|
|
|
|
|
|
|
জাস্ট যাচ্ছি |
শুভময় মিত্র |
কোথাও যেতে আজকাল ভয়-ভয় করে। অন্যেরা অন্যের সঙ্গে যায়, তাই আমার আর যাওয়া হয়ে ওঠে না। যেখান থেকে অনেক জায়গায় যাওয়া যায়, সেখানেই ঘুরঘুর করছিলাম। রাতে বৃষ্টি হয়েছে, রাস্তার খানাখন্দে জল জমে আছে। শহিদ মিনারের উলটো ছায়াটা দেখছিলাম অনেক ক্ষণ ধরে। পাশ দিয়ে ভারী চাকা গেলেই কাঁপছিল ছায়াটা। একটা বাসের চাকা ঝপাস করে জলে পড়ল, মুহূর্তে ভেঙেচুরে শেষ হয়ে গেল সবটা। কিছু দূরে গিয়ে দাঁড়াল বাসটা। কমলা রঙের লুঙ্গি, ফতুয়া, কাপড় জড়ানো লোকজন হল্লা করতে করতে দৌড়ল সে দিকে, তাই আমিও গেলাম। কাকদ্বীপের বাস, বেশ ভিড়, ছেড়ে দিল তাড়াতাড়ি।
বাসের পিছন দিক থেকে বিড়ির গন্ধ আসছে। আমার পাশের লুঙ্গি-পরা লোকটা বলল, ‘সব সাগরে যাচ্ছে।’ তার পর একটা ময়লা মোবাইল ফোন বের করে কী-সব দেখতে লাগল। আমার জানলার কাচ জ্যাম হয়ে গেছে, খুলছে না। ভালই হল, বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। আমিও মোবাইল বের করলাম। এতে ইন্টারনেট হয়। ওয়েদার রিপোর্ট জানাল: বৃষ্টি হচ্ছে।
হারউড পয়েন্টে ভেসেল এল। ফেরিতে ও-পারে যেতে হবে, সাগরদ্বীপের উত্তর মাথায় নামব। বসার বেঞ্চে লোক ভর্তি। মেঝেতে অনেকে বসেছে নীল জাল চাপা দেওয়া জলভরা মাছের হাঁড়ি নিয়ে। হাত দিয়ে জল থাবড়াচ্ছে, অক্সিজেন দিচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ইলিশ ওঠে ভাল?’ ‘সব তো সাগর থেকে হাপিশ হয়ে যায়’, উত্তর দিয়ে দিল ময়লা শার্ট-পরা উসকোখুসকো চুল, বুড়ো মতো একটা লোক। ‘মাছকে তো মিষ্টি জলে ঢুকতে দিতে হবে, তার পর সে ওপরে উঠবে, লড়াই করতে হবে, শরীরে গত্তি লাগবে, তবে না টেস্ট হবে দু’বছর পর আর মাছ খেতে হবে না, শুধু মড়া উঠবে গঙ্গার জলে।’ এ সব কথা শুনতে ভাল লাগছিল না, সরে এলাম রেলিং-এর দিকে, জোর বৃষ্টি হচ্ছে, পাড় দেখা যাচ্ছে না, আকাশ নেমে এসেছে জলে। ‘এত পাপ সইবে না। ওই সুন্দরবন থেকে বাংলাদেশ অবধি সাগরের তলাটা হাঁ হয়ে আছে, আগুন আছে তার মধ্যে। যে কোনও দিন বেরিয়ে আসবে, বুঝলেন। কেউ আটকাতে পারবে না। সবাই সব জানে, মুখে কুলুপ এঁটে আছে। এ বার মাথায় উঠবে সব জল। ক’দিন আগে জাপানে হল, আন্দামানে হল, তলায় তলায় এগোচ্ছে ওটা ।’ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে লোকটা। আরও আজেবাজে কথা বলবে নিশ্চয়ই। চুপ করে রইলাম। কখন পাড়ে পৌঁছব কে জানে, কথা না শোনার ভান করে মোবাইল দেখতে লাগলাম। সিগনাল নেই।
