্বস্তির সঙ্গে কয়েকটা প্রশ্নও কি উঠে আসছে না? যাঁরা বলছেন, আজকের পাশ্চাত্য সংস্কৃতি, বাজারায়ণ, পণ্যায়নের ফলেই নাকি এই সব অসভ্য স্পর্শ, অশ্লীল চাউনি, ধর্ষণের কেস মাথাচাড়া দিয়েছে, তাঁদের কথা কিছুটা মানি। জানি গুড়গাঁও বা দিল্লিতে, আন্ধেরির বস্তিতে, নদিয়া বা বারাসতে, পল্লু-ঢাকা সভ্যতা হঠাৎ পাশ্চাত্যায়িত খোলা ত্বকের সামনে এসে কেমন মাথা গুলিয়ে ফেলেছে। তবু বলি, আজকে যে সব ধর্ষণকাণ্ডের কাহিনি পড়ছি ও দেখছি, সেগুলো কি খুব নতুন? না কি, এই সচেতনতা, এই মোমবাতি মিছিল, এই প্রতিবাদসভাই আসলে নতুন? আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতির ভেতরেই কি বরাবর নেই নারীকে লঙ্ঘনের এই ঐতিহ্য? আবহমান কাল ধরে আমাদের সংস্কৃতি কি মেয়েদের শ্লীলতাহানি, জোরজবরদস্তি ভোগের গল্পগুলোই বলেনি? দুষ্ট আর ইষ্টের দ্বন্দ্ববর্ণনার নাম করে সেই গল্পগুলোই কি আরও প্রকৃষ্ট রূপে আমাদের মাথার মধ্যে বসিয়ে দেওয়া হয়নি? রামায়ণ আর মহাভারতে দু-দুটো বড় যুদ্ধ লাগল কেন? এ সব গল্প বার বার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা মেয়েদের প্রতি সেই চেতাবনিটাই কি দিই না? তোমার সঙ্গেও এ রকম হতে পারে। তুমি যতই অপাপবিদ্ধ হও না কেন, দুর্ভাগ্য নেমে আসতেই পারে যখন-তখন। অতএব সাবধান। নিজেকে ঢেকেঢুকে লুকিয়ে রাখো। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। এই সংস্কৃতি থেকে সরে আসার বদলে আমরা এই সংস্কৃতিকে চুনকাম করে গিয়েছি। চুনকাম আর চাপাচুপির ফলে যেটা এত দিন ঘটেছিল আমরা ধর্ষণকে ঠিক ওই নামে ডাকতাম না। শ্লীলতাহানি, ইজ্জত লোটা থেকে শুরু করে নানা ঢাকা-চাপা নাম ছিল জিনিসটার। আজ কিন্তু সেটা খসে গিয়েছে। আর, ধর্ষণ শব্দটা বার বার শুনতে শুনতে আমাদের মন এমন অসাড় অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছে যে এর পর একটি মেয়ে কোনও পুরুষের অবাঞ্ছিত স্পর্শ নিয়ে আপত্তি জানালে বোধহয় শুনতে হবে: তাতে কী হয়েছে, ধর্ষণ করে মেরে তো আর ফেলেনি?
চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, আসলে সবটাই এক। একই বাস্তবতার অংশ। তফাত শুধু মাপে। ওই দৃষ্টি, ওই স্পর্শ, ওই টিটকিরি, আর জং-ধরা লোহায় এফোঁড় ওফোঁড় হওয়া। নইলে, চার বছরের মেয়েকে মামা-কাকারা কিংবা বাড়ির কাজের লোক যদি একলা ঘরে খারাপ ভাবে ছোঁয়, অথবা কল্পকাহিনিতে যদি লেখক একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে হত্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেয়, তার সঙ্গে সত্যিকারের ধর্ষণকারীর মানসিক দূরত্ব কতটা? ব্রিটেনে সম্প্রতি রেপ পর্নোগ্রাফি দেখাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করেছেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। এখনও দেশ-বিদেশে এ নিয়ে বিতর্ক। যুক্তি, আদিকাল থেকে পুরুষের রিরংসা ছিল, আছে, থাকবে। তা নিয়ে এত হইচইয়ের কী আছে। এও ঠিক, এ কেবল ভারতের ঐতিহ্য নয়, মেয়েদের পণ্যায়িত করার সুন্দর কেতা পশ্চিমি সংস্কৃতিতেও বহু যুগ ধরেই মজুত। ইয়োরোপে তো কবে থেকে ইরোটিকার চল, পর্নোগ্রাফির রমরমা। মার্কিন মেয়ে রবিন মর্গান অনেক দিন আগে বলেছিলেন, পর্নোগ্রাফি হল থিয়োরি আর ধর্ষণ প্র্যাকটিস।
এ সব নিয়ে আমরা এখন ভাবছি না। আমরা ভাবছি, আইনশৃঙ্খলার কথা। ভাবছি অরাজকতার কথা। যে অরাজকতায় কিন্তু ভারত বেশির ভাগ দেশকেই ছাপিয়ে যায়। প্রতিবাদ করছি নগরপালক ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে, যাঁরা আজও আমাদের এই ‘চিরন্তন’ পুরুষদের সাবধান করার, বা প্রয়োজন হলে ভয় দেখানোর বা থামানোর কোনও ব্যবস্থা করতে পারেননি। শহরগুলোকে আর একটু সুরক্ষিত করতে পারেননি, মেয়েদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য প্রশাসনের কলকব্জাগুলোকে আর একটু সংবেদনশীল করতে পারেননি। যে রকম সংবেদনশীলতা দেখা যায় ধনী দেশ সুইজারল্যান্ড বা জার্মানিতে, বা তুলনায় গরিব দেশ উজবেকিস্তান, কাজাখস্তানে। আইন মানতে অভ্যস্ত সে সব দেশের মানুষ, তাই মেয়েরা রাতবিরেতেও নির্ভয়ে পথে বেরোন সেখানে। আমরা কেন পারি না?
দ্বিতীয় এবং আরও বড় ভাবনা হল, মানসিকতা পাল্টানো। ওই দৃষ্টি থেকে এই ধর্ষণ, সবটাই যে মানসিকতায় এক সুতোয় গাঁথা। আবার সভা হবে, আবার নড়ে বসবে কলকাতা, মুম্বই, দিল্লি। কিন্তু রোজ-কথিত ‘ভারতীয় পুরুষ’দের ‘মাইন্ডসেট’ এতে পাল্টাবে কি? মাচো পুরুষের সংজ্ঞা পাল্টাতে, পৌরুষের ‘স্টিরিয়োটাইপ’টা আমূল পাল্টাতে কতটা নাড়া দেবে এই সব প্রতিবাদ?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.