বেশি বৃষ্টি হলেই পুর এলাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলে ডুবে যায়। ফি বছর বর্ষা এবং নিম্নচাপের বৃষ্টিতে জলবন্দি হয়ে পড়াটা নিজেদের ভবিতব্য হিসাবেই ধরে নিয়েছেন উত্তর ২৪ পরগনার হাবরা পুরসভা এলাকার বাসিন্দারা। সুষ্ঠু নিকাশি না থাকাতেই যে বছরের পর বছর তাঁদের এই দুর্ভোগ তা নিয়ে তাঁরা অভিযোগের আঙুল তুলেছেন পুর কর্তৃপক্ষের দিকেই। তাঁদের অভিযোগ, কি বাম কি তৃণমূল, যে দলই পুরসভায় ক্ষমতায় থাকুক না কেন, পুর এলাকার নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতির দিকে কোনও নজরই দেয়নি।
১৯৭৯ সালে পুরসভা হিসাবে হাবরার আত্মপ্রকাশের পরে সরকার মনোনীত বোর্ড পুরসভা চালাত। প্রায় দশ বছর পর ১৯৮৮ সালে প্রথম পুর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। |
নির্বাচনে জয়ী হয় সিপিএম। এর পর কখনও বামেরা, কখনও বামবিরোধীরা ক্ষমতা দখল করলেও নিকাশি সমস্যার কোনও সমাধান হয়নি। পুর এলাকার বাসিন্দাদের বক্তব্য, “এর আগে যতবার পুর নির্বাচন হয়েছে, প্রতিবারই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে নেতারা এসে প্রচারে নিকাশি সমস্যার সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু তা যে নেহাতই কথার কথা তা তাঁরা দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে টের পেয়েছেন এবং পাচ্ছেন। বাম, ডান সকলের কাছেই তাঁদের আবেদন, শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, যেন সত্যিকারের কাজ করার ইচ্ছা নিয়েই যেন তাঁরা ভোট চাইতে নামেন। কারণ দিনের পর দিন মিথ্যা প্রতিশ্রুতি তাঁদের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে দিয়েছে।
সুষ্ঠু নিকাশি ব্যবস্থা না থাকার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন এলাকায় জলাভূমি ভরাট করে বেআইনি নির্মাণ চলছে অবাধে। নিকাশি ব্যবস্থার বেহাল ছবিটা খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, শহরের জল নিকাশির প্রধান উপায় পদ্মা খালের মৃতপ্রায় অবস্থা। প্রবীণ এক পুরবাসীর কথায়, “এক সময় এই খাল দিয়ে নৌকা চলাচল করত। স্রোতও ছিল যথেষ্ট। অনেকে এই জলপথে যাতায়াতও করতেন। ধীরে ধীরে শহর বাড়ল, জনসংখ্যা বাড়ল। দখল হতে থাকল খালের দু’পাশ। সংস্কারের অভাবে ক্রমশ মজে যেতে থাকল খাল। কিন্তু তাতে নজরই দিল না প্রশাসন। ফলে যা হওয়ার তাই হল। খাল সরু হতে হতে পরিণত হয়েছে নালায়। ক্ষমতা হারাল জল নিকাশির।” প্রবীণ পুরবাসীর কথার প্রমাণ পেতে পদ্মা খালের বর্তমান চেহারাটাই যথেষ্ট। খালের দু’পাশের জমি দখল করে উঠে গিয়েছে বাড়িঘর। স্থানীয় ভাবে লোক এখনও পদ্মা খাল বললেও তা হয়ে গিয়েছে নালা। এলাকার মানুষের অভিযোগ, খালের দু’পাশের জমি দখল করে নির্মাণে সব রাজনৈতিক দলেরই মদত থাকায় তা বাধা দিতে কেউই এগিয়ে আসেনি। অথচ এই খাল দিয়েই পুর এলাকার জমা জল বেরিয়ে যাওয়ার কথা। এই খাল ছাড়াও শহরে একটি বড় বিল রয়েছে। জল নিকাশির সেটাও অন্যতম উপায় ছিল। কিন্তু তারও অবস্থা পদ্মা খালের মতোই। বিল বুজিয়ে নির্মাণ কাজ চললেও সেদিকে প্রশাসনের নজর নেই। শুধু নিকাশির সমস্যাই নয়, বিল ক্রমশ বুজিয়ে ফেলার ফলে পরিবেশগত ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে বলে বাসিন্দাদের দাবি। পাশাপাশি থেমে নেই পুকুর ভরাটও। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যাতে পুরসভার কোনও অনুমতিই নেই। আবার এ সব বন্ধ করতেও পুরসভার তরফে কোনও উদ্যোগ নেই। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে জলা বুজিয়ে এলাকায় একটা আস্ত খেলার মাঠ তৈরি হয়ে গিয়েছে। নিকাশি নিয়ে পুরকর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকে কটাক্ষ করে এক বাসিন্দা জানান, জল জমলে এখন রোদের মুখ চেয়েই বসে থাকতে হয় তাঁদের। |
পুরভোটে হাবরা |
