প্রবন্ধ...
কেন এই জীবন
ত্তরের উপর বয়স মানুষটির, নিঃসঙ্গ, পরিবার থেকে এক রকম বিচ্ছিন্নই, একা একা পার্কে এসে বসে, সকলের কথা শোনে, তাদের জন্যে কিছু-না-কিছু করার চেষ্টা করে। এক দিন একটি মেয়ে এসে তাকে জানায় যে তার স্বামী খুন হয়েছে দুর্বৃত্তদের হাতে। মেয়েটি চায় প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে, ইতিমধ্যেই দুর্বৃত্তদের এক জন তার হাতে খুন হয়ে গিয়েছে। স্বেচ্ছায় সে খুন করেনি, আক্রান্ত হয়ে নিজেকে বাঁচানোর জন্যেই করেছে। কিন্তু এ বার সে বাকিদের স্বেচ্ছায় খুন করতে চায়। তখন এই মানুষটি মেয়েটিকে বোঝায়, প্রতিহিংসার রাস্তায় তুমি বাঁচতে পারবে না, তোমাকে অন্য বাঁচার পথ খুঁজতে হবে। বলে, তুমি প্রতিশোধ চাও, কিন্তু ও দাওয়াই আমার কাছে নেই।
এটা খুব বড় একটা মূল্যবোধ বলে আমার মনে হয়। অন্তত এ যুগে। প্রতিশোধস্পৃহ হয়ে যদি ক্রমাগত পরস্পরের ক্ষতিসাধন করতে থাকি আমরা, তা হলে তো এর কোনও শেষ নেই, এই ভয়ংকর অসুখ বাড়তেই থাকবে। অতনু ঘোষের ছবি ‘রূপকথা নয়’ এ রকমই কিছু প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়, কী ভাবে বাঁচব তা নিয়ে ভাবিয়ে তোলে। আমি যে সত্তরোর্ধ্ব চরিত্রটিতে অভিনয় করেছি, সে যেমন এই মেয়েটির চাওয়াকে নিবৃত্ত করছে, তেমনই আবার কারও কারও চাওয়াকে উজ্জীবিত করছে, তাকে জীবন সংগ্রামে উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা করছে। নানা রকম চাওয়া নিয়ে নানা পেশার মানুষ আসে তার কাছে, সে সকলের জন্যেই কিছু করতে চেষ্টা করে। আর পাঁচটা মানুষের চেয়ে সে যেন একটু এগিয়ে-থাকা মানুষ। নিজের চাওয়া-পাওয়াকে সরিয়ে রেখে প্রায় পরার্থে সঁপে দিয়েছে নিজেকে। তার জীবন-আকুতির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ওই গানটাকে মিলিয়ে নেওয়া যায়: চাওয়া-পাওয়ার পথে পথে দিন কেটেছে কোনোমতে,/ এখন সময় হল তোমার কাছে আপনাকে দিই আনি।
চাওয়ার বদলে চাই-না’র মধ্যে চলে যাওয়ার এই ক্ষমতা আমাদের মানুষজন ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে। অথচ এটা এ দেশেরই এক বিশেষত্ব, আমাদের ভারতীয়তার এক অংশ, প্রকাশ বা চিহ্নও বলা যায়। চাওয়ার প্রশ্নে আমি মোটেও সাধুসন্ন্যাসী নই, আমরা কেউই নই, আমাদের অনেক কিছুই লাগে। কিন্তু আজকাল আমাকে সবচেয়ে ব্যথিত করে এই চাওয়াটা। বড়ই পার্থিব, মূল্যবোধ থেকে একেবারে বিযুক্ত। মানুষ এখন সেই চাওয়ার পিছনে বড্ড বেশি ছুটছে। যেন এই চাওয়াটাকে যেমন করেই হোক চরিতার্থ করতে হবে।
ছবি: ‘রূপকথা নয়’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য
এর ঠিক উল্টো স্রোতের বলেই ‘রূপকথা নয়’-এর মানুষটা আমায় মুগ্ধ, মোহগ্রস্ত করে রেখেছে। দিস ইজ দ্য লেটেস্ট জাংশন দ্যাট আই হ্যাভ রিচ্ড আফটার ট্রাভেলিং সো মেনি মাইলস। মানুষটা যেন এক ‘মানববন্ধু’র ভূমিকা নিয়েছে। তার এক দুর্লভ গুণ: সে শ্রোতা, সবার কথা শোনে। এ ভাবে সে নিজেকে সংযুক্ত রাখে জীবনের সঙ্গে। মানুষ এখন নিজের হৃদয় উন্মোচন করে দেয় একমাত্র মনোবিদের কাছে, তিনি কাউন্সেলিং করেন। এ মানুষটারও ভূমিকা সে রকম।
তপনদার (সিংহ) ‘হুইলচেয়ার’-এ আমার অভিনয় করা চরিত্রটা মনে আছে? এক প্রতিবন্ধী ডাক্তারের লড়াইয়ের ছবি, যে নিজেও প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য লড়াই করে। আত্মরক্ষা আর সেবা, দুটোই যেন এসে মিশেছে তার মধ্যে। অ্যাক্সিডেন্টে দু’টি পা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর মানুষটা বুঝতে পারে তাকে কাজ করে যেতে হবে, না হলে সে বাতিল হয়ে যাবে। আবার সে কাজ করে সেবার জন্য, সেই সব মানুষের সেবার জন্য, যারা তার মতোই কোনও প্রতিবন্ধের সঙ্গে লড়ছে।
