বাড়ির ঘুলঘুলিতে চড়াই আর বাসা বাঁধে না। বাগানে-বাগানে মৌমাছির চাক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ভরা বর্ষায় ব্যাঙের গ্যাঙরগ্যাং ডাক তো প্রায় স্মৃতিকথা। আর সন্ধের মুখে যাদের আনাগোনা দেখতে চোখ অভ্যস্ত ছিল, সেই বাদুড়-চামচিকেরাই বা গেল কোথায়?
এত কাল দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা এই দৃশ্য ও শব্দগুলো হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করেছেন মোবাইল ফোনের টাওয়ার থেকে বিচ্ছুরিত তড়িৎ-চুম্বকীয় বিকিরণকে। যার প্রভাবে জীবজগৎ জেরবার হয়ে উঠছে বলে ওঁদের অভিযোগ। বিশেষত পাখি-পতঙ্গের প্রাণ ওষ্ঠাগত। বিশেষজ্ঞদের দাবি: ওই বিকিরণের জেরে পশু-পাখি-পতঙ্গকূলের আচরণ যেমন বদলে যাচ্ছে, তেমন প্রভাব পড়ছে প্রজননে। জীবনশৈলীর
সঙ্গে দ্রুত কমছে তাদের সংখ্যা।
অবস্থা এতটাই উদ্বেগজনক যে, কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (বন্যপ্রাণী) বিবেক সাক্সেনা গত ৯ আগস্ট সমস্ত রাজ্যকে চিঠি পাঠিয়ে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে রাজ্যগুলোকে পাঠানো হয়েছে একগুচ্ছ পরামর্শ। সরকারি তথ্য বলছে, ২০১০-এর ১১ অগস্ট লোকসভায় এক সাংসদ তদানীন্তন কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, পশু-পাখির উপর মোবাইল টাওয়ারের প্রভাব কতটা। মন্ত্রী সে
দিন কোনও উত্তর দিতে পারেননি। কারণ, ‘বলার মতো’ কিছু তখন সরকারের হাতে ছিল না।
তবে ঘটনাটির প্রেক্ষিতে ওই মাসেরই ৩০ আগস্ট জীবজগৎ, বিশেষত পাখি-মৌমাছির উপর সেলফোন টাওয়ারের প্রভাব যাচাই করতে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়ে দেয় কেন্দ্র। বম্বে নেচার হিস্ট্রি সোসাইটির ডিরেক্টর আসাদ রহমানিকে মাথায় রেখে দশ সদস্যের কমিটি গবেষণায় নামে। এক বছর গবেষণা চালিয়ে ২০১১-র সেপ্টেম্বরে বন ও পরিবেশ মন্ত্রকে চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে কমিটি। |
আর তাতেই ধরা পড়েছে, ছবিটা কত উদ্বেগের। দিল্লিও চাইছে, মোবাইল টাওয়ারের কুপ্রভাব থেকে পশু-পাখিদের বাঁচাতে রাজ্যগুলো উদ্যোগী হোক। কী রয়েছে রহমানি কমিটির রিপোর্টে?
রিপোর্টের বক্তব্য: মনুষ্যসৃষ্ট (ম্যানমেড) তড়িৎ-চুম্বকীয় বিকিরণকে নবতম দূষণ বলা যেতে পারে। স্বল্প মেয়াদে এর তেমন কুপ্রভাব না-থাকলেও দীর্ঘ দিন এর সংস্পর্শে থাকলে খারাপ প্রভাব পড়তে বাধ্য। শুধু মোবাইল ফোনের টাওয়ার নয়, যে কোনও যোগাযোগ (কমিউনিকেশন্স) টাওয়ার থেকে নির্গত রেডিও-তরঙ্গ ও মাইক্রোওয়েভ একত্রিত হয়ে বায়ুমণ্ডলে একটি তড়িৎ-চুম্বকীয় ক্ষেত্র (ফিল্ড) তৈরি করে। শীতের সন্ধ্যায় শহরাঞ্চলে কুয়াশার সঙ্গে ধোঁয়া-ধুলো মিশে যে চোখ জ্বালানো দূষণ-চাদরের সৃষ্টি হয়, সেই ধোঁঁয়াশা বা স্মগের মতো এই ‘ইলেকট্রো-স্মগ’ও এক ধরণের দূষণ বিকিরণের দূষণ। পশু-পাখি-পতঙ্গের জীবনধারণের পক্ষে যা ক্রমশই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে বলে রিপোর্টের দাবি।
পরিস্থিতির আদর্শ উদাহরণ হিসেবে গবেষকেরা বলেছেন চড়াই পাখির কথা। দেশের বিভিন্ন শহর-মফস্সল-গ্রাম-বনাঞ্চলে পক্ষীকূলের উপরে তড়িৎ-চুম্বকীয় বিকিরণের প্রভাব যাচাই করতে গৃহস্থের এই অতি পরিচিত পাখিটি নিয়ে সমীক্ষা চালিয়েছিলেন ওঁরা। দেখা যাচ্ছে, মোবাইল টাওয়ার যত বেড়েছে, তত কমেছে চড়াইয়ের সংখ্যা। উন্নত পশ্চিমী দুনিয়াতেও তা-ই। ইউরোপের অনেক তাবড় শহরে ইদানীং চড়াইয়ের দেখা মেলা ভার। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমীক্ষা উদ্ধৃত করে রহমানি-রিপোর্ট জানাচ্ছে, ১৯৯৪-এ খাস লন্ডন শহরে যত চড়াই ছিল, সেলফোন টাওয়ারের দাপটে এখন তার ৭৫% উধাও! কেন?
