উত্তর-দক্ষিণে শিক্ষক নিগ্রহে ক্ষুব্ধ রাজ্যপাল
শিক্ষাঙ্গনে শান্তি রক্ষার আবেদন জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তাতেও কমার লক্ষণ নেই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যক্ষ বা শিক্ষকদের উপরে নিগ্রহের ঘটনা। শনিবার রাজ্যের দু’প্রান্তে এমনই নৈরাজ্য দেখল পশ্চিমবঙ্গ। উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালিতে কালীনগর কলেজে ছাত্রদের হাতে মার খেলেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মনোরঞ্জন নস্কর। এর ঘণ্টা দুয়েক পরেই দক্ষিণ দিনাজপুরের হরিরামপুর আব্দুলগনি দেওয়ান কলেজে নকল ধরে এক দল ছাত্রের রোষের মুখে পড়েন গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ামক-সহ চার জন। প্রথম ঘটনায় যদি এসএফআইয়ের দিকে অভিযোগের আঙুল ওঠে, দ্বিতীয় ঘটনায় কাঠগড়ায় টিএমসিপি।
পরের পর এমন ঘটনায় কিন্তু প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্র সংসদ নির্বাচন আবার ফিরিয়ে আনার কথা ভাবছে রাজ্য সরকার, এই আবহে তা কতটা সঙ্গত? শিক্ষামহলেরই একাংশের জল্পনা, নির্বাচন ফিরে এলে নতুন করে আগুনে ঘি পড়বে না তো?
ছাত্রদের হাতে শিক্ষক-অধ্যক্ষদের নিগ্রহের ঘটনায় বিরক্ত রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনও। এ দিন প্রথমে সন্দেশখালির ঘটনা নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়। রাজ্যপালের কড়া প্রতিক্রিয়া, “আমার মনে হয়, অভিযুক্ত ছাত্রদের পিটিয়ে ঠান্ডা করা উচিত। অধ্যক্ষের গায়ে হাত তোলার অধিকার কারও নেই।” পরে অন্য এক অনুষ্ঠানে হরিরামপুর কলেজের হামলা নিয়েও প্রশ্ন করা হয় তাঁকে। রাজ্যপাল জানিয়ে দেন, তিনি রাজ্য পুলিশের ডিজি-কে দোষীদের গ্রেফতার করতে বলেছেন। একই সঙ্গে তিনি বলেন, “আশা করব, ওরা জামিন পাবে না (আই হোপ দে ডোন্ট গেট বেল)।”

নিগৃহীত অধ্যক্ষ মনোরঞ্জন নস্কর। ছবি: নির্মল বসু
এমন ঘটনাপ্রবাহে নিন্দায় মুখর শিক্ষাবিদেরাও। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুও শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুও বলেন, “দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। যে কোনও ছাত্র সংগঠনকেই আমরা এ ধরনের গোলমাল থেকে নিবৃত্ত হতে বলব।”
গত মঙ্গলবার দলের ছাত্র সংগঠনের সমাবেশে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শিক্ষামন্ত্রী স্থগিত হয়ে যাওয়া ছাত্র সংসদের নির্বাচন ফের শুরু করার কথা জানান। সে দিনই ইটাহারের কলেজে টুকলি করার দায়ে এক তৃণমূল নেতার স্ত্রীর কাছ থেকে খাতা কেড়ে নেওয়ায় অধ্যক্ষা, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীকে মারধরের অভিযোগ ওঠে ওই নেতা-সহ সাত জনের বিরুদ্ধে। তার পর সাত দিনও কাটেনি, শনিবার পরপর দু’টি নিগ্রহের ঘটনা।
ফেব্রুয়ারিতে গার্ডেনরিচের হরিমোহন ঘোষ কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন জমা দেওয়া নিয়ে গোলমালে কলকাতা পুলিশের ইনস্পেক্টর তাপস চৌধুরীর মৃত্যু হয়। তার পরে পঞ্চায়েত ভোট পর্যন্ত ওই নির্বাচন স্থগিত করে সরকার। এই মুহূর্তে শিক্ষাঙ্গনগুলিতে যে হারে অশান্তি হচ্ছে, তাতে কালীপুজো-ভাইফোঁটার পরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া চালু করার যে চিন্তাভাবনা রাজ্য করছে, তা কতটা সঙ্গত? শিক্ষামন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া, “তা হলে কি সেটা (নির্বাচন) হবে না?” নির্বাচনের জন্য যে সময় বাছা হয়েছে, তা উপযুক্ত কি না, তা নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী মন্তব্য করতে চাননি।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অশান্তি নিয়ে রাজ্য যে উদ্বিগ্ন, তা মুখ্যমন্ত্রী বা শিক্ষামন্ত্রীর কথায় অনেক বারই তা সামনে এসেছে। গত মঙ্গলবারই দলের ছাত্র সংগঠনের এক সমাবেশে শিক্ষাঙ্গনে শান্তি রক্ষার আবেদন জানান মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু ছাত্র সংগঠনগুলির কানে সে বার্তা ঠিকঠাক পৌঁছচ্ছে না বলেই মত শিক্ষামহলের।
প্রবীণ অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী বলেন, “প্রত্যেকটি ঘটনাই যখন ঘটছে, তখন সেটিকে আলাদা বলে দেখিয়ে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। এটা স্বীকার করতে হবে, সমস্যাটা সার্বিক। দোষীদের শাস্তি পাওয়া উচিত। না হলে এমন ঘটনায় শিক্ষক সমাজের মনোবল ভেঙে যাচ্ছে।”
আর এক প্রবীণ অধ্যাপক পবিত্র সরকার বলেন, “যারা দোষ করেছে, উপযুক্ত তদন্তের পরে তাদের উল্লেখযোগ্য শাস্তির প্রয়োজন।” অধ্যক্ষ পরিষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য বলেন, “সমস্ত ধরনের অধ্যক্ষ বা শিক্ষক নিগ্রহের তীব্র নিন্দা করছি। ইটাহার এবং সন্দেশখালির ঘটনাকে আলাদা করে দেখছি না। শিক্ষার রাজনীতিকরণ সবচেয়ে বড় বিপদ।”
কেন নিগ্রহৃত হলেন কালীনগর কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মনোরঞ্জনবাবু?
