রাত আটটার পরে পেট্রোল পাম্প বন্ধ হয়ে যাবে শুনে টুইটারে চেতন ভগতের অবাক মন্তব্য, ‘মানুষ তো পেট্রোল কিনতে যাচ্ছে। হুইস্কি নয়!’ লেখক চেতন একা নন। আমজনতা থেকে রাজনীতিক, সকলের প্রশ্ন, জ্বালানির খরচ কমাতে এর পরে কি মদের দোকানের মতো পেট্রোল পাম্পেও ‘ড্রাই ডে’ চালু হবে!
দিনভর সমালোচনা আর প্রশ্নের মুখে নিজের পরিকল্পনা থেকে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে দাঁড়ালেন পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী বীরাপ্পা মইলি। রবিবার তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন, পেট্রোল-ডিজেলের চাহিদা কমাতে রাত ৮টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত পেট্রোল পাম্প বন্ধ রাখা হোক। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দফতর ও অর্থ মন্ত্রক সেই প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছে। সাধারণ মানুষের এতে হেনস্থা বাড়বে বলেও অভিযোগ উঠেছে। চাপের মুখে বিকেলে পেট্রোলিয়াম মন্ত্রক জানিয়ে দেয়, পেট্রোল পাম্প খোলা রাখার সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার কোনও প্রস্তাব নেই।
রাতে পেট্রোল পাম্প বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাঁড়ালেও অদূর ভবিষ্যতেই ফের জ্বালানির দাম বাড়াতে চলেছে মনমোহন-সরকার। অপেক্ষা শুধু সংসদের অধিবেশন শেষ হওয়ার। শনিবার রাতেই পেট্রোলের দাম লিটার পিছু দাম বাড়ানো হয়েছে ২.৩৫ টাকা। ডিজেল বেড়েছে ৫০ পয়সা। সংসদের অধিবেশন চলায় ডিজেলে খুব বেশি হাত দেওয়া যায়নি। তা সত্ত্বেও আজ সংসদে বিজেপি-বাম-তৃণমূলের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে সরকারকে। আজ সকালেই রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যানের কাছে নোটিস দিয়ে তৃণমূল অন্য সমস্ত বিষয় স্থগিত রেখে শুধু তেলের দাম নিয়ে আলোচনার আর্জি জানিয়েছিল। কিন্তু সেই আর্জি খারিজ করে দেওয়া হয়। তখন ডেরেক ও’ ব্রায়েন, সুখেন্দুশেখর রায়ের মতো তৃণমূল সাংসদরা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে ‘নীরব প্রতিবাদ’ জানান।
তবে পেট্রোলিয়াম মন্ত্রক সূত্রের খবর, সংসদের অধিবেশন শেষ হলেই ডিজেলের দাম লিটার পিছু ৩ থেকে ৫ টাকা বাড়াতে চলেছে সরকার। কারণ, ডলারের তুলনায় টাকার দাম এতটাই পড়েছে যে, এই পরিমাণ দাম না বাড়িয়ে উপায় নেই। সেই সঙ্গে সিরিয়ায় যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম বেড়েছে। তেল সংস্থাগুলির এখন প্রতি লিটার ডিজেলে ১২ টাকা হারে ক্ষতি (আন্ডার-রিকভারি) হচ্ছে। ডিজেলের সঙ্গে আর এক দফা পেট্রোলের দাম বাড়ানোর সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