“তৃণমূল পরিচালিত পুরবোর্ড মাস্টার প্ল্যান ছাড়াই কিছু নিকাশি নালা তৈরি করেছে।
সেগুলি দিয়ে জল নিকাশি হয় না।”
ঋজিনন্দন বিশ্বাস
(পুরসভায় বিরোধী দলনেতা) |
“সিপিএমের আমলে পদ্মা খালের অস্তিত্ব যে ভাবে বিপন্ন হয়েছে,
তাতে তাকে আর পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।”
জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক
(তৃণমূলের জেলা পর্যবেক্ষক) |
|
শহরে জল জমে যাওয়ার কারণ হিসাবে কয়েকজন প্রবীণ বাসিন্দা জানান, হাবরা শহরের আকৃতি অনেকটা কড়াইয়ের মতো। তাই অল্প বৃষ্টিতেই জল জমে যায়। জমা জল বের করার জন্য খাল সংস্কার, জলা ভরাট বন্ধ করা, নিকাশি নালার জন্য মাস্টার প্ল্যান কিছুই হয়নি আজ পর্যন্ত। সময়ে সময়ে পুরসভায় ক্ষমতার হাত বদল হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতির বদল ঘটেনি।
ইতনা কলোনি, জয়গাছি, কামারথুবা, আয়রা, নগরথুবা, হাটথুবা, বাণীপুর, উত্তর হাবরার মতো এলাকা সামান্য বৃষ্টি হলেও জলমগ্ন হয়ে পড়ে। দিনের পর দিন জল না সরায় দুর্গতদের জন্য ত্রাণ শিবির খুলতে হয়। হাবরা শহরের অন্যতম বড় রাস্তা হাবরা-নগরউখরা সড়ক। বৃষ্টি হলেই সড়ক চলে যায় এক হাঁটু জলের নীচে। যদিও পুর কর্তৃপক্ষের দাবি জল নিকাশির জন্য কিছু নিকাশি নালা তৈরি করা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, অপরিকল্পিত ভাবে ওই সব নালা তৈরি হওয়ায় সেগুলি মাধ্যমে জল বেরোতে পারে না। তার উপর কোনও সংস্কার না হওয়ায় নালাগুলিতে নোংরা, আবর্জনা জমে অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর জমা জল সরতে না পারায় তা মশার বংশবৃদ্ধির উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে। ফলে মশাবাহিত রোগেও ভুগতে হচ্ছে বাসিন্দাদের। পুরসভার বিদায়ী বিরোধী দলনেতা সিপিএমের ঋজিনন্দন বিশ্বাসের অভিযোগ, “তৃণমূল পরিচালিত পুরবোর্ড গত পাঁচ বছরে পরিকল্পনাহীন কিছু নিকাশি নালা তৈরি করেছে। কিন্তু মাস্টার প্ল্যান তৈরি না করে ওই সব নালা তৈরির ফলে সেগুলি দিয়ে জল নিকাশি হয় না। পাশাপাশি পুরসভার অনুমতি ছাড়া যে সব জলা ভরাট হয়েছে সে ক্ষেত্রেও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি পুরকর্তৃপক্ষ।” তাঁর দাবি, অশোকনগরের মানিকতলায় একটি খাটাল তৈরি হওয়ায় হাবরা শহরের জল বিদ্যাধরী খালে যাচ্ছে না।
বিরোধীদের এমন অভিযোগ সত্ত্বেও হাবরা শহরের নিকাশি ব্যবস্থা নিয়ে আশার কথা শুনিয়েছেন স্থানীয় বিধায়ক ও খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। তিনি বলেন, “জওহরলাল নেহরু ন্যাশনাল আরবান রিনিউয়াল মিশন প্রকল্পে মাস্টার প্ল্যান তৈরি করে ১৩৫ কোটি টাকা খরচ করে হাবরা শহরের নিকাশি ব্যবস্থা ঢেলে সাজা হচ্ছে। এই কাজের জন্য বরাদ্দের ৭৫ শতাংশ দিচ্ছে কেন্দ্র, ২৫ শতাংশ দেবে রাজ্য। সমীক্ষার কাজও শেষ হয়ে গিয়েছে। আগামী ২৫ নভেম্বর থেকে কাজ শুরু হবে।” তবে একই সঙ্গে তিনি বলেন, “সিপিএমের আমলে পদ্মা খালের অস্তিত্ব যে ভাবে বিপন্ন হয়েছে, তাতে তাকে আর পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।”
পুরসভার বিদায়ী চেয়ারম্যান তপতী দত্ত বলেন, “পুরসভায় তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে পুকুর বা জলাশয় ভরাটের কোনও অনুমতি দেওয়া হয়নি। বেশ কিছু নিকাশি নালা তৈরি করা হয়েছে। ১৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন প্রকল্পের কাজ শেষ হলে হাবরা শহরে নিকাশি সমস্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।” তিনি আরও জানান, হাবরা-নগরউখরা সড়ক পূর্ত দফতরের অধীন। রাস্তায় জমা জল বরে করতে হলে যে নালা তৈরি করতে হবে তা ঘরবাড়ির উপর দিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এটাই সমস্যা। বিষয়টি খাদ্যমন্ত্রী ও পূর্তমন্ত্রীকে বলা হয়েছে। পূর্ত দফতর বর্ষার পর কাজ শুরু করবে বলে জানিয়েছে। |