মুখ্যমন্ত্রীর কালিম্পঙের সভায় লোকসমাগম ঠেকানোর চেষ্টা করতে গিয়ে পাল্টা চাপের মুখে পড়ল গোর্খাল্যান্ড অ্যাকশন কমিটি। কারণ, শনিবার বন্ধ শিথিলের সুযোগ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সভার ৭২ ঘণ্টা আগেই কালিম্পঙে জমায়েত হয়ে গিয়েছেন লেপচা সম্প্রদায়ের অন্তত ৫ হাজার সদস্য। যে মেলার মাঠে অনুষ্ঠান হবে, তার আশেপাশে ‘ক্যাম্প’ করে, যৌথ রান্নাঘর খুলে টানা তিন দিন থাকার প্রস্তুতিও নিয়েছেন তাঁরা। রাত পর্যন্ত সেখানে ভিড় বাড়ছে। বাস-ট্রাক, ছোট গাড়ি বোঝাই করে খিচুড়ি, সবজি তৈরির সরঞ্জামও পৌঁছে গিয়েছে। সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী ৩ সেপ্টেম্বর মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে অন্তত ১০ হাজার লেপচা সম্প্রদায়ের মানুষ উপস্থিত থাকবেন বলে উদ্যোক্তারা আশা করছেন।
এই খবর পৌঁছেছে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতাদের কাছেও। মোর্চার অন্দরের খবর, বন্ধ তোলার সুযোগে লেপচারা যে এমন ঘটনা ঘটাতে পারেন, তা কেন কেউই আঁচ করতে পারেননি সেই প্রশ্নেই এখন দলে তোলপাড় চলছে। গোর্খাল্যান্ড জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটির শরিক দলগুলির অনেকে তো একান্তে স্বীকার করছেন, একদিনের জন্য বন্ধ শিথিল করে মুখ্যমন্ত্রীর সভার সময়ে ফের জনতাকে ঘরে বসে থাকার ডাক দেওয়াটা কার্যত ‘ব্যুমেরাং’ হয়ে গিয়েছে।
উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব এ দিন বলেন, “পাহাড়ের মানুষের অধিকারকে খর্ব করতে দেবেন না, মুখ্যমন্ত্রীর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই আশ্বাসে ভরসা রেখেই মানুষ বেরিয়ে জনজীবন স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছেন।” |
কমিটির শরিক দলের কয়েকজন জানান, আশির দশকে জিএনএলএফের সুবাস ঘিসিংয়ের ডাকা টানা বন্ধের সময়ে সময়ে পাহাড়ে গিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত রাজীব গাঁধীকে কার্যত নিরাপত্তা রক্ষীদের সামনে বক্তৃতা দিয়ে জনসভা সারতে হয়েছিল। এবারও মুখ্যমন্ত্রীর সফরের সময়ে তেমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চেয়েছিল মোর্চা। তাই জনতাকে ঘরে বসে থাকার ডাক দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, লেপচা সংগঠনের আগাম প্রস্তুতি তাঁদের সব হিসেব গুলিয়ে দিয়েছে, স্বীকার করছেন তাঁরা।
তবে গোর্খাল্যান্ড জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটির চেয়ারম্যান এনোস দাস প্রধানের দাবি, “মুখ্যমন্ত্রীর সভার সঙ্গে আমাদের কর্মসূচির কোনও যোগসূত্র নেই। আমরা সভা বয়কটের ডাকও দিইনি। আমরা গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে শান্তিপূর্ণ লড়াই চালিয়ে যাব। ওই সভার ব্যাপারটা একান্তই উদ্যোক্তা ও মহাকরণের ব্যাপার।” পাশাপাশি, কমিটি জানিয়েছে, আজ, রবিবার থেকে পাহাড়ে বিভাজনের রাজনীতির চেষ্টার প্রতিবাদে মোর্চা প্রভাবিত ‘অল ইন্ডিয়া লেপচা অ্যাসোসিয়েশন’-এর সদস্যরা দার্জিলিঙে প্রশাসনিক কার্যলয়ের সামনে রিলে অনশনে বসছেন।
