|
|
|
|
|
|
|
এই আমি মরছি |
কলকাতায় ব্যস্ত রাস্তায় আত্মহত্যা করলেন এক মহিলা। ‘আত্মহত্যা’ বললেই
আমরা নিভৃত কাণ্ড বুঝি, কিন্তু অনেকেই প্রকাশ্যে আত্মহত্যা করেছেন।
শিশির রায়
|
ঠিক চারটে চল্লিশে, বিকেলের ব্যস্ত সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ যখন অজস্র দু’পায়ে চারচাকায় দৌড়চ্ছে, ফুটপাতে পথচারী-চাওয়ালা-ন্যাংটো বাচ্চা-ছেলেবুড়ো কে নেই, এক নারী একটা গাছের বাঁধানো বেদিতে উঠলেন, দাঁড়িয়ে ত্রিফলার গায়ে ফাঁস লাগালেন ওড়না দিয়ে, তার পর, এক গাদা চোখের সামনে, ঝুলে পড়লেন। অনেকে দেখলেন, আরও অনেকে দেখেও দেখলেন না। হইহই, ‘ধর ধর’, কিচ্ছু না। বেশ কিছু ক্ষণ পর, যখন শরীরটা প্রাণহীন নিথর, পুলিশ এল। ‘বডি’টা নামাল। কিছু প্রত্যক্ষদর্শী, জিজ্ঞাসাবাদ, চালান। পর দিন কাগজে খবর হয়ে বেরোলেন বছর পঞ্চাশের সোমা বক্সি।
‘এনি ম্যান্স ডেথ ডিমিনিশেস মি, বিকজ আই অ্যাম ইনভল্ভ্ড ইন ম্যানকাইন্ড’ লিখেছিলেন জন ডান। ভোঁতা, অসাড়, মহানগরীর মন আজ আর মানুষের সঙ্গে ‘ইনভল্ভ্ড’ আছে বলে মনে হয় না। মেট্রোপলিটান অমানবিকতা নিয়ে লিখে পাতাও ভরানো যেতে পারে বিস্তর। বরং কথা হোক সোমাকে নিয়ে। সোমার মতো, একই পরিণামের, পরিণতির অংশী অন্য মানুষদের নিয়ে। যাঁরা সবাই আত্মহত্যা করেছেন জনসমক্ষে। নিজের প্রাণটি নিজেই কেড়ে নেওয়ার মতো চরম দুঃসাহসিক কাজটি যাঁরা সমাধা করেছেন বন্ধ বেডরুমের সিলিং ফ্যানে ঝুলে পড়ে নয়, দরজায় খিল এঁটে আটত্রিশটা ঘুমের ওষুধ গিলে নয়, বাথরুমে এক-গা কেরোসিনে একটা দেশলাই কাঠি ছুঁইয়ে নয়। এঁরাও আত্মহত্যা করেছেন, কিন্তু আত্মহত্যার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা লজ্জাঘৃণাগ্লানিবোধের গোপনীয়তার চাদরটাকে সপাটে ঝেড়ে ফেলে। এঁদের আত্মহত্যা ব্যস্ত রাজপথের মোড়ে, জনবহুল চৌমাথায়, চার্চে, স্টেডিয়ামে, লাইভ টেলিভিশন-অনুষ্ঠানে, সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে, সভার মাঝখানে, সবার মাঝখানে।
রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস স্বৈরাচার আগ্রাসনের সামনে দাঁড়িয়ে, বা নিজের মনের মতো দেশ-রাষ্ট্র-সমাজ চেয়ে কত যে মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছেন, ইয়ত্তা নেই। নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া রাজপথে, জনতার মিছিলে, পার্লামেন্টের সামনে রাজনৈতিক প্রতিবাদের মোক্ষম হাতিয়ার। ২০০৬-এ এক সকালে শিকাগোর ব্যস্ত কেনেডি এক্সপ্রেসওয়ের এক ধারে নিজের গায়ে আগুন দিলেন মার্ক ডেভিড রিশার। ৫২ বছর বয়সি ভদ্রলোক পেশায় ছিলেন রেকর্ডিং ইঞ্জিনিয়ার। মার্কিন প্রশাসনের ইরাকের ওপর আক্রমণ, যুদ্ধ, যুদ্ধ-উত্তর খবরদারি মেনে নিতে পারেননি রিশার। তাই এক হিমেল নভেম্বর-সকালে নিজের মনের উত্তাপটুকু শরীরে চারিয়ে দিলেন, আগুন লাগিয়ে। রিশার-এর মৃত্যু আমেরিকায় জাতীয় শিরোনাম হয়ে ওঠে, খোঁজ পড়ে মানুষটার ব্যক্তিগত জীবন-বোধ-বিশ্বাস-লেখালিখি নিয়ে। তখনই দেখা যায়, নিজের ওয়েবসাইটে অনেক আগে থেকেই লেখা আছে রিশার-এর সুইসাইড প্ল্যান, জ্বলজ্বলে একটা লাইন তাতে, If I’m required to pay for your barbaric war, I choose not to live in your world. |
