প্রত্যয়ী হাসিমাখা, বুদ্ধিদীপ্ত চাহনির সেই মুখ এখন অনেকেরই পরিচিত। দেখা মিলল ‘দ্য টেলিগ্রাফ স্কুল অ্যাওয়ার্ডস ফর এক্সেলেন্স’-এর মঞ্চেও।
মঞ্চের পিছনের পর্দায় অনাবিল হাসছেন তিনি বরুণ বিশ্বাস। সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর মা-বাবা। প্রেক্ষাগৃহে গমগমিয়ে বাজছে বব ডিলান, ‘হাউ মেনি রোডস মাস্ট আ ম্যান ওয়াক ডাউন, বিফোর ইউ কল হিম আ ম্যান’। শনিবারের সায়েন্স সিটি-তে ‘মানুষের মতো মানুষ’ এই বরুণকেই তাঁর সারা জীবনের অবদানের জন্য কুর্নিশ জানানো হল।
এই শতকের গোড়ায় উত্তর ২৪ পরগনার মফস্সল সুটিয়ায় লাগাতার ধর্ষণের ঘটনায় দোষীদের চিহ্নিত করে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বরুণ। বরুণ ও তাঁর সাথীদের আন্দোলনেই তৎপর হয়ে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় প্রশাসন। নদীর খাল সংস্কার করে ওই তল্লাটের ভেড়ি-মালিকদেরও বিরাগভাজন হয়েছিলেন তিনি। অকুতোভয় প্রতিবাদের মাসুলও দিতে হয় বড্ড তাড়াতাড়ি। গত বছরের ৫ জুলাই এই ছাত্রদরদী স্কুল শিক্ষককে গুলি করে মারে আততায়ীরা। সম্প্রতি একটি বাংলা ছবিতেও উঠে এসেছে বরুণের জীবন ও তাঁর প্রেরণার কথা। আয়ুর বিচারে অনতিদীর্ঘ, কিন্তু
সমাজে গভীর ছাপ ফেলে যাওয়া এই জীবনকেই এ দিন সম্মান জানালেন সংগঠকেরা। |
ছেলে বরুণের পুরস্কার নিচ্ছেন বাবা-মা। শনিবার। ছবি: প্রদীপ আদক |
দ্য টেলিগ্রাফ স্কুল পুরস্কারের ‘লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট’-এর জন্য সাধারণত শিক্ষাব্রতী কোনও প্রবীণকেই বেছে নেওয়া হয়। কিন্তু মধ্য তিরিশের বরুণ ব্যতিক্রম ঘটালেন। বিশ শতকের কলকাতার আর্তদরদী সাহসী চিকিৎসক নেলি বেলা ও’ব্রায়েনের নামাঙ্কিত পুরস্কার নিতে মঞ্চে উঠলেন বরুণের মা-বাবা। জগদীশ বিশ্বাস ও গীতা বিশ্বাস। মঞ্চে বরুণের কথা যখন বলা হচ্ছিল, তখন অঝোরে কাঁদছিলেন শীর্ণা প্রৌঢ়া গীতাদেবী। অতি কষ্টে কান্না গিললেন জগদীশবাবু। নিহত পুত্রের হয়ে পুরস্কার নিয়ে বরুণের বাবা কোনও মতে বললেন, “আমার ছেলের মতো ছেলে সব পরিবারে থাকা দরকার।”
কিছু দিন আগে পর্দায় ‘ছেলে’কে দেখতেও সিনেমা হলে গিয়েছিলেন বরুণের মা-বাবা। বরুণকে নিয়ে ইতিউতি অজস্র অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ আসে। মঞ্চ থেকে নেমে গীতাদেবী কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “বরুণের মা-বাবা বলেই কষ্ট হলেও আমাদের যেতেই হয়! আমরা চাই, ঘরে-ঘরে বরুণের মতো ছেলেমেয়েরা গড়ে উঠুক।” বরুণের দাদা-দিদিরা বলছিলেন, কোথায় কোন ছেলের টাকার অভাবে পড়াশোনা হচ্ছে না, গ্রামের কোন গরিব মানুষ রোগে কষ্ট পাচ্ছেন সবার জন্য বরুণের প্রাণ কাঁদত। মাসের দশ তারিখ পেরিয়ে গেলেই লোকের সেবায় মাইনে উজাড় করে কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনের বাংলার মাস্টারমশাইয়ের পকেট ঢুঢু। বরুণের পরিবার ও সুটিয়ার প্রতিবাদী মঞ্চ এখনও দুঃস্থ পড়ুয়াদের পাশে দাঁড়াচ্ছে। জগদীশবাবুর কথায়, “এই পুরস্কার যাঁরা দিচ্ছেন, তাঁরাও বরুণের কাজই করে চলেছেন।” |