আমি বাল্মীকি হব এটাই আমার অ্যাম্বিশন
টেবিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জন্মদিনের অজস্র উপহার।
তোড়ায় বাঁধা গুচ্ছ গুচ্ছ রঙিন ফুল, মনে করিয়ে দিচ্ছে আজ এক আগুনের জন্মদিন।
আর এই আগুনের নাম নচিকেতা। গতকাল ছিল তাঁর জন্মদিন। জন্মদিনের উপহার হিসেবে ঘনাদার বই পেয়ে তিনি তো দারুণ খুশি। অন্য দিকে শুভেচ্ছার বার্তা বয়ে আনছে অগুন্তি ফোন। কিন্তু নীলাঞ্জনা আজ কী পাঠাল তাঁকে? ‘‘কিছুই না’’ জবাব তাঁর। অথচ নীলাঞ্জনার জন্যে মনে মনে সুর ভাঁজছেন তিনি, ‘মনে আসছে আমার উত্তাল সময়ের নীলাঞ্জনার কথা। আজ যদি দেখা হয় গাইব মান্না দে’র সেই গান

আজ আবার সেই পথে দেখা হয়ে গেল
কত সুর কত গান মনে পড়ে গেল
বলো ভাল আছো তো ...


গতকাল সকাল থেকেই বড় অস্থির ছিলেন তিনি। কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছেন সারা ক্ষণ। মনে হয় ভালবাসা খুঁজছেন। কখনও গিটার হাতে নিচ্ছেন তো কখনও আনন্দplus-এর ছবির জন্যে স্কিন হাগিং কালো গেঞ্জির ওপর চড়িয়ে নিচ্ছেন আকাশ রঙা নীল শার্ট। ফোনে ভক্তদের বলছেন, “এখনও অনেক পথ চলা বাকি।” কোথায় গেল সেই খালি গায়ে রঙিন স্যান্ডো গেঞ্জি চাপানো ছেঁড়া জিন্সের ঔদ্ধত্য? “ইদানীং একটু ভদ্র সভ্য হওয়ার চেষ্টা করছি। বয়স তো বাড়ছে,” বললেন তিনি।
জন্মদিনের ইচ্ছে নিয়ে আনন্দplus-কে এক্সক্লুসিভ গান উপহার দিলেন তিনি। গানখানা এই রকম—

আমার ইচ্ছে করে আকাশ-বাড়ির ছাদ ভেঙে বৃষ্টি আসুক, ভাসুক অবসাদ
আমার ইচ্ছে করে হাতের পাঁচিল দিয়ে তোকে জড়িয়ে থাকি সকাল থেকে রাত
আমার ইচ্ছে করে সকাল-চাদর হয়ে
রাতের কালো জাপটে ধরে রাখি
আমার ইচ্ছে করে বিধানসভায় গিয়ে দেওয়ালে অপুষ্টির ছবি আঁকি....