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
গত শতাব্দীর ষাটের দশকে, পৃথিবী যখন ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে উত্তাল, আমেরিকার যুদ্ধ-নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন নর্মান মরিসন। সে ঘটনা ঘটেছিল খোদ পেন্টাগন-এ, প্রতিরক্ষা সচিবের অফিসের নিচেই। প্রতিবাদীদের ভিড়ে শামিল ছিলেন নর্মান, সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন এক বছরের মেয়ে এমিলিকেও। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছিলেন, ভিড়ের মধ্যেই একদম অচেনা কারও হাতে মেয়ের হাত গুঁজে দিয়ে যান নর্মান। তার পরই সবার চোখের সামনে গায়ে কেরোসিন দিয়ে আগুন। অনেক পরে পাওয়া গিয়েছিল স্ত্রীকে লেখা নর্মানের চিঠি। সেখানে নিজের সম্ভাব্য মৃত্যুকে তিনি দেখেছিলেন ‘শুধু পরিবারেরই নয়, তাঁর নিজের আর দেশের পক্ষেও এক গভীর ট্র্যাজেডি’ হিসেবে, আর লিখেছিলেন, তাঁর আত্মাহুতি ‘ভিয়েতনাম ও আমেরিকার অসংখ্য তরুণ-যুবার প্রাণহানির বিরুদ্ধে এক চিৎকৃত প্রতিবাদ।’
পা থেকে মাথা পর্যন্ত পুড়ছে চড়চড়ে আগুনে, কিন্তু মানুষটার মুখে কোনও শব্দ নেই। থিক কুয়াং ডুক। ভিয়েতনামের সায়গন শহরে (এখন যার নাম হো চি মিন সিটি) ১৯৬৩ সালের জুনের এক দিন। সন্ন্যাসী ডুক প্রতিবাদ জানাবেন বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ওপর তৎকালীন দক্ষিণ ভিয়েতনামের রোমান ক্যাথলিক সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে। এক দল সাংবাদিককে ডেকে এনে বসালেন শহরের ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে। তার পর নিজে বসলেন পদ্মাসনে, ধ্যানমুদ্রায়। সারা গা, গায়ের চীবর গ্যাসোলিনে ভেজা সপসপে। শান্ত, সুস্মিত মুখ। কয়েকটি মাত্র কথা বললেন, তার পর একটা দেশলাই কাঠি জ্বেলে ছোঁয়ালেন নিজের শরীরে। মুহূর্তে জ্বলে উঠল লকলকে আগুন, এক শরীর আগুন নিয়ে পুড়তে লাগলেন মহাযানী ভিক্ষু। আগুনের গ্রাসে দগ্ধ ডুক-এর শরীরটা একটুও নড়েনি, মুখ থেকে বেরোয়নি অস্ফুট কোনও আওয়াজও। ‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’-এর ফোটোগ্রাফার ম্যালকম ব্রাউন ছবি তুলেছিলেন ডুক-এর সেই আত্মাহুতির, ১৯৬৩-র ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফোটো অব দ্য ইয়ার’-এর সম্মান কুড়িয়েছিল সেই দহনচিত্র। ডুক-এর কৃতি ক’জন মনে রেখেছেন জানি না। হয়তো বা সন্ন্যাসী বলেই তাঁর আত্মহত্যা ঢেকে গেছে গীতার ‘দুঃখেষ্বনুদ্বিগ্নমনা’-গোত্রীয় বিগতস্পৃহ বৈরাগ্যদর্শনে।