বস্তুত, কালিম্পঙে মুখ্যমন্ত্রীর সভা যাতে সফল হয় সে জন্য লেপচারা প্রস্তুতি নেন অনেক আগেই। লেপচা সংগঠন সূত্রের খবর, টানা বন্ধ চললে অনুষ্ঠানের দিন আসতে সমস্যা হতে পারে ভেবে ২৯ অগস্ট থেকে কালিম্পং থানার উল্টোদিকে ত্রিকোণ পার্কে ধর্না মঞ্চ তৈরি হয়। সেখানে পাহাড়ে শান্তির দাবিতে জমায়েত হন কয়েকশো লেপচা সম্প্রদায়ের মানুষ। উদ্যোক্তারা ভেবেছিলেন, বন্ধ চলতে থাকলে ধর্না মঞ্চে ধীরে ধীরে লোক বাড়িয়ে তাঁদের অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হবে। মাঝখানে একদিনের জন্য বন্ধ শিথিল হতে সেটাকে পুরো মাত্রায় কাজে লাগিয়ে সেই ধর্না মঞ্চে কয়েক হাজার সদস্যকে জনো করতে পেরে এখন অনেকটাই আশাবাদী সভার উদ্যোক্তারা।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে লেপচা উন্নয়ন বোর্ড গঠিত হয়। দীর্ঘ দিনের চাহিদা পূরণ হওয়ায় ইন্ডিজেনাস লেপচা ট্রাইবাল অ্যাসোসিয়েশনের তরফে মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁদের গোষ্ঠীর সর্বোচ্চ সম্মান জানানোর কথা ঘোষণা করা হয়। তবে উদ্যোক্তা লেপচা সংগঠনের পক্ষ থেকে সভাপতি এল এস তামসাঙ্গ বলেন, “আমরা রাজনীতি করি না। করবও না। মনে রাখতে হবে, আমরা যখন মুখ্যমন্ত্রীকে সম্মান জানানোর অনুষ্ঠানের দিন ঠিক করেছি, তখন পাহাড় শান্ত ছিল। তখন বুঝতে পারিনি, এই অনুষ্ঠানকে ঘিরেও অশান্তি হতে পারে। এখন অনুষ্ঠান থেকে পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। সেটা অমর্যাদার হবে।”
মোর্চার বিভাজনের অভিযোগের উত্তরে তামসাঙ্গের দাবি, “লেপচা বোর্ড গড়ায় সম্প্রীতি নষ্টের ভয় অমূলক। বোর্ড তো শুধু লেপচাদের উন্নয়নের জন্য কাজ করবে।” তিনি জানান, তাঁদের অনুষ্ঠানে অন্তত ২৫ হাজার জন লেপচা সম্প্রদায়ের মানুষ থাকবেন বলে হিসেব করেছিলেন। বন্ধের জেরে তা সম্ভব না হলেও অনুষ্ঠান সফল হবে বলে তাঁর আশা |
বনধ শিথিল হতেই শনিবার পাহাড়ের তিন মহকুমা সদরে ভোরের আলো ফোটার আগেই এটিএমের সামনে লাইন পড়েছে। বেলা যত বেড়েছে ততই দীর্ঘ হয়েছে। দিনের শেষে চকবাজারে দাঁড়িয়ে গাড়িতে মাল বোঝাই করার ফাঁকে সালিম হক, অনুজ শর্মার মতো বাসিন্দারা বললেন, “সকাল থেকে ৩ ঘন্টা এটিএমে লাইন দিয়ে টাকা তুলেছি। দোকানে লাইন দিয়ে চাল-ডাল কিনেছি। সবজির দোকানেও লাইন দিয়েছি। কিন্তু, ডিম বেশি পাইনি। তাই প্রচুর সয়াবিন কিনেছি। আগেও তো অনেক দিন কষ্ট সহ্য করেছি। এবার কবে যে সব ঠিক হবে কে জানে? ভয়ে-আতঙ্কে সব কিছুই বেশি-বেশি কিনে রাখলাম।” অবশ্য বাজারে শাক-সবজির কালোবাজারির অভিযোগ সে ভাবে শোনা যায়নি। যেমন, আলু ১৬ টাকা কেজি দরেই বিকেল পর্যন্ত মিলেছে। বিকেলের দিকে অবশ্য কোথাও ২০ টাকা, কোথাও আবার ২৪ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। পেঁয়াজ মহার্ঘ্য ছিল। ৬০ টাকা কেজি। টম্যাটো ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। স্কোয়াশ ১০ থেকে ১২টা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। বেগুন, শসার দর ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা কেজি। পাহাড়ের আমজনতা আশাবাদী শীঘ্রই বনধের রাস্তা থেকে সরবেন মোর্চা নেতারা। না হলে তৃণমূল ক্রমশ পাহাড়ের আনাচে-কানাচে রসদ বিলি করে শক্তি বাড়িয়ে ফেলবে। এদিন দার্জিলিঙের ৪৫ টি আইসিএসই, আইএসসি স্কুলের প্রতিনিধিরা বৈঠকে বসেন দার্জিলিঙে। পরে তাঁরা জানান, কেন্দ্রীয় বোর্ডের অধীনে চলা পাহাড়ের স্কুল-কলেজ যাতে ঠিক থাকে, সামগ্রিক জনজীবন যাতে শিক্ষার উপযোগী থাকে, সে জন্য হস্তক্ষেপ করতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করা হবে। |