প্রবন্ধ ১...
পরিণাম বেঁধে দিলে আলোচনা হয় না
শ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের নিরিখে দার্জিলিং পার্বত্যাঞ্চলের সমস্যা সমাধান আজ সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এক অর্থে, আলাপ-আলোচনার পথে দার্জিলিং সমস্যার আশু সমাধান হবে কি না, তার ওপর নির্ভর করবে কথাবার্তার রাজনীতি এবং আলাপচারী প্রশাসনরীতি কতটা সফল হবে। এও বলা যায়, সম্ভবত প্রশাসনরীতির উদ্ভাবন, বিকাশ এবং গণতন্ত্রীকরণের জন্য জঙ্গলমহলের কৃষক বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনা ফের শুরু করা যত জরুরি, এ ক্ষেত্রেও সেই প্রয়োজন কম নয়। দার্জিলিং সমস্যা এবং আন্দোলনের ইতিহাসে বর্তমান ক্ষণকে নানা দল নানা ভাবে দেখছেন। কেউ বিদ্রুপ করেছেন, পাহাড়ের হাসি অট্টহাসিতে পরিণত। কেউ বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে দার্জিলিং পার্বত্যাঞ্চলকে স্বতন্ত্র রাজ্যে পরিণত করা দরকার। কেউ বলেছেন, পাহাড়ের আবেগ সরকারকে উচিত শিক্ষা দিয়েছে। আর সবাই গায়ত্রী মন্ত্র আউড়েছেন যে, প্রশাসনিক কঠোরতা ত্যাগ করে কথাবার্তা শুরু করা দরকার, যে চেষ্টা সরকার করছেন না।
এই সব মন্তব্যের কোথাও কোথাও কিছু সত্য আছে। দমনপীড়নের পথ ত্যাজ্য। এও ঠিক যে, গোর্খাল্যান্ড প্রশ্নটি হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার স্বার্থে ব্যবহৃত হতে পারে। কিন্তু লক্ষণীয়, কী নিয়ে আলাপ-আলোচনা হতে পারে, আলোচনার ন্যূনতম ভিত্তি কী হতে পারে, কী আধারে আলোচনার পুনর্যাত্রা সম্ভব, তা নিয়ে কেউ কিছু বলছেন না। রাজনৈতিক দলগুলির আচরণে সংকীর্ণতারই ছাপ। মূল বিষয়ে সবাই নির্বাক। গণপ্রশাসনের নিরিখে এ যে এক অগ্নিপরীক্ষা, তা কত জন উপলব্ধি করছেন?
ভাগ করে দেওয়াই কি একমাত্র পথ? পাহাড়ে জনসভায় বিমল গুরুঙ্গ।
রাজনীতি এবং প্রশাসনিকতায় কথাবার্তার স্থান একই সঙ্গে স্বাভাবিক এবং দ্বন্দ্বময়। কথাবার্তা শুরু করা মানে প্রতিদ্বন্দ্বীকে স্বীকৃতি দেওয়া। এর অর্থ, একাধিক সমাধানের সম্ভাবনাকে মেনে নেওয়া। অস্ত্র এবং দমনের পথ থেকে সরে আসা। রাজনীতিতে চূড়ান্ত কোনও সমাধান নেই। যা সম্ভাব্য, সে সম্পর্কে জ্ঞান এবং তৎসম্পর্কিত কৃৎকৌশল উপলব্ধি করাই হল রাজনীতি। রাজনীতি মানে ক্ষমতার দাপটে রাষ্ট্র পরিচালনার পথ থেকে সরে এসে বিবাদের বিষয়টিকে কথাবার্তার বিষয়ে রূপান্তরিত করা।
আপত্তি উঠতে পারে, এ তো হল নীতিকথা। কথাবার্তা, আলাপচারিতা এবং পরামর্শ গণরাজনীতির মূল সম্পদ হয়ে উঠবে, এমন নিশ্চয়তা বা গ্যারান্টি কোথায়? ঠিকই, এর কোনও গ্যারান্টি নেই। কিন্তু বাংলার ইতিহাস কথাবার্তার সংস্কৃতির অগ্রগতির ইঙ্গিত দেয়। কোনও এক স্বদেশি যুগে চিত্তরঞ্জন দাশ ফজলুল হকের কথাবার্তা চলেছিল, যা বেঙ্গল প্যাক্ট নামে খ্যাত, যদিও তা স্থায়ী রূপ পায়নি। সাতচল্লিশে বাংলা ভাগও হয়েছে। কিন্তু আন্দামান, বক্সা, দেউলি সহ নানা বন্দিশিবির এবং কারাগারে কমিউনিস্ট এবং সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের আলোচনা তো এক সফল উদাহরণ। তেমনই এক সফল উদাহরণ অগ্নিযুগের নানা বিপ্লবী দলের কথোপকথন অথবা তাদের সঙ্গে সত্যাগ্রহীদের মতবিনিময়। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে নানা মত ও পথের প্রতিনিধিদের নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গড়ে উঠেছিল আলাপচারী সংস্কৃতিকে অবলম্বন করে। কথাবার্তা বাদ দিয়ে কোথাও গণরাজনীতি এবং গণপ্রশাসন বিকশিত হয়নি। আবার এটাও বোঝা দরকার, কথাবার্তা হল প্রতিদ্বন্দ্বীদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক মধ্যবর্তী অবস্থান। কথাবার্তার লক্ষ্য হল ন্যূনতম, সামাজিক ন্যায় অথবা ন্যূনতম ন্যায় অর্জন করা। চরম লক্ষ্যে কথাবার্তা এগোয় না।
এই ন্যূনতম লক্ষ্য স্থির হবে অথবা অর্জিত হবে কী করে? এর নিশ্চয়ই কিছু নীতি আছে। যেমন, ঐতিহাসিক ভুল বা অন্যায়কে স্বীকার করা, এই স্বীকৃতির ভিত্তিতে নতুন পদক্ষেপে সম্মত হওয়া, নতুন পদক্ষেপের অঙ্গীকার দেওয়া, ইত্যাদি। ন্যূনতম ন্যায়ের পথে সচেষ্ট থাকলে মধ্যবর্তী অবস্থান খুঁজে পাওয়া যায়। সহমতের ক্ষেত্র প্রসারিত হয়। অন্তত কিছুটা সমাধান হোক এই মতের পথিকের সংখ্যা বাড়ে। পরিণামে, কথাবার্তার পথ শক্তিশালী হয়।
তবু এ পথ সম্পূর্ণ ‘স্বাভাবিক’ নয়। কথাবার্তার কাঠামোর সঙ্গে ক্ষমতা-কাঠামোর সম্পর্ক গভীর। কী ভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করা হবে, সেই ক্ষমতার চরিত্র ও গঠনের উপর নির্ভর করে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কথাবার্তা শুরু হবে কি না, সে পথে প্রতিদ্বন্দ্বীরা ব্রতী থাকবেন কি না কথাবার্তার রাজনীতিতে এগুলো বড় প্রশ্ন।
যদি পাহাড়ের নেতৃবৃন্দ বলেন, আমরা রাজ্যের সঙ্গে কথা বলব না, তবে আলোচনা শুরু হবে কী করে? অথবা ভারতের রাজ্যগুলোর চেহারা দুমড়ে-মুচড়ে, জুড়ে দিয়ে বা বিভক্ত করে দেশ চালানোর একচেটিয়া অধিকার যদি কেন্দ্রের থাকে, তা হলে যুক্তরাষ্ট্রীয় কথোপকথন কী ভাবে সম্ভব? স্বায়ত্তশাসনের পথ কী? জাতিসত্তার অধিকারকে আর কোন রাজনৈতিক ঔচিত্যের সঙ্গে মেলাতে হবে? ভাগ করে দেওয়াই কি সব বিবাদের সমাধানের একমাত্র পথ? কেন এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করা যাবে না? সর্বোপরি যাঁরা নিজেদের জন্য স্বায়ত্তশাসন এবং স্বাধিকার দাবি করেন, তাঁরা নিজস্ব অঞ্চলের অন্যান্য গোষ্ঠীর সমচরিত্রের দাবি মানবেন কি? এ সবই কথাবার্তার বিষয়। আলোচনার বিষয়।
কথাবার্তার তাই যেমন বহিরঙ্গের বাধ্যবাধকতা আছে, তেমনই অন্তরঙ্গেও একই নীতি চলতে থাকে। একই প্রক্রিয়া। যাঁরা দেশের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন, তাঁদের প্রশ্ন করা হয়েছিল, তোমরা দলিতদের ন্যায়ের দাবি, সংখ্যালঘুদের রক্ষার দাবি, জনজাতির স্বায়ত্তশাসনের দাবি, এবং যারা এক হতে চায় না বরং স্বাতন্ত্র্য এবং স্বাধিকার চায়, তাদের দাবি মানবে তো? গণতন্ত্রের তাই একটাই চরিত্র তাকে ক্রমাগত আশু এবং গভীর দুইই হতে হবে। কথাবার্তা এবং ন্যূনতম লক্ষ্য অর্জন এই সীমাহীন প্রক্রিয়ারই এক-একটা ক্ষণ বা মুহূর্ত।