ভাব আর কল্পনার জগৎটাকেও এই মুহূর্তে গানের ভেতর দিয়ে বাস্তবের কঠিন সীমানায় পৌঁছে দিচ্ছেন তিনি। তাঁর সাম্প্রতিক গানে বারবারই ফিরে আসছে আজকের সমাজ, আজকের অবক্ষয়ের কথা। মুখোশ পরা ভণ্ড মানুষের দ্বিচারিতার কাহিনি। আড্ডা মারতে মারতেই বললেন, “আজকে একটা কথা খুব মনে হচ্ছে আমার। লং মার্চের সময় মাও জে দং কমরেডদের বলেছিলেন, ‘আমরা তো দেশটাকে জয় করতে চলেছি, তাই আমাদের আজকের জীবনের যা কিছু সঙ্গে আছে, তার সমস্ত কিছুকে জ্বালিয়ে সামনে এগোতে হবে।’ আমি গানের জন্যে সব কিছুকে জ্বালিয়ে দিয়েই বেঁচে আছি। সরকারি চাকরি পেয়েও তো কেবল গান গাইব বলে সে দিকে পা বাড়াইনি। রাজনীতি করার অবকাশও এসেছে আমার কাছে, কিন্তু গান আর রাজনীতি পাশাপাশি চলে না। তাই সে দিক থেকেও নিজেকে দূরে রেখেছি। আসলে ইদানীং গানটাকে খুব কম লোকেই পুরোপুরি আমাদের মতো প্রফেশন হিসেবে নেয়। রুটি আর রুচি যদি আলাদা হয়, চাকরি করে, অভিনয় করে দিনের শেষে গানের কথা ভাবলে নতুন গানের জন্ম হয় না। সেটা অন্য কিছু হয়। জুতোর দোকানও আছে, আবার গানও গাই এটা চলে না। মানুষ হয় জীবিত, নয় মৃত।”
এই জ্বালিয়ে দেওয়ার মন্ত্র দিয়েই প্রায় পাঁচ হাজার মানুষকে ঘিরে নচিকেতা তৈরি করেছেন এক দল। যার নাম ‘আগুন পাখি’। ফেসবুকের পাতায় তাঁরা সংঘবদ্ধ হন। নিজেদের চিন্তা- ভাবনা-প্রতিবাদ-সমবেদনা একে অপরের সঙ্গে ভাগ করে নেন।
“এক দিকে ভোগবাদ, অন্য দিকে পণ্য হয়ে যাওয়া গানের জন্য মনখারাপের দিনে আমার ‘আগুন পাখি’র দলই আমায় প্রতিদিন নতুন করে বাঁচতে শেখায়। এতগুলো মানুষ আমরা পরস্পর একে অপরের ভালবাসা আর দুঃখ নিয়ে স্বার্থপরের পৃথিবীতে পরিবারের মত বাঁচি। এই ‘আগুন পাখি’ই ভবিষ্যতে কোনও বিশেষ একটি রাজনীতির রং ছাড়াই একটা প্যারালাল পলিটিকাল পার্টির মতো কাজ করবে বলে আমার বিশ্বাস।” তিনি এ কথাও জানিয়ে দিলেন, এই পার্টির পয়সা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না, এই পার্টির ব্ল্যাঙ্ক চেকের নাম নচিকতা। জন্মদিনের পেলব মুহূর্তেও আগুন ঝরে যেন তাঁর কথায়।
কেবল আগুন জ্বালিয়ে দেওয়াই নয়, আগুন খুঁজে বের করে আনাও তাঁর আর এক নেশা। সেই নেশাতেই আবিষ্কার করেছিলেন শুভমিতাকে। ‘‘শুভমিতাকে লালন করেছি আমি। ও আমার মেয়ের মতো। আমার মেয়ে যদি শুভমিতার মতো হয়, তবে সবচেয়ে খুশি হব আমি। ওঁর জীবনেও অনেক না-খাওয়ার দিন কেটেছে। আশা করি মিডিয়াকে ও কোনও দিন সে কথা বলবে। অদ্ভুত একটা স্পার্ক ছিল ওর মধ্যে,” বলেন নচিকেতা। কিন্তু এও জানান, আজ কারও মধ্যে সেই আগুন খুঁজে পান না নচিকেতা। নিজের নতুন গানের অ্যলবামের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। ইচ্ছে আছে নিজের মেয়ে ধানসিড়িকে দিয়ে গান গাওয়ানোর।
জন্মদিনের সকালে কোনও বিতর্ক তৈরি করতে চান না তিনি। আর সেই কারণেই কবীর সুমন নিয়ে কোনও বক্তব্য রাখলেন না। কিছুতেই রাখলেন না। তবে বাংলা ছবির কথা বলতে গিয়ে ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে বললেন, ‘‘গত পঁচিশ বছরে সত্যজিতের পরে বাংলা ছবিতে ও রকম হিউমার আমার আর চোখে পড়েনি। আর কোনও বাংলা ছবি নিয়ে আমার কিছু বলার নেই।’’
