শিক্ষার গণ্ডি পার করে লোক-বাংলাকেও সেলাম
রাসিনা বেওয়া। মুর্শিদাবাদের জীবন্তি এলাকার অখ্যাত গাঁয়ের মেয়ের ভেতরে এত শক্তি কে জানত! সেই পাঁচ বছর বয়সে আধো-বুলিতে শেখা বিয়ের গান, জারি গানের সম্ভারকেই তাঁর অস্ত্র করে তুলেছেন। গ্রামে গ্রামে বন-সৃজন, পরিচ্ছন্নতার প্রসারে কিংবা পণপ্রথা রুখতে তাঁর বার্তা ছড়িয়ে দিতে শৈশবের সুরের বীজমন্ত্র রাসিনা আজও বহন করছেন। গ্রামের মেয়েদের লাঠিখেলা কিংবা খেজুরপাতা, পুঁতি, পাটের হস্তশিল্পে তালিম দিয়ে প্রৌঢ়া তাঁদের দুর্গাপুর গ্রামে প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছেন।
নানুরের ‘শ্রীনাথ বহুরূপী’ সুবল দাস বৈরাগ্য বা মুর্শিদাবাদের আলকাপ গুরু করুণাকান্ত হাজরাই বা কম কীসে! বহুরূপীদের পরম্পরার অন্যতম শেষ প্রতিনিধি সত্তরোর্ধ্ব সুবলবাবু এখনও ভোলবদলের কসরতে সিনেমাপাড়ার সেরা মেকআপ-শিল্পীদের তাক লাগিয়ে দেবেন। একাধারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নজরুল ইসলাম সেজে শনিবার কলকাতাকে ক্ষণিকের জন্য তাঁর প্রতিভার বিচ্ছুরণ চিনিয়ে গেলেন। লোকনাট্য আলকাপের শাণিত ব্যঙ্গের কষাঘাতে করুণাবাবুও ফুটিয়ে তোলেন নিম্নবর্গের মার-খাওয়া মানুষের বারমাস্যা। ষাট পেরিয়েও নতুন শিল্পী গড়ার তাগিদে ক্লান্তি নেই তাঁর।
শনিবার, সায়েন্স সিটি-র মঞ্চে ‘দ্য টেলিগ্রাফ স্কুল অ্যাওয়ার্ডস ফর এক্সেলেন্স’-এর আসর লোকায়ত বাংলার এই অখ্যাত নায়ক-নায়িকাদের এক সঙ্গে মিলিয়ে দিল। ‘হল অফ ফেম’-এর স্বীকৃতি পেলেন রাসিনা। সুবলবাবু ও করুণাবাবুর জন্যও ছিল বিশেষ স্বীকৃতি। আঠারো বছর পার করে বয়সের নিরিখে সাবালকত্বের লগ্নে ‘দ্য টেলিগ্রাফ স্কুল পুরস্কার’-এর আসরে এ বার এক নতুন উড়ান। ছকে-বাