মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে কেটে যাচ্ছে লাইন। ফোনের পর্দায় সিগন্যাল থাকা সত্ত্বেও বলা হচ্ছে ‘নো নেটওয়ার্ক কভারেজ’। এমনতর বিরক্তি এড়াতে এখন বিএসএনএলের অনেক গ্রাহকই
নম্বর এক রেখে অন্য সংস্থার
পরিষেবা নিচ্ছেন।
পরিষেবায় সমস্যার কারণ হিসেবে পরিকাঠামোগত দুর্বলতার অভিযোগ উঠলেও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি তা মানতে নারাজ। তাদের পাল্টা দাবি, মোবাইল টাওয়ারের অ্যান্টেনার বিকিরণ থেকে স্বাস্থ্যের ক্ষতির আশঙ্কায় টাওয়ার বন্ধ করে সমস্যা বাড়াচ্ছেন আম-জনতার একাংশ। স্থানীয় আবাসিকদের আপত্তির জেরে বছরখানেকের মধ্যে কলকাতায় বিএসএনএল-এর অন্তত ২০টি টাওয়ার (মিন্টো পার্কের সরকারি আবাসন, শিয়ালদহে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ যেগুলির অন্যতম) বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কলকাতা টেলিফোনস এলাকার মোট ২,৭৪,৩২৫ জন্য মোবাইল গ্রাহকের একটা বড় অংশই এই সমস্যার শিকার, দাবি সংস্থাটির।
এক দিকে মোবাইল পরিষেবা সংস্থাগুলির অভিযোগ, অন্য দিকে, বিকিরণজনিত ক্ষতিকারক প্রভাব নিয়ে আম-জমতা ও বিশেষজ্ঞদের একাংশের আশঙ্কা। যা থেকে তৈরি হচ্ছে নিরাপদ বিকিরণ মাত্রার মাপকাঠি নিয়ে নতুন বিতর্ক। ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন নন-আয়োনাইজিং রেডিয়েশন প্রোটেকশন-এর নির্দেশ অনুযায়ী, প্রতি বর্গ মিটারে একটি টাওয়ারের সর্বোচ্চ বিকিরণ মাত্রা হবে বিভিন্ন ধরনের তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের (৮০০, ৯০০ বা ১৮০০ মেগাহার্ৎজ) স্পেকট্রামের ২০০ ভাগের এক ভাগ পর্যন্ত। অর্থাৎ, ১৮০০ মেগাহার্ৎজ স্পেকট্রামের ক্ষেত্রে তা হবে প্রতি বর্গ মিটারে ৯ ওয়াট। কিন্তু গত বছর ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার ওই সীমা আরও কমিয়ে ২০০০ ভাগের এক ভাগ করেছে। অর্থাৎ, সবোর্চ্চ মাত্রা এ দেশে আরও কমে হবে ০.৯ ওয়াট। অন্যান্য তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের স্পেকট্রামের ক্ষেত্রেও ওই হিসেবেই সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারত হবে। একটি টাওয়ারে একাধিক অ্যান্টেনা থাকলেও সবক’টি মিলিয়েই ওই সর্বোচ্চ সীমা নির্দিষ্ট।
কলকাতা টেলিফোনস-এর সিজিএম গৌতম চক্রবর্তী ও সেলুলার অপারেটার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ার কর্তা বিক্রম থিওটিয়ার দাবি, তাঁরা সরকার নির্ধারিত সীমা মেনেই পরিষেবা দিচ্ছেন। কলকাতা টেলিফোনস-এর ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার (রেডিও নেটওয়ার্ক) দেবজিৎ সাহার দাবি, এই বিকিরণ ‘নন-আয়োনাইজিং’ ধরনের, যা থেকে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয় না।