চিকিৎসা বিভ্রাটে গত দু’বছর শারীরিক নানা ঝামেলায় জড়িয়ে ছিলেন তিনি। কিন্তু আজ জীবনের জন্যে, মেয়ের জন্যে মদ, সিগারেট দু’টোই ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। আসলে অমরত্বের লোভ ছুঁয়ে আছে তাঁর ‘এই বেশ ভাল আছি’-র জীবনে। এমন একটা আভাসই যেন ফিরে ফিরে আসে তাঁর কথায়।
গতকালের দিনটা তাঁকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল মৃত্যুর দিকে আরও একটা ধাপ এগিয়ে যাওয়ার কথাও। তবুও নিজের মধ্যে ডুবে ছিলেন তিনি। গাইছিলেন, ‘কী জানি কিসের লাগি প্রাণ করে হায় হায়’। জন্মদিনের সব হায় হায়ই ছিল হারানো দিনের জন্য।
আনন্দplus-এর তরফ থেকে পাঠানো জন্মদিনের কেক-য়ের সামনে
নচিকেতা বললেন, “আমি অলওয়েজ থার্টি প্লাস”। ছবি: কৌশিক সরকার
‘‘যদি আমার সেই হারানো দিনে চলে যেতে পারতাম আজ। তা হলে আবার নিজের ইচ্ছেমতো যা খুশি করা যেত। চাইলেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেতাম নিরুদ্দেশের পথে। আজও তো আমি খুঁজে ফিরি আমার সেই পাগলা জগাইকে। কিন্তু দেখতে তো পাই না। আজ সে কোথায়?’’ এত সাফল্যের পরেও কেন সেই ছন্দহীন, রং-চটা সময়ে ফিরে যেতে চাইছেন তিনি? ‘‘আসলে এ জীবনে সাফল্য আমায় ঘিরে রেখেছে। কিন্তু সাফল্য আর সার্থকতা এক নয়। আমি সার্থক কি না তা সময় বলবে।”
যে নচিকেতার প্রতিবাদের ভাষা এক সময় ছিল সোচ্চার, আজ তা নিঃশব্দ বিপ্লবের পথ নিয়েছে। কথায় কথায় গাইছেন ‘আমি সদা অচল থাকি, গভীর চলা গোপন রাখি’।
‘‘রবীন্দ্রনাথ বিষয়গত ভাবে এত আধুনিক অথচ আজও তাঁর গানে আধুনিক পরিবেশনা হল না? আজও লোকে ‘ওগো নদী আপন বেগে’ গানটা বাচ্চাদের গান ভেবে গায়!” বলেই গিটারের সুরে ঝঙ্কার তুললেন নচিকেতা ‘আমার চলা যায় না বলা...’
এ কোন নচিকেতা? গভীর চলার মধ্য দিয়ে জন্মদিনের সকালকে কী জানাতে চাইছেন তিনি? বললেন, “স্যাক্সোফোন ব্যবহার করতে হবে রবীন্দ্রনাথের গানে। আর আমাকেই সেটা করতে হবে। তবেই লোকে হিমেশ রেশমিয়া ছেড়ে রবীন্দ্রনাথ শুনবে,’’ তাঁর কথায় বেরিয়ে আসছে বাঁধ ভাঙার আওয়াজ।
ফেলে আসা সময়কে নিয়েই চলছেন নচিকেতা। মোহিত মঞ্চে প্রতিবারের মতোই আপামর ভক্তকুল সন্ধ্যায় তাঁর জন্মদিনকে ঘিরে নানা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি ছিলেন দর্শকের আসনে। ‘রাগরঞ্জনী’ সংস্থার উদ্যোগে জন্মদিনের ওই অনুষ্ঠানেই প্রকাশিত হল ‘বাল্মীকি প্রতিভা’র সিডি। সেই সিডিতে ধরা রইল নচিকেতার কণ্ঠে বাল্মীকির গান। জন্মদিনের এও এক নতুন চমক। জানালেন বাল্মীকির গান গাইতে গিয়ে নিজের জীবনের ভাঙাগড়াকে নতুন চোখে দেখতে পেয়েছেন তিনি। এ তো কেবল গান গাওয়া নয়। তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি ছিল, “আমিই তো বাল্মীকি, আমিই তো রত্নাকর।” শুধু বাল্মীকির গান গেয়েই থেমে থাকতে চান না। মঞ্চেও বাল্মীকির বেশে অভিনয় করতে ইচ্ছে হয় তাঁর। আড্ডার শেষে ফিরে এলেন আবারও নিজের লেখা নতুন গানের কথায়। আনন্দplus-য়ের উদ্দেশে তুলে দিলেন সেই গান।

তোর রাত জাগা চোখ,
জমানো শোক আমাকে দে
আর আমার আমাকে নতুন করে চিনিয়ে দে


অভিজ্ঞতার প্রলেপ পড়ছে তাঁর গানে, অনুভূতিতে, বোধে, লেখনীতে। আর অভিজ্ঞতা মানেই তো বয়স বাড়া। কিন্তু মোমবাতির আলোয় ফুঁ দিতে গিয়ে ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন সে কথা। বললেন, “বয়স-টয়স কিছুই বাড়ছে না। সব সময় আমার বয়স তিরিশ। থার্টি প্লাস বড়জোর!”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.