একই ভাবে সমস্ত রকম প্রতিবন্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ক্ষিদ্দা। সরোজ দে’র ‘কোনি’তে মেয়েটি তার ক্ষিদ্দার কাছে যেন এক অস্ত্র বা খড়্গ, যা দিয়ে সে সামাজিক প্রতিবন্ধগুলোকে কাটছে। এক গরিব বস্তির সাঁতারু মেয়েকে লড়াইয়ে শামিল করার জন্যে সে নিজেকে সঁপে দিচ্ছে। আমার কাছে ক্ষিদ্দা এক আধুনিক বীর, ঠিক মহাভারতের অর্জুনের মতো, যে বুঝতে পারে মানুষের ক্ষমতার সীমা কত দূর, যে ন্যায়ের জন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ে।
সম্প্রতি ‘অলীক সুখ’-এ (শিবপ্রসাদ আর নন্দিতার ছবি) একটা ছোট্ট চরিত্রে আমি আছি এক প্রবীণ ডাক্তারের ভূমিকায়। সে তার পরবর্তী প্রজন্মের ডাক্তারকে যখন প্রশ্ন করে— কার পিছনে ছুটছ তুমি, কীসের জন্য ছুটছ, তখন ছবির ওই নায়ক নবীন ডাক্তারটি বলে: আমি তো কোনও দিন আপনি হতে পারব না স্যার।
আমার তখন প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে: কেন পারবে না? যুগ যুগ ধরে মানুষের কাছে শিক্ষণীয় কত কিছু রয়েছে। মানুষ তো দেখে শেখে, ঠেকে শেখে। আমাদের দেশে এমন সব মানুষ জন্মেছেন... বাঘাযতীন বন্দুক-হাতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মৃত্যুবরণ করেন, তাঁকে দেখে তো বহু মানুষ প্রাণিত হয়েছিলেন। দেশ এমন একটা ব্যাপার, তার জন্য যে প্রাণ দেওয়া যেতে পারে, এ তো আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছ থেকেই শিখেছি। অন্য সব প্রেমই তো সত্য, কিন্তু তার মধ্যে দেশপ্রেম যেন আরও বড় কোনও সত্য। মধুসূদনের শেষ যে সনেট, চতুর্দশপদী কাব্যের শেষেরটি:
‘এই বর, হে বরদে, মাগি শেষ বারে,—
জ্যোতির্ম্ময় কর বঙ্গ— ভারত-রতনে!’

এ তো নিজের থেকে অনেক বড় কিছুর জন্য চাওয়া। মৃত্যুর আগে শেষ লেখাটিতে মধুকবি বলছেন যে, আমি যেন দেখতে পাই আমার দেশটা বড় হচ্ছে। নিজের জন্য নয়, দেশের জন্য চাওয়া। অথচ আমাদের কত রকমের চাহিদা বা চাওয়া, সব কিছু পেতে-চাওয়া... আমরা কবে যে দিতে-চাওয়ায় পৌঁছব, জানি না।
আজকাল মাঝে মাঝেই আমার কাজটায় মোটিভেশন খুঁজে পাই না। ভাববেন না যে, সাফল্যের শিখরে পৌঁছে এক ধরনের আত্মশ্লাঘা থেকে কথাগুলো বলছি। বরং অভিনেতা হিসেবে আমি বরাবরই অতৃপ্ত, আমার চরিত্রগুলোর মধ্যে মানুষের স্বরূপ বা তার অন্তর্জীবনের বৈচিত্র না পেলেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছি— জীবন্ত সত্য চরিত্রের জন্যে আর কত কাল অপেক্ষা করব? তবু মাঝে মাঝেই আজকাল মনে হতে থাকে: কী করলাম এত দিন? কার কোন উপকারে এলাম?
ছেলেবেলায় এন সি সি করতে করতে একটা কথা শিখেছিলাম: সার্ভিস বিফোর সেল্ফ। এই তিনটে শব্দ উচ্চারণ করলেই আমার অ্যালবার্ট শোয়াইট্জার-এর কথা মনে পড়ে যায়। জার্মান ডাক্তার এবং সংগীতজ্ঞ। ইউরোপের সব সুখস্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে আফ্রিকায় চলে গিয়েছিলেন, সেখানকার মানুষজনের সেবায়, তাঁদের স্বাস্থ্য উন্নয়নে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। ওই মানুষটার এক সহস্রাংশও যদি করতে পারতাম, আমার জীবন চরিতার্থ হত। কিন্তু ওঁর সেবা-পদ্ধতির অধিকারী তো আমি নই, ওঁর কাজ আমি কী করে পারব, বরং ব্যর্থ হব। তা ছাড়া এই বয়সে দায়িত্বহীনের মতো ছেলেমেয়ে-স্ত্রী-সংসার ছেড়ে চলে যাওয়াটাও আত্মধ্বংসাত্মক।
তখন মনে হয়, জীবনের প্রথম থেকে যে কাজ করে মানুষের মনকে স্পর্শ করতে পেরেছি, তাতেই ব্রতী থাকব। আমার অভিনয় দেখে যত মানুষ তিলেকমাত্র আনন্দ পেয়েছেন, একটা মুহূর্তের জন্য হলেও প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরনোর সময় আমার অভিনয়টুকু মনে করে প্রসন্ন মনে বাড়ি ফিরেছেন, বা পরবর্তী কালে তাঁদের মনে পড়েছে, ‘ফাইট কোনি, ফাইট’... এইটিই আমার সেবা, এইটিই আমার সার্ভিস টু মাই সোসাইটি, টু মাই কান্ট্রি, সার্ভিস বিফোর সেল্ফ।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.