সাগরদ্বীপের একেবারে দক্ষিণে গঙ্গাসাগর। ছোট জায়গা। কপিলমুনির আশ্রম রয়েছে। মেলার সময় ভিড় হয়, বাকিটা ফাঁকাই থাকে। বন্ধ দোকানপাট। পর পর ইলেকট্রিক পোল, একা দাঁড়িয়ে আছে উইন্ডমিল, সবুজ মাঠের মধ্যে। বাঁধানো রাস্তা সোজা এসে পড়েছে বালি মাটির বিচে। কালো রং, পায়ের তলায় শক্ত লাগে। ছাইরঙা আকাশ ভারী হয়ে আছে মাথার ওপরে। তার নীচে যত দূর অবধি চোখ যায় জলের উঠোন। ঢেউ নেই, ময়লাটে সাদা ফেনা আছে। |
|
ছবি: শুভময় মিত্র |
জল আসছেও না, যাচ্ছেও না। থমকে আছে মেঘ মাথায় নিয়ে। জাহাজ যাচ্ছে দিগন্তের রানওয়ে দিয়ে। আর চোখে পড়ছে কয়েকটা কমলা রঙের বিন্দু। নড়াচড়া করছে, কখনও মিলে যাচ্ছে, কখনও আলাদা হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। তীর্থযাত্রীর দল। চান করছে। পুজো করবে। চলে যাবে। বিচে পড়ে থাকবে জরির পাড় বসানো সস্তা লাল কাপড়ের টুকরো, ফাটা নারকোল আর নেভা ধূপকাঠি। আছে অনেকগুলো কুকুর, দৌড়োদৌড়ি করছে, খেয়োখেয়ি করছে, এ ছাড়া আর কোনও শব্দ শোনা যাচ্ছে না।
দূরে ঝাউবনের দিক থেকে কে যেন একটা আসছে আমার দিকে। ভেসেলের লোকটা না? যে আজেবাজে কথা বলছিল? আমি উলটো দিকে ঘুরে হাঁটতে লাগলাম সমুদ্রের দিকে। গোড়ালিতে জল লাগতে থেমে গেলাম। পিছনে ঘুরে আর দেখা গেল না লোকটাকে। বৃষ্টি পড়ছে না, আকাশটা আরও কালো হয়ে এসেছে। সমুদ্রের সঙ্গে একটা তফাত রয়েছে এখনও। সেখানে একটা আলোর ফিতে। ফিতেটা আস্তে আস্তে পাতলা হয়ে আসছে। মনে হয় ছুঁয়ে ফেলবে দিগন্ত। ওখানে আর একটাও জাহাজ নেই। পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করলাম। ওয়েদার রিপোর্ট। বজ্রবিদ্যুৎ সহ ভয়ানক বৃষ্টির সিম্বল দেখাচ্ছে, প্রবল হাওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে। ফুল সিগনাল রয়েছে। কেদারনাথের ডিজাস্টারের ভিডিয়োটা দেখার ইচ্ছে হল। আগেও দেখেছি আমি। তবুও। ইউ টিউবে ছবি এসে গেল ঝপ করে। কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে থেকেই তোড়ে জল চলতে শুরু করল। খড়কুটোর মতো ভেসে চলেছে গাড়ি, বাড়ির চাল, মানুষও আছে নিশ্চয়ই। ভিতসুদ্ধু উপড়ে যাচ্ছে মন্দির। তাণ্ডবের গমগমে শব্দটা অনেক কম আর অনেক খসখসে শোনাচ্ছে ছোট স্পিকারে। হড়কা বানে বন্ধ করে দিলাম ভিডিয়োটা। মুখ তুলে নিয়ে চার পাশে দেখলাম, কেউ নেই। কুকুরগুলোও নয়। আমি একেবারে একা। উপুড় হয়ে থাকা মস্ত বড় ভিজে শরীরের মতো পড়ে আছে বিচ-টা। ঘামে ভেজা সদ্য মারা যাওয়া দেহ, মনে হল।