কিন্তু একই সঙ্গে স্বীকার করতে হবে যে, সেই ক্ষমতাই কথাবার্তাকে উৎসাহ দিতে এবং প্রশ্রয় দিতে পারে, যার সমাজের উপর নেতৃত্ব এবং আধিপত্য আছে, এবং যা কথাবার্তার সম্ভাবনায় ভীত নয়। পশ্চিমবঙ্গের নানা সমস্যায় কথাবার্তার পথ নেওয়ায় নির্ভীকতা দরকার। সেই ক্ষমতাকে যেমন ভয়হীন হতে হবে, তেমনই প্রয়োজন কঠোর হতে হবে। গণক্ষমতার এই বৈশিষ্ট্যকে লক্ষ্য রেখেই বোধহয় লু সুন বলেছিলেন, শিশুর কাছে আমি বাধ্য গাভী, দুর্বিনীতের কাছে আমি ক্রুদ্ধ ষাঁড়।
গোর্খাল্যান্ড আঞ্চলিক পরিষদ যদি সফল হয়, তবে কথাবার্তার রাজনীতি জয়ী হবে। আঞ্চলিক পরিষদের সাফল্যের একটা শর্ত হল, দার্জিলিঙের বর্তমান নেতৃবৃন্দের হাতে ক্ষমতার ফিরে যাওয়া, তাঁদেরও মধ্যবর্তী অবস্থান গ্রহণে সম্মত হওয়া। অতীতের দাবি বর্তমান সমাধানের সম্পূর্ণ পথ না-ও হতে পারে। কারণ, গোর্খাদের ইতিহাস, ওই অঞ্চলের ইতিহাস, জাতিসত্তার দাবির ইতিহাস যেমন আছে, তেমনই আছে সহাবস্থানের দীর্ঘ ইতিহাস এবং চল্লিশ থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত পাহাড় ও তরাই জুড়ে নেপালি ভাষাভাষী চা-শ্রমিক, আদিবাসী আধিয়ার, অন্যান্য জাতিসত্তা ও সম্প্রদায়ের সম্মিলিত সংগ্রামের ইতিহাস। পরিচয়ের নানা রূপ আছে, নানা রূপ আছে ইতিহাসেরও।
গণতন্ত্রীকরণের একটি দিক হল বহু ইতিহাসের উপস্থিতি। তাই এই পথে ভাবলে আরও প্রশ্ন উঠবে: তরাই এবং পার্বত্যাঞ্চলের সমস্যা কি এক? তবে কী ভিত্তিতে এই সমগ্র এলাকা নিয়ে গোর্খা আঞ্চলিক পরিষদ গঠন হবে? আদিবাসী জনসাধারণের অধিকার কী ভাবে রক্ষিত হবে? লেপচাদের আত্মশাসনের অধিকার নিশ্চয়তা পাবে কী করে? এই সব প্রশ্নকে ঘিরে আলোচনার পথ ধরেই আঞ্চলিক পরিষদের গণতন্ত্রীকরণ হতে পারে। শুধু জাতি-পরিচিতি-ভিত্তিক রাজনীতি হল শাঁখের করাত। দু’দিকেই কাটে। জাতীয় আন্দোলনের কালে আমরা তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলাম, আজও বুঝছি। নেপালে বিপ্লবীরা জাতি-পরিচিতিকে সম্বল করে যুক্তরাষ্ট্রীয়করণের যে পথ ধরেছিলেন, তার সমস্যাও আজ সকলের নজরে এসেছে।
আলোচনা তাই কখনও একমাত্রিক হতে পারে না। কথাবার্তার বহুমাত্রিকতার স্বীকৃতি গণতন্ত্রকে প্রসারিত করবে। এ পথে এগোতে গেলে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দৃঢ়তা দরকার। নিপীড়ন নয়, দৃঢ়তা। এবং গণতন্ত্রের সম্ভাবনা সম্পর্কে বাস্তব উপলব্ধি। নইলে পশ্চিমবাংলা সহ দেশের নানা অংশের জনগণকে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাকাঠামোর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে। বলতে হবে: আমরা নিজেদের মধ্যে কোনও কথা বলব না, আমরা কেন্দ্রের সন্তান; কেন্দ্র, আমাদের বাঁচাও। এ মনোভাব হয়ে ওঠে স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তি।
দার্জিলিঙে আঞ্চলিক স্বশাসন তাই কথাবার্তার রাজনীতির সাফল্যের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ। গণতন্ত্রের কাছে তা এক অগ্নিপরীক্ষা।

সমাজতাত্ত্বিক, ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ-এর অধিকর্তা।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.