ওই ষাটের দশকই দেখেছিল আরও অনেক পাবলিক সুইসাইড। কার্টসি, তখনকার দোর্দণ্ডপ্রতাপ সোভিয়েত রাশিয়া। চরম আগ্রাসী খিদেয় সে তখন এগোচ্ছে চেকোস্লোভাকিয়াকে গিলবে বলে, হাত মিলিয়েছে কম্যুনিস্ট পোল্যান্ডও, হয়েছে কুখ্যাত ‘ওয়ার্স প্যাক্ট’। ১৯৬৮-র পোল্যান্ডে রাজধানী ওয়ার্স-তে একটা স্টেডিয়ামে জাতীয় উৎসব। দেশের নেতা-মন্ত্রী, বিদেশি কূটনীতিক-সহ হাজির লাখখানেক মানুষ। ওই লক্ষ মানুষের সামনে গায়ে আগুন ধরিয়ে দিলেন রিজার্ড সিউয়িয়েক, রাশিয়ার চেকোস্লোভাকিয়া আক্রমণ ও সেই কাজকে পোল্যান্ডের সমর্থনের প্রতিবাদে। জাতীয় মহা-প্রোপাগান্ডা হিসেবে আয়োজিত হয়েছিল যে অনুষ্ঠান, তা-ই হয়ে দাঁড়াল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একলা মানুষের অগ্নি-চ্যালেঞ্জ। সারা গায়ে দগদগে পোড়া ঘা নিয়ে চার দিন পর হাসপাতালে মারা যান রিজার্ড। পরে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল তাঁর লিখিত, এমন কী টেপ রেকর্ডারে রেকর্ড করা আত্মহত্যা-বয়ানও, যা থেকে বোঝা যায় কী অদ্ভুত ঠান্ডা মাথায়, ক্ষুরধার বুদ্ধি-যুক্তিতে রিজার্ড সাজিয়েছিলেন আত্মহত্যার দিনক্ষণ আর ভেনু। রিজার্ডের মৃত্যু উসকে দিয়েছিল আরও অনেক প্রাণের সলতে। ’৬৯-এর জানুয়ারিতে প্রাগ শহরের বিখ্যাত ওয়েনসেলাস স্কোয়্যারে আত্মাহুতি দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইয়ান পালাচ। ঠিক এক মাস পর ইয়ান জাজিক নামের আর এক ছাত্র, একই জায়গায়, একই ভাবে, সব্বার সামনে!
এঁদের সবারই আত্মহত্যার ‘মোটিভ’ রাজনৈতিক প্রতিবাদ। সে অর্থে প্রত্যেকের রীতিমত একটা প্রস্তুতি-পর্বও ছিল। কিন্তু বলা নেই কওয়া নেই এক ঘর মানুষের সামনে, বা লক্ষ টেলিভিশন-দর্শকের সামনে দিব্যি এ কাজ ও কাজ সারতে সারতে যেন-কিছুই-হয়নি গোছের ভাব করে ব্যাগ কি ড্রয়ার থেকে পিস্তল বের করে নিজের মাথায় ট্রিগার টিপে গুড়ুম!? ১৯৭৪-এর জুলাইয়ের এক দিন ফ্লোরিডার চ্যানেল ফর্টি টেলিভিশন চ্যানেলের সঞ্চালিকা ক্রিস্টিন চুবুক তাঁর সহকর্মীদের বললেন, তাঁর নিজের অনুষ্ঠান ‘সানকোস্ট ডাইজেস্ট’ শুরুর আগে তিনি এক্সট্রা একটা লাইভ নিউজ প্রোগ্রাম উপস্থাপনা করবেন। তার আগে কোনও দিনই ক্রিস্টিন এ রকমটা করেননি, তাই সহকর্মীরা একটু অবাক। ক্রিস্টিন মুচকি হেসে নিউজ অ্যাংকর-এর চেয়ারে বসলেন, সামনে নিউজ কপি (মিনিট দশেক পরই আতঙ্কিত এক কলিগ যে কপিটি হাতে তুলে দেখবেন, তাতে ক্রিস্টিন লিখে রেখেছেন তাঁরই আত্মহত্যার ব্রেকিং নিউজ)। প্রথমে দু’তিনটে ন্যাশনাল নিউজ, তার পর স্থানীয় একটা রেস্তোরাঁয় গোলাগুলির খবর পড়লেন, তার পর বললেন, ‘চ্যানেল ফর্টি যেমন যে কোনও রক্তারক্তির সর্বশেষ ও তরতাজা খবর আপনাদের সামনে দেখায়, ঠিক সে রকমই একটা অ্যাটেম্পটেড সুইসাইড এখন আপনারা দেখবেন।’ বলেই ডেস্কের নিচে ব্যাগের মধ্যে রাখা পয়েন্ট থ্রি এইট রিভলভার তুলে নিয়ে ডান কানের পিছনে ঠেকিয়ে গুলি করলেন। ক্যামেরাম্যান মানুষটি প্রথমে ভেবেছিলেন ক্রিস্টিন বুঝি মজা করছেন, কয়েক মুহূর্ত পরেই ব্যথায় কুঁকড়ে যাওয়া, নিউজ ডেস্কের ওপর ধড়াম পড়ে যাওয়া রক্তাক্ত শরীরটা দেখে বুঝলেন, কী হয়ে গেল। নিমেষে হইহই গোলমাল, চ্যানেলটা হঠাৎ অন্য একটা রেকর্ডেড অনুষ্ঠান দেখানো শুরু করল। টিভির সামনে বসে থাকা বহু দর্শক হতভম্ব, অনেকেই ভয় পেয়ে ইমার্জেন্সি নম্বরে ফোন করেন, অনেকে টিভি-অফিসে ফোন করে জানতে চান, গুলির দৃশ্যটা বানানো তো? তত ক্ষণে ক্রিস্টিনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হাসপাতালে। সন্ধে নাগাদ অফিশিয়ালি টিভির পরদায় আর এক জন বিষণ্ণ সঞ্চালকের ঘোষণা, ক্রিস্টিন মৃত। তাঁর হাতে তখন ক্রিস্টিনেরই লিখে যাওয়া সুইসাইড কপি। ‘আগামী এগারো ঘণ্টার মধ্যে আমি খুব সম্ভবত মৃত’, এই পূর্বাভাস থাকলেও আদৌ লেখা নেই কেন এই আত্মহত্যা, কী দুঃসহ ব্যক্তিগত যন্ত্রণা লুকিয়ে ওই হাড়-হিম সিদ্ধান্তের আড়ালে। কী চুপিসারে, অথচ কী প্রকাশ্যেই না চলে গেলেন ক্রিস্টিন!
প্রায় একই কায়দায় আত্মহত্যা করেছিলেন পেনসিলভানিয়ার সরকারি কোষাধ্যক্ষ রবার্ট বাড ডয়ার। সেটা ১৯৮৭ সাল। বিরাট ট্যাক্স স্ক্যান্ডালে অভিযুক্ত রবার্টের বিরুদ্ধে কোর্টে মামলার রায় বেরিয়েছে। বহু বছর চলা মামলায় রবার্ট বরাবর নিজেকে নির্দোষ নিরপরাধ দাবি করে এসেছেন, বলেছেন তিনি ঘুষ নেননি, অবৈধ কিচ্ছু করেননি। জুরি বোর্ড তবু বললেন, রবার্ট দোষী। সামনে পঞ্চান্ন বছরের জেল, তিন লক্ষ মিলিয়ন ডলার জরিমানা, এতদিনকার মানমর্যাদা হানির খাঁড়া নিয়ে রবার্ট প্রেস কনফারেন্স ডাকলেন। আবারও জোর গলায় বললেন, তিনি সম্পূর্ণ নির্দোষ, বিচারকরাই প্রভাবিত, তাঁদের রায়টাই অবৈধ, অন্যায্য। এই বলে এক কর্মীকে ডেকে তাঁর হাতে তিনটে মুখবন্ধ খাম দিলেন তিন জনকে পৌঁছনোর জন্য। তার পর একটা রিভলভার হাতে তুলে নিয়ে সবাইকে বললেন, প্লিজ লিভ দ্য রুম ইফ দিস উইল অফেন্ড ইউ। টিভিতে লাইভ দেখানো প্রেস কনফারেন্সে তখন দেখা যাচ্ছে, রবার্ট আস্তে আস্তে রিভলভারের ব্যারেলটা নিজের মুখে পুরছেন, আর চারদিকে হুলস্থুল। ওরই মাঝে, চেয়ারে বসে থাকা অবস্থায়, রবার্ট ট্রিগার টিপলেন, নাক দিয়ে গলগল কাঁচা রক্ত গড়িয়ে এল। পাঁচ পাঁচটা নিউজ ক্যামেরা তখন ‘অন’, চরম অভিমানী, আত্মপ্রত্যয়ী এক মানুষের আত্মহত্যা দেখাচ্ছে। লাইভ।