রিপোর্টের ব্যাখ্যা, মোবাইল টাওয়ার নির্গত বিকিরণের কবলে পড়ে চড়াই প্রজনন ক্ষমতা হারাচ্ছে। অনেক সময়ে তড়িৎ-চুম্বকীয় ক্ষেত্রের মধ্যে পড়ে চড়াইয়ের ডিমও ফুটছে না। গবেষকেরা ৫০টি চড়াইয়ের ডিম পরীক্ষামূলক ভাবে ৩০ মিনিট ধরে তড়িৎ-চুম্বকীয় বিকিরণের মধ্যে রেখে দেখেছেন, সব ক’টাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে!
শুধু চড়াই নয়। রিপোর্ট বলছে, যে সব জায়গায় জিএসএম মোবাইল টাওয়ারের সংখ্যা প্রভূত, সেখানে চোখে পড়ার মতো কমছে শালিক, টুনটুনি, বুলবুলি, ময়না, টিয়াও। যেমন স্পেনের ভালাডোলিড শহরে মোবাইল ফোন বেস স্টেশনের কাছাকাছি তল্লাটে একটা সময়ে অগুন্তি সারস পাখি দেখা যেত। পরবতর্ীর্ কালে গবেষকেরা দেখেছেন, বিকিরণের প্রভাবে তাদের প্রজনন বাধা পাচ্ছে। ফলে এখন সারসেও টান।
মোবাইল টাওয়ার বেড়ে যাওয়ায় পতঙ্গকুলের অবস্থাও শোচনীয়। গবেষকরা মৌমাছির উপরে সমীক্ষা চালিয়ে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। বিকিরণের প্রভাবে মৌমাছির মধ্যে একটা অদ্ভুত আচরণ ধরা পড়েছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘কলোনি কোল্পাস ডিসঅর্ডার (সিসিসি)।’ সেটা কী?
গবেষকেরা জানিয়েছেন, টাওয়ারের আশপাশের মৌচাক থেকে হঠাৎ কোনও এক দিন কর্মী মৌমাছির দল উধাও হয়ে যাচ্ছে। কারণ, খাবার জোগাড় করতে গিয়ে তড়িৎ-চুম্বকীয় ক্ষেত্রের মধ্যে পড়ে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ছে, মৌচাকে ফেরার পথ চিনতে পারছে না। এবং মাঝপথেই মারা যাচ্ছে।
রিপোর্ট মোতাবেক, গত বছর আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে মৌমাছি প্রতিপালকদের ৬০ শতাংশ মৌচাকে এবং পূর্ব উপকূলের ৭০ শতাংশে এমন ঘটনা ঘটেছে। ভারতেও একইঅবস্থা বলে কমিটির দাবি। তাদের হিসেবে, আগে যেখানে একটি রানি মৌমাছি দিনে গড়ে সাড়ে তিনশো ডিম পাড়ত, এখন তা কমে একশোয় দাঁড়িয়েছে। পরিণামে দ্রুত কমছে মৌমাছির সংখ্যা।
মৌমাছি একটা দৃষ্টান্ত মাত্র। রহমানি কমিটির মতে, মোবাইল টাওয়ারের বিকিরণের মুখে অন্যান্য পতঙ্গও অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছে। যার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ, পতঙ্গের সংখ্যা কমলে ফুলের পরাগমিলন ব্যাহত হবে, যার জেরে ফসলের উৎপাদনশীলতা কমতে বাধ্য।
কিন্তু মোবাইল টাওয়ার বাড়লেও মশা-মাছির দাপট তো কমছে না!
ডেঙ্গি-রাজের শিকার নগরবাসীর মনে এই মুহূর্তে প্রশ্নটি জাগা স্বাভাবিক। যার ব্যাখ্যা হিসেবে বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, যোগাযোগ টাওয়ারের বিকিরণের জেরে তড়িৎ-চুম্বকীয় ক্ষেত্র যে উচ্চতায় তৈরি হয়, মশা বা মাছি সেই উচ্চতায় উড়তে পারে না। সুতরাং বিকিরণের আঁচ তাদের গায়ে লাগছে না। তবে পাখি-পতঙ্গের মতো ইঁদুর, বাদুড়, চামচিকে, বাঙের জীবনযাপনেও যে এই বিকিরণ-দূষণের মারাত্মক প্রভাব পড়ছে, কমিটি তা জানাতে ভোলেনি।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার কী ভাবছে? রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষদস্তিদার বলেন, “মোবাইল টাওয়ারের সম্ভাব্য কুপ্রভাব সম্পর্কে রাজ্য ওয়াকিবহাল। এই বিপদ রুখতে সবার আগে আমরাই উদ্যোগী হয়েছি।” মন্ত্রীর দাবি, রাজ্য সরকারের নেওয়া ব্যবস্থাগুলো কিছু দিনের মধ্যে সকলের নজরে আসবে। যত্রতত্র টাওয়ার বসাতে দেওয়া হবে না। যদিও বনমন্ত্রী হিতেন বর্মন এখনও এ বিষয়ে অবহিত নন। “দিল্লির সুপারিশ খতিয়ে না-দেখে মন্তব্য করব না।” বলেন তিনি। |