সুপ্রকাশ চক্রবর্তী ও অরুণ মুখোপাধ্যায় • কলকাতা |
জঙ্গলমহলের ধাঁচে বীরভূমের আদিবাসী অধ্যুষিত সাতটি ব্লকেও বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্প রূপায়ণের সিদ্ধান্ত নিল রাজ্য সরকার। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে বীরভূমের পিছিয়ে থাকা ওই এলাকার সার্বিক উন্নয়নে ১৪ দফা ‘প্যাকেজ’ তৈরি করা হয়েছে। কর্মসংস্থান থেকে পানীয় জল, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো সব রকম জরুরি ক্ষেত্রেই জোর দেওয়া হয়েছে ওই প্যাকেজে।
ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া বীরভূমে বাম আমলে একাধিক বার মাওবাদী নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। অতীতে অনিয়মিত ভাবে মাওবাদী পোস্টারও পড়েছে। যদিও পুলিশ প্রথম দিকে ওই সব পোস্টারকে আমল দেয়নি বলেই অভিযোগ। পরে অবশ্য কয়েকটি হিংসাত্মক ঘটনায় তাদের টনক নড়ে। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে খয়রাশোল ভীমগড়া ও পাঁচড়া রেল লাইনের মাঝে মাওবাদীরা বিস্ফোরণ ঘটায়। ২০০৮ সালে রাজনগর থানায় পাঁচ মাসের ভেতরে দুই সিপিএম নেতাকে খুন করে দায় স্বীকার করে মাওবাদীরা। পরবর্তী সময়ে রাজনগর, দুবরাজপুর, মুরারই ১, নলহাটি ১, রামপুরহাট ১, মহম্মদবাজার, খয়রাশোল এই সাতটি ব্লককে মাওবাদী প্রভাবিত হিসেবে ঘোষণা করে রাজ্য সরকার। |
তবে অতি সম্প্রতি মাওবাদী হামলায় ঝাড়খণ্ডের পাকুড়ের পুলিশ সুপার খুন হওয়ার পরেই নড়েচড়ে বসে বর্তমান রাজ্য সরকার। বীরভূমে তড়িঘড়ি দু’ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়। মাওবাদী প্রভাবিত ঝাড়খণ্ড লাগোয়া বীরভূমের সাত ব্লকে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে জেলা পুলিশ-প্রশাসনও। গোয়েন্দা পুলিশের দাবি, বীরভূমের আদিবাসী অধ্যুষিত বিস্তীর্ণ এলাকাগুলিতে ছড়িয়ে রয়েছে মাওবাদীরা। আপাতত এ রাজ্যে নিষ্ক্রিয় থাকলেও সীমানা পেরিয়ে ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে তারা তৎপর রয়েছে।
বর্তমান রাজ্য সরকার মনে করে, মাওবাদী তৎপরতা রুখতে শুধু পুলিশি ব্যবস্থাই যথেষ্ট নয়। চাই এলাকার মানুষের সার্বিক উন্নয়ন। সরকারি মহলের মতে, বীরভূমের পশ্চিমাংশ তুলনায় অনগ্রসর। এমনকী, ঝাড়খণ্ডের মশানজোড় বাঁধের জল এই এলাকার উপর দিয়ে বীরভূমের পূর্বাংশ এবং মুর্শিদাবাদে সেচের সুযোগ করে দিলেও বীরভূমের পশ্চিমাংশের মানুষ সেচের জলের সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এক রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলছেন, “বীরভূমের জন্য ১৪ দফা প্যাকেজে দু’টি থানাকে ভেঙে চারটি থানা গড়ার প্রস্তাব থাকলেও, বাকি প্রস্তাবগুলি উন্নয়ন সংক্রান্তই।” |
কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রকল্প |
• রাজনগর, খয়রাশোল ভেঙে নতুন থানা চন্দ্রপুর ও লোকপুরে।
• সাত ব্লকেই সিভিল পুলিশ নিয়োগ।
• আইআরবি-র স্থায়ী ভবন নির্মাণ।
• আদিবাসী মানুষকে সস্তায় খাদ্যশস্য সরবরাহ।
• আদিবাসী মেয়েদের সাইকেল বিলি।
• রাজনগরে ও খয়রাশোলে ন’কোটি টাকার ব্যয়ে জলপ্রকল্প রাজনগরে নতুন আইটিআই।
• বৃষ্টির জল ধরে সেচের কাজে ব্যবহারের জন্য প্রকল্প।
• অনগ্রসর অঞ্চল অনুদান তহবিলে আড়াই হাজার গ্রামীণ আবাসন।
• পাথর শিল্পাঞ্চলে যুক্ত শ্রমিকদের স্বাস্থ্য বিমা ও অন্যান্য সুযোগ-সহ বিশেষ কল্যাণ প্রকল্প। |
|
প্রশাসন সূত্রে খবর, জঙ্গলমহলের ব্লকগুলিতে মাওবাদী মোকাবিলায় উন্নয়নকেই হাতিয়ার করেছে রাজ্য। বীরভূমেও সেই রূপরেখা নিয়েই এগোতে চাইছেন তারা। উন্নয়নে জোয়ার এনে ওই সব এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থা বদলে দিতে সরকার বিশেষ পরিকল্পনা নিয়েছে। জেলা প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “ওই ব্লকগুলিতে জঙ্গলমহলের বাসিন্দাদের মতোই ২ টাকা কেজি দরে চাল দেওয়া হবে। বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে একশো দিনের কাজে। এলাকার রাস্তা, পানীয় জল, স্বাস্থ্য পরিষেবা, স্কুলে উন্নত মানের পঠনপাঠন, বার্ধক্য ভাতা, পেনশন প্রভৃতি যাবতীয় ক্ষেত্রে যেন গলদ না থাকে, তার জন্য প্রশাসন তৎপর হচ্ছে।” এ ছাড়াও আদিবাসী অধ্যুষিত পাথর শিল্পাঞ্চলগুলিতেও উন্নয়ন পৌঁছে দিতে এ বার বিশেষ ভাবে উদ্যোগী হবে বর্তমান সরকার।
ঢেলে সাজা হবে সাতটি ব্লকের থানাগুলিকেও। ইতিমধ্যেই রাজনগর ও খয়রাশোল থানাকে ভেঙে আরও দু’টি নতুন থানা গড়ারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বীরভূমের পুলিশ সুপার সি সুধাকর বলেন, “ওই সাতটি ব্লকের থানাগুলিকে ঢেলে সাজার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। ওই সব থানায় আধুনিক অস্ত্র এসেছে। পুলিশকেও বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।” |