হাওয়া শুরু হল। ঝড় আসছে। দিগন্তের আলোর রেখাটা আর নেই। মাথার মধ্যে চিন্তাগুলোকে থামাতে পারছি না। পায়ের কাছে ফেলে যাওয়া কিছু ফল, ছেঁড়া চটি। কী লাভ হয় এই ভাবে পুজো দিয়ে? কী পায় মানুষ দেবতাদের কাছে কষ্টের ফসল উৎসর্গ করে? এই যে এত জল, সব তো এসেছে দেবাত্মাদের দেশ থেকে। হাজার হাজার মানুষের সংসার তছনছ করে তাদের মৃতদেহ ধুয়ে, পবিত্র গঙ্গার স্রোত হয়ে, মিশেছে কালো সাগরে। শুধুই কি কিছু লাভসর্বস্ব হোটেলওয়ালা, ডিজেলের ধোঁয়ায় বাতাস অপবিত্র করা গাড়িওয়ালা, নদী থামানো ড্যামওয়ালাদের পাপে এত ক্ষয়, এত ক্ষতি? জল এত কালো? বালি এত কালো? আকাশ এত কালো? এর মধ্যেই ঝলমল করছে আমার ফোনের স্ক্রিন। হুড়মুড় করে এসে পড়ছে ছবির পর ছবি। কে পাঠাচ্ছে এত সিগনাল? কোন সিগনাল আছে এই সব সিগনালে?
দৌড়তে শুরু করলাম। সমুদ্রের দিক থেকে আসা জোরালো হাওয়ার চাপটা অনুভব করছিলাম পিঠে। বৃষ্টিতে সপসপ করছে শরীর। লোকটার কথা কানে নেওয়া উচিত ছিল অনেক আগে। বোঝা উচিত ছিল মোবাইলের সিগনালের মানে। যেমন করেই হোক পালাতে হবে এই দ্বীপ থেকে। সবাই চলে গেছে, আমার বোঝা উচিত ছিল, সব কিছু দেরিতে বুঝি, প্রত্যেক বারই আমার দেরি হয়ে যায়।
ছেড়ে যাওয়া ভিড়ভরতি বাসের দরজা দিয়ে ঢুকতে না পারায় পিছনের সিঁড়ি দিয়ে উঠে পড়লাম ছাদে। ওখানেই ভাড়া নিল এক জন, টিকিট দিল না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘লাস্ট ভেসেল পাব তো?’ নিরাসক্ত উত্তর এল, ‘দেখুন গিয়ে, জলের ব্যাপার।’ দু’পাশে সবুজ ধানখেত, গাছপালা, এক-আধটা বাড়ি, সরে যাচ্ছে দু’পাশে। মাঝখান দিয়ে সরু পিচের রাস্তা, সাগরদ্বীপের মাঝ-বরাবর বিছোনো আছে। বাস চলেছে সেখান দিয়ে ধীরেসুস্থে। খেয়ালই নেই যে এসে গেছে ঝড়, ঠিক পিছনে।
মাথার পিছনে গলার আওয়াজ পেলাম, ‘পুজো না দিয়েই চলে যাচ্ছেন?’ মুখ ঘুরিয়ে দেখি সেই লোকটা। হাওয়ায় উড়ছে তার চুল। পিছনে গঙ্গাসাগরের কালো আকাশ। সেখানে রামধনু উঠেছে এক আকাশ থেকে অন্য আকাশ জুড়ে, নরম রোদ পড়েছে ফিতের মতো সরু সবুজ দিগন্তে। |
|
|
|
|
|
|