কলেজ সূত্রের খবর, শুক্রবার কলেজের কমন-রুমে ক্যারম খেলা নিয়ে এসএফআই এবং টিএমসিপি-র সমর্থক কয়েক জন ছাত্রের মারামারি বাধে। গোলমাল থামাতে গেলে কয়েক জন শিক্ষককে টিএমসিপি-র কিছু সমর্থক অপমান করেন বলে এসএফআইয়ের অভিযোগ। প্রতিবাদে এ দিন কলেজে তারা পোস্টার দেয়। বেলা ১২টা নাগাদ মনোরঞ্জনবাবুর ঘরে বিক্ষোভ শুরু করেন এসএফআইয়ের কিছু ছাত্র। তাঁদের স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচিও ছিল। আগের দিনের ঘটনা জানতে মনোরঞ্জনবাবু কয়েক জন শিক্ষককে ডেকে পাঠান। তাঁদের উপস্থিতিতেই নতুন করে ৪০-৫০ জন এসএফআই সমর্থক ওই ঘরে ঢুকে মনোরঞ্জনবাবুকে মারধর ও জিনিসপত্র ভাঙচুর শুরু করেন বলে অভিযোগ। একটু পরে এসে পড়েন টিএমসিপি সমর্থকরাও। দু’পক্ষের সংঘর্ষ বাধে। পুলিশ গ্রেফতার করে ২৪ জনকে। তাঁদের মধ্যে কয়েক জন বহিরাগতও আছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। আহতদের মধ্যে মনোরঞ্জনবাবু এবং পাঁচ ছাত্রকে বসিরহাট হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
আমার মনে হয় অভিযুক্ত ছাত্রদের পিটিয়ে ঠান্ডা করা উচিত। অধ্যক্ষের গায়ে হাত তোলার অধিকার কারও নেই।
এম কে নারায়ণন, রাজ্যপাল
দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। যে কোনও ছাত্র সংগঠনকেই আমরা এ ধরনের গোলমাল থেকে নিবৃত্ত হতে বলব।
ব্রাত্য বসু, শিক্ষামন্ত্রী
মনোরঞ্জনবাবুর অভিযোগ, “প্রথমে এসএফআইয়ের কয়েক জন বিক্ষোভ শুরু করে। কিছু ক্ষণের মধ্যেই ওদের ৪০-৫০ জন রড, মোটরবাইকের চেন নিয়ে আমাকে মারে। ঘরে ভাঙচুর চালায়। বাধা দিতে এসে শিক্ষাকর্মীরাও ওদের হাতে মার খান। আমার কী দোষ তাই তো বুঝলাম না!” ওই শিক্ষকের আক্ষেপ, “কলেজে নিজের ঘরে যে এই অবস্থায় কোনও দিন পড়তে হবে কল্পনাই করিনি!”
কলেজের এসএফআই নেতৃত্ব অবশ্য দাবি করেছেন, তাঁদের কেউ মনোরঞ্জনবাবুকে নিগ্রহের ঘটনায় জড়িত নন। ওই সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক দেবজ্যোতি দাস বলেন, “অধ্যক্ষকে মারধর আমরা কখনও সমর্থন করি না। পুলিশ তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দিক। আমরাও সাংগঠনিক ভাবে তদন্ত করছি। সংগঠনের কেউ যুক্ত থাকলে সর্বোচ্চ শাস্তি (বহিষ্কার করা) দেওয়া হবে।” তবে তাঁর সংযোজন, “প্রাথমিক তদন্তে আমরা জেনেছি, রাজ্য জুড়ে টিএমসিপি বিভিন্ন কলেজে যে অশান্তি শুরু করেছে, তা থেকে মুখ ঘোরাতে আমাদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করা হচ্ছে। এ দিন দু’পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে আহত হন অধ্যক্ষ।” অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়ে টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডা বলেন, “এসএফআইয়ের শীর
ইটাহারের ডক্টর মেঘনাদ সাহা কলেজের অধ্যক্ষা স্বপ্না মুখোপাধ্যায়ের দাবি, এই পরিস্থিতিতে চোখের সামনে টুকলি হতে দেখেও নিগৃহিত হওয়ার আতঙ্কে পরিদর্শকের দায়িত্বে থাকা শিক্ষক-শিক্ষিকারা তা আটকানোর চেষ্টা করছেন না। স্বপ্নাদেবীর অভিযোগ, “এ দিনও পরীক্ষার দুই অর্ধে পরীক্ষার্থীদের একাংশ নকল করেছেন। টুকলি আটকাতে গিয়ে নিগৃহীত হওয়ার আশঙ্কা তো রয়েইছে। তা ছাড়া, শ্লীলতাহানি এবং মারধরের মিথ্যা মামলাতেও ফাঁসতে হতে পারে বলে আতঙ্কে শিক্ষক-শিক্ষিকারা দর্শক হয়েই ছিলেন।”

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.