লিস্টিতে আরও যোগ করুন সেই সব অসংখ্য ছোট-বড় খবরের শিরোনামধারীদের, চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে যাঁদের নির্বিকারে উলটে আপনি আকছার চলে যান পেজ থ্রি বা খেলার পাতায়। কলকাতা মেট্রোয় আবারও আত্মহত্যা। ট্রেন চলাচল পঞ্চাশ মিনিট বিপর্যস্ত। হয়তো আপনার রোজকার অফিস যাওয়ার পথেই আচমকা ঘটে যায় সে রকম ‘খবর’। ভিড়ঠাসা এসি মেট্রোয় বিরক্ত, রাগত শ্বাস নিতে নিতে, গাল পাড়তে পাড়তে আপনি বলে ওঠেন, আর সময় পেল না সুইসাইডের, এই রাশ আওয়ারেই যত্ত সব....। আপনি বোঝেন না, বোঝার চেষ্টাও করেন না, ওই একটা বিশেষ দিন, একটা বিশেষ সকাল, একটা বিশেষ সময়ের মেট্রো, ইতিহাস হয়ে রইল লাইনে ঝাঁপ দেওয়া ওই মানুষটার কাছে, প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা অন্তত কয়েক জন আতঙ্কিত, বিস্ফারিতনেত্র যাত্রীর কাছে, কিস্যু করা যাবে না জেনেও দাঁতে দাঁত চেপে ইমার্জেন্সি ব্রেক কষা মেট্রোর চালকের কাছে, আর কামরার মধ্যে হঠাৎ ঝাঁকুনিতে ত্রস্ত আপনার কাছেও। এই এত্তগুলো মানুষকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সাক্ষী রেখে পটাং করে মরে গেলেন যিনি, তাঁর মৃত্যু, আপনার মনে হোক না হোক, আসলে একটা স্টেটমেন্ট। ব্যক্তিগত যন্ত্রণা, ব্যবসার ঋণ, পারিবারিক সম্মানহানি কী কারণে লোকটা মরল, তা তো আপনি জানলেন না। মরতে হয়তো চায়ওনি, হয়তো কষ্টটা, যন্ত্রণাটা বন্ধের একটা রাস্তা চেয়েছিল। এত জোড়া নিস্পৃহ ভয়ার্ত উত্তেজিত মায়াময় চোখের সামনে আত্মহত্যা করে মানুষটা হয়তো নিজের যন্ত্রণা-ঋণ-মানহানি এত জনের মধ্যে একটা অদৃশ্য সিরিঞ্জ দিয়ে পুশ করে গেল।
বা, যে মানুষগুলো আলটপকা আত্মহত্যা করে বসে ওয়েবক্যামের সামনে, ল্যাপটপের স্ক্রিনে বহু দূরে থাকা প্রেমিক, প্রেমিকা বা পার্টনারের আকাশ চিরে দেওয়া চিৎকার-হাহাকারের সামনে? সেও কি পাবলিক সুইসাইডের চেয়ে কম কিছু? ২০০৭ সালের এক মার্চ-সন্ধেয় মধ্যবয়সি ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার কেভিন হুইটরিক চ্যাট করছিলেন এমন একটা গ্রুপে, যাদের কাজই হল একে অন্যের পিছনে লাগা, যাচ্ছেতাই অপমান করা, গালাগাল দেওয়া। ওয়েবক্যাম অন, অন্তত জনষাটেক মেম্বার অনলাইন, কেভিন একটা চেয়ারের ওপর উঠে সিলিং থেকে ঝোলানো ফাঁসির দড়িতে ঝুলে পড়লেন। বুলি চ্যাট-গ্রুপই তাঁকে তাতিয়েছিল, নাকি আচমকা ঘাড়ে-চাপা মৃত্যুর দর্শনীয় কামারাদারি, জানা নেই।
আত্মহত্যা পাপ, জগতের সুধর্মেরা বলে। একই জিগির তোলে শিক্ষা-সমাজ-সংস্কৃতি আদি যাবতীয় সুপারস্ট্রাকচার। আত্মহত্যাকে অপরাধবোধ আর গ্লানির রাংতায় মুড়ে রাখাতেই সবার আগ্রহ, কেউ মুখোমুখি অ্যাড্রেস করতে চান না। কলকাতার সোমা বক্সি আত্মহত্যা করেছিলেন দাম্পত্য কলহের জেরে। ফুটপাতবাসী সোমার পিস্তল ছিল না, কেরোসিনও না। গলায় দড়ি দেওয়ার মতো ব্যক্তিগত জায়গাটুকুও ছিল না। ত্রিফলাই তাই হয়ে উঠেছিল মুশকিল আসান। সোমার আত্মহত্যা পথ-চলতি বা টিভির পরদায় যারা দেখলাম, নিজেরা কি শুধোলাম কিছু? না কি, আমাদের প্রশ্ন করার মনটাও ত্রিফলায় ঝুলে আত্মহত্যা করেছে? |
|
|
|
|
|