পাহাড়ের ছেলেমেয়েরা অনেকেই কলকাতায় পড়েন। এবং দূরের মানুষই থেকে যান। লিখছেন
রূপসা রায় |
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নানা জনসভায় দাবি করেছেন, দার্জিলিং ‘বাংলার হৃদয়’। কিন্তু দাজির্লিঙের মানুষজন? তাঁদের সঙ্গে বাঙালির হৃদয়ের যোগ তৈরি হয়েছে কি? কলকাতায় দার্জিলিঙের যে ছাত্ররা রয়েছেন, তাঁরা কিন্তু তা বলছেন না। কলকাতায় উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে এসে তিন চার বছর ধরে একই কলেজে পড়াশোনার পরেও বাঙালি ছেলেমেয়ের বন্ধু হয়ে উঠতে পারেনি। তাঁদের কাছে ওঁরা যে স্রেফ ‘চিঙ্কি’। যাদের ভাষা বোঝা যায় না, নাম বলতে গেলে ‘দাঁত ভেঙে যায়’।
গোর্খাল্যান্ডের দাবি নিয়ে পাহাড় উত্তাল, জনজীবন স্তব্ধ, কান পাতলেই ‘বাংলা ভাগের চক্রান্ত’র গুজব। কী ভাবছে এই ছেলেমেয়েরা, যারা নিজভূমি থেকে অনেক দূরে রাজ্যের প্রাণকেন্দ্রে ক্লাসরুম, রেস্তোরাঁ আর গিটার বাজানোর ফাঁকে টিভিতে উদ্বিগ্ন চোখ রাখছে বার বার? |
২০০৫ থেকে ২০০৮, প্রেসিডেন্সিতে সমাজতত্ত্বের ছাত্র ছিলেন আশিস রামতেলি। বাড়ি কালিম্পঙে। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন যখন দানা বাঁধছে, আশিস তখন কলকাতার হিন্দু হস্টেলে বসে গান বাঁধছেন মাতৃভাষা গোর্খালিতে। সরস্বতী পুজোর সন্ধেয় হিন্দু হস্টেল চত্বরে গাইছিলেন ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা, এলভিস প্রেসলি, বব ডিলান। সন্ধ্যায় হস্টেলে আসা বাইরের ছেলেমেয়েদের জন্য থালায় সাজিয়ে নিয়ে এসেছিলেন পুজোর ভোগ। বার বার বলতেন, “আমাদের কোনও পরিচয় নেই। কলকাতায় তো ছাত্রছাত্রীরা আমাদের সঙ্গে মেশেই না। ‘চিঙ্কি’ বলে ডাকে। অনেকে জিজ্ঞাসা করে, তুমি কি নেপালি? বার বার বলতে বলতে ক্লান্ত: না আমরা এই রাজ্যের, পশ্চিমবঙ্গের। আমরা বার বার নিজেদের এই রাজ্যের বলে সবাইকে জানিয়েছি। কিন্তু তোমরা, এ রাজ্যের বাঙালিরা কি আমাদের নিজেদের করে নিয়েছ? বাংলার বাইরে গেলে তো আমাদের দেশের বাইরের লোক ভাবে।”
প্রেসিডেন্সিতে ইতিহাসের তৃতীয় বর্ষের বিবেক সাশনলাসও বললেন, “কোথাও গেলেই শুনতে হয়, তুমি তো বাঙালি নও! কলেজেও কেউ বিশেষ আমাদের সঙ্গে কথা বলে না। আমরা আলাপ করার চেষ্টা করি না, তা নয়। কিন্তু একটা আলাদা জায়গায় এসে তো আর জনে জনে পরিচয় দিয়ে বেড়ানো সম্ভব না। লোকে ভাবে, আমরা নিজেরা দল বেঁধে আলাদা থাকি।”
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পড়ছে কালিম্পঙের জিগমি ভুটানি। সাফ বলে, “উই ওয়ন্ট গোর্খাল্যান্ড।” কেন? “আত্মপরিচয়ের লড়াই। ভারতের মানচিত্রে আমাদের একটা জায়গা থাকবে। একটা সীমারেখা থাকবে। লোকে আর বলতে পারবে না, তুমি কে?”
প্রশ্নটা শুধুই আত্মপরিচয়ের? রাজনৈতিক ক্ষমতার লোভ নেই কোথাও? জিগমি বলেন, “ক্ষমতার লোভ কি না জানি না। কিন্তু এটুকু জানি, আলাদা রাজ্য হলে সমস্যাগুলো একটু দ্রুত মিটবে। কত জায়গায় জল নেই, আলো নেই, বিদ্যুৎ নেই, চাকরি নেই। সব চেয়ে বেশি মানুষ রয়েছেন পুলিশের কাজে। আমাদের লোকজন ব্যবসায় খুব আসতেই পারেনি। আর উন্নয়ন? ক’টা রাস্তা হয়েছে। বাকি প্রশ্নগুলোর তো সমাধান হয়নি এখনও।” বিবেকের কথায়, “দার্জিলিঙের প্রত্যন্ত জায়গায় জল কিনে খেতে হয়। ২৫০ টাকায় ১০০০ লিটার জল পাওয়া যায়। তাতে ক’দিন চলে?”
জিগমির পরিবার সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। “রাজনীতি করি বা না করি, সেটা প্রশ্ন নয়। এই আন্দোলন ‘জন আন্দোলন’ হয়ে উঠেছে... আমাদের কালিম্পঙে একটা শহিদ বেদি আছে। ’৮৬ সালে সুবাস ঘিসিংয়ের নেতৃত্বে এক মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। প্রায় বারোশো লোক মারা যায়। আমরা সেই গল্প শুনে বেড়ে উঠেছি। ছোটরাও জানে। এটাই তো আমাদের ইতিহাস।”
প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময় আশিসরা গোর্খালি ভাষায় গান গেয়ে কলকাতায় ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহিদ দিবস উদ্যাপন করেছিলেন। কিন্তু নিজেদের আন্দোলনের সময়ে পাশে পাননি এখানকার কাউকেই। আলাদা রাজ্য পেলেই আত্মপরিচয় মিলবে কি না, তা জানেন না, কিন্তু খোঁজের তাগিদটা ওঁদের কাছে খুব জোরদার। |