নিয়মিত ব্যবধানে পরিকল্পিত উপবাস দেহকে গ্লানিমুক্ত করে, হৃদয়কে সংযমে দীক্ষা দেয়। জাপানে শুরু হইল ‘ডিজিটাল উপবাস শিবির’। অন্যান্য দেশে কাণ্ডটি বিচ্ছিন্ন ভাবে ঘটিতেছে, ‘সামার ক্যাম্প’ও রহিয়াছে, যাহাদের স্লোগান ‘ডিসকানেক্ট টু রিকানেক্ট’— আন্তর্জাল হইতে নিজেকে বিযুক্ত করুন, যাহাতে নিজের সহিত যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হয়। কিন্তু এগুলি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। জাপান সরকার ঐচ্ছিক শিবির শুরু করিল টিন-এজারদের জন্য। সমীক্ষায় প্রকাশ, জাপানি বিদ্যালয়ে পাঠরত প্রায় পাঁচ লক্ষ আঠারো হাজার ছেলেমেয়েকে ‘ডিজিটাল অ্যাডিক্ট’ বলা যাইতে পারে, যাহারা ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, ভিডিয়ো গেম লইয়া দিনের অধিকাংশ সময় (কেহ কেহ পাঁচ ঘণ্টারও অধিক) ডুবিয়া থাকে, ফলে তাহাদের পড়াশোনা তো বটেই, এমনকী নিদ্রা ও পুষ্টিও ব্যাহত হইতেছে। সরকার চায়, তাহারা খোলা আকাশ-বাতাসে বাহির হইয়া, খেলাধুলা করিয়া, পরস্পরের সহিত চাক্ষুষ আলাপ করিয়া অন্তত কয়েকটি দিন যাপন করুক। তাহাতে তাহারা হয়তো বুঝিবে, জীবন কম্পিউটার স্ক্রিনের বাহিরেও অবস্থান করে। এই ‘ডিজিটাল ডিটক্স’ লইয়া সমগ্র বিশ্বেই ভাবনা চলিতেছে, হাসাহাসিও। একটি দূষণহীন স্থানে কিছু দিন কাটাইলে যেমন ‘পুনরুজ্জীবিত’ হইবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, বিভিন্ন রিসর্টে প্রবেশদ্বারের বাহিরে ফোন, ট্যাবলেট, মায় ঘড়িটিও জমা রাখিয়া ভিতরে ঢুকিয়া সর্ব অর্থেই ‘প্রকৃতি’র মুখোমুখি হইবার বিজ্ঞাপন ছড়াইয়া পড়িতেছে। নিন্দুকরা বলিতেছেন, আন্তর্জাল-আকর্ষণকে তীব্র কু-অভ্যাস বলিয়া প্রচারের প্রবণতা অতীব রক্ষণশীল বদ্ধ মনোভাবের প্রকাশ, ‘বাস্তব’ এখন বদলাইয়া গিয়াছে, ভার্চুয়াল বিশ্ব আকাশ-বাতাসের সমান সত্য, নির্জন নির্ঝরের পার্শ্বে চিৎ হইয়া শুইয়া থাকা যত জরুরি, ফেসবুকে সহস্র মানুষের চিন্তাস্রোতের সহিত যুক্ত থাকাও ততই গুরুত্বপূর্ণ। ডিটক্স-পন্থীরা তখন ‘নির্ভরতা’ ও ‘নেশা’র পার্থক্য লইয়া গলা ফাটাইতেছেন।
মানুষ সত্যই এক আশ্চর্য জীব, যে সোফায় থম মারিয়া বসিয়া টিভি সিরিয়াল গিলিয়া নিজের মেদ বৃদ্ধি করে, আবার সেই মেদ ঝরাইতে প্রচুর পয়সা দিয়া যন্ত্র কিনিয়া তাহার উপর চড়িয়া হুপহাপ ব্যায়াম করে। বারংবার সতর্কীকরণ সত্ত্বেও ধূমপান করিয়া মদ্যপান করিয়া কাঁড়ি মিষ্টান্ন গিলিয়া স্বাস্থ্যের বারোটা বাজায়, আবার ঔষধ কিনিতে ট্যাঁকের কড়ি খসিলে বিলাপ করে। মনুষ্যজীবনকে এক ধারাবাহিক সংযমহীনতার ইতিহাস হিসাবে ব্যাখ্যা করা যায়। কথায় বলে, পাগলেও নিজের ভাল বুঝে। মিথ্যা। প্রায় কোনও মানুষই নিজের ভাল বুঝে না। কোনও না কোনও লোভ তাহাকে অতিরেকের দিকে, জানিয়াশুনিয়া স্ববিনাশের দিকে টানিয়া লইয়া যায়। সর্ব ক্ষণ বসিয়া কুঁজো হইয়া আন্তর্জাল-সফর ও ফোনবিলাস কেবল যে ঘাড়ের ব্যথা বাড়াইতেছে ও চক্ষে চশমা ঠুসিয়া দিতেছে তাহাই নহে, মানুষের গার্হস্থ্য জীবন, কর্মজীবন, আর্থিক পরিস্থিতিকেও বিড়ম্বিত করিতেছে। সে অফিসে কাজ না করিয়া পর্দায় প্লেন হানিতেছে, রাত্রে যৌনতা না করিয়া পর্নো-সাইট দেখিতেছে। প্রোমোশন না পাইয়া (কারণ সে তো অফিসে ফাঁকি দিয়াছে, পারিবারিক অশান্তিও তাহাকে সনিষ্ঠ কাজ করিতে দিতেছে না) টাকা কম কামাইতেছে। স্বাভাবিক বুদ্ধিটুকু থাকিলেই সে ভারসাম্য রক্ষা করিয়া চলিতে পারিত, এখন আবার প্রবল খরচা করিয়া ‘উপবাস শিবির’-এ ঢুকিবে। আত্মনিয়ন্ত্রণহীন, নিজ পায়ে ধারাবাহিক কুড়াল মারিয়া চলা এই জাতি হয়তো এক সময় ‘নিবৃত্তি-শিবির’ভুক্ত হওয়াকে এমন উদগ্র নেশায় পরিণত করিবে, তাহা ছাড়াইতে নূতন ‘আন্তর্জালে ধরা দিন’ ক্যাম্প শুরু! |