গত অর্থ বছরে (২০১২-’১৩) অশোধিত তেল আমদানি করতে মনমোহন-সরকারকে ১৪ হাজার ৪২৯ কোটি ডলার ব্যয় করতে হয়েছে। কিন্তু এ বছর চলতি খাতে বাণিজ্যিক ঘাটতি অর্থাৎ বিদেশি মুদ্রা আয়-ব্যয়ের ফারাক কমাতে চাইছেন মনমোহন সিংহ-পি চিদম্বরম। জ্বালানির খরচ কমানোর পথ খুঁজতে পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের কাছে নির্দেশ গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের নির্দেশ, অন্তত আড়াই হাজার কোটি ডলার সাশ্রয় করতে হবে। তাই মরিয়া হয়ে পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী মইলি রাতে পেট্রোল পাম্প বন্ধ রাখার উপায় ভেবেছিলেন। কিন্তু তাতেই বিপত্তি বাধে। এই ভাবে আদৌ চাহিদা কমানো যাবে কি না, তা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। ডেরেক ও’ব্রায়েন কটাক্ষ করেন, “কেন্দ্রীয় সরকারও তা হলে আট ঘণ্টার বদলে চার ঘণ্টা করে কাজ করুক। দুর্নীতি কম হবে।” আর এক তৃণমূল সাংসদ সুখেন্দুশেখরবাবু বলেন, “কেন্দ্র সাধারণ মানুষের রান্নাঘরের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এটা মানা যায় না।”
গোটা বিষয়টাকে সরকারের অর্থনীতি পরিচালনার ব্যর্থতা হিসেবেই দেখছেন বিজেপি ও অন্য বিরোধী দলের নেতারা। বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী ব্লগে লিখেছেন, “আমাদের প্রধানমন্ত্রী নীরব থাকাই শ্রেয় মনে করেন। আর অর্থমন্ত্রী দোষ দিচ্ছেন তাঁর পূর্বসূরিকে।”
চাপের মুখে ডিগবাজি খেলেও এমন একটা প্রস্তাব যে ছিল, তা অবশ্য পরোক্ষে স্বীকার করে নিয়েছেন মইলি। তবে তাঁর দাবি, “এটা আমাদের ভাবনা ছিল না। সাধারণ মানুষ এবং সংশ্লিষ্ট মহলের তরফেই এমন ভাবনা এসেছিল। অনেকগুলি প্রস্তাবের মধ্যে এটাও ছিল। কিন্তু এমন কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।” সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে গেলেও আজ তেল-মন্ত্রী সাধারণ মানুষের কাছে জ্বালানি সংরক্ষণ করার জন্য আবেদন জানিয়েছেন। জ্বালানি সংরক্ষণের জন্য দেশ জুড়ে প্রচারের পরিকল্পনাও প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়েছেন তিনি।
অর্থনীতিবিদরা অবশ্য মনে করছেন, এই ভাবে আবেদন করে কিংবা প্রচার চালিয়ে তেল পোড়ানো কমানো যাবে না। এর আগে সোনার আমদানি কমানোর জন্য চিদম্বরম একাধিক বার সাধারণ মানুষের কাছে সোনা কম কেনার আবেদন জানিয়েছিলেন। লাভ হয়নি। সেই শুল্ক বাড়িয়েই আমদানি কমানোর চেষ্টা করতে হয়েছে। পেট্রোল-ডিজেলের ক্ষেত্রেও তাই দাম বাড়ানোটাই একমাত্র উপায় বলে মনে করছেন তাঁরা। তা হলেই মানুষ গাড়ি ছেড়ে বাস-মেট্রোর মতো গণ-পরিবহণ ব্যবস্থা ব্যবহার কমবেন। পেট্রোপণ্যের চাহিদা কমবে। অর্থনীতিবিদেরাও মনে করছেন, পেট্রোল পাম্প বন্ধ রেখে ব্যবহার কমাতে গেলে মানুষের হেনস্থা বাড়বে। লাভের লাভ কিছু হবে না। কারণ, দিনের বেলায় যে কেউ যত ইচ্ছে তেল ভরে নেবে। উল্টে রাতে কালোবাজারি চালু হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন পেট্রোলিয়াম-বিশেষজ্ঞ নরেন্দ্র তানেজা। এই পরিস্থিতিতে জ্বালানি আমদানির খরচ কমাতে আর একটি প্রস্তাব দিয়েছেন মইলি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁর প্রস্তাব, আমেরিকার হুঁশিয়ারি অগ্রাহ্য করেই ইরান থেকে তেল আমদানি করা হোক। সেখানকার অশোধিত তেলের দাম কম। চলতি অর্থ বছরের বাকি সময়টুকু ইরান থেকে ১ কোটি ১০ লক্ষ টন তেল আমদানি করলে ৮৫০ কোটি ডলার সাশ্রয় হবে।
|