টেলিকম সংস্থাগুলি ওই সর্বোচ্চ সীমা মানছে কি না, তা নজরদারির দায়িত্ব টেলিকম দফতরের টার্ম (টেলিকম এনফোর্সমেন্ট রিসোর্স অ্যান্ড মনিটরিং) সেল-এর। তারা জানিয়েছে, বিভিন্ন টাওয়ার নিয়ে আম-জনতার অভিযোগ এলেও তা পরীক্ষা করে কোথাও অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি এখনও। তবে টার্ম সেল (কলকাতা)-এর ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল অতনু ঘোষ বলেন, “এ বার থেকে টাওয়ার বসানোর আগে টার্ম সেল-এর অনুমতি লাগবে। এ ছাড়া প্রতিটি রাজ্যকে চিঠি দিয়ে বলা হয়েছে, এলাকায় টাওয়ার সমস্যা হলে প্রশাসন (পুরসভা বা পঞ্চায়েত)-কে জনগণকে সচেতন করতে উদ্যোগী হতে হবে।” যদিও বিকিরণ মাত্রার ওই মাপকাঠি নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। তাঁদের যুক্তি, ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসার মোবাইল ফোনের বিকিরণ থেকে ক্যানসারের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছে। এ ছাড়া মোবাইল টাওয়ারের অ্যান্টেনার বিকিরণ মাত্রার প্রভাব নিয়ে গবেষণা এখনও চলছে। ফলে কতটা পর্যন্ত বিকিরণ স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক নয়, তা নির্দিষ্ট করে বলার মতো সময় এখনও আসেনি।
যেমন বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ ভবতোষ বিশ্বাসের বক্তব্য, মোবাইল ফোন পরিষেবায় একটা ভারসাম্য রক্ষা করা প্রয়োজন। ক্যানসার বিশেষজ্ঞ শ্যামল সরকার বলেন, “বিকিরণ থেকে তৈরি তাপশক্তির নিরিখেই এই মাপকাঠি স্থির করা হয়েছে। জীবজগতের স্বাস্থ্যের উপর তার প্রভাব নিয়ে নয়। তা ছাড়া অনেক দেশেই বিকিরণের মাত্রা কম।”
তাঁর সঙ্গে সহমত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালেয়ের শিক্ষক ডঃ ভাস্কর গুপ্ত। তিনি বলেন, “রাশিয়া (১৯৭০ থেকে), বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরির মতো দেশে ১৮০০ মেগাহার্ৎজ-এর স্পেকট্রামের ক্ষেত্রে টাওয়ারের সর্বোচ্চ বিকিরণ মাত্রা প্রতি বর্গ মিটারে ০.০২ ওয়াট। অন্যত্র তা এই রকম: ০.৫ অকল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডে, ০.২৪ সিএসএসআর, বেলজিয়াম ও লুক্সেমবুর্গে, ০.১ পোল্যান্ড, চিন, ইতালি ইত্যাদি দেশে।” তাই ভারতেও সর্বোচ্চ সীমা আরও কমানোর দাবি তুলছেন তাঁরা।
টেলিকম শিল্পের পাল্টা যুক্তি, সে ক্ষেত্রে টাওয়ারের সংখ্যা কমে গেলে ভারতের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে সুষ্ঠু ভাবে টেলি পরিষেবা দেওয়া নিয়ে সমস্যা দেখা দিতে পারে। ভাস্করবাবুর অবশ্য পাল্টা দাবি, আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে কী ভাবে এই সমস্যা দূর করা যায় তার খোঁজ করতে গবেষণায় আরও লগ্নি করুক টেলিকম শিল্প।
এই বিতর্ক নতুন করে চিন্তায় ফেলছে বিএসএনএল-এর কর্তাদের। স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি নিয়ে দেশ জুড়ে চার বছর ধরে জল ঘোলা হওয়ার জন্য এই সময়ে একটিও নতুন টাওয়ার বসানোর বরাত পায়নি কলকাতা টেলিফোনস। সম্প্রতি অবশ্যনতুন ১৪৬টি টাওয়ার বসানোর ছাড়পত্র মিলেছে। টাওয়ারের বিকিরণ নিয়ে আতঙ্ক সেই পরিকল্পনায় কতটা প্রভাব ফেলবে, তা নিয়েই এখন সংশয়ে সংস্থাটির কর্তারা।আবার টাওয়ার না বসলে গ্রাহক পরিষেবা আরও বিঘ্নিত হবে বলে তাঁদের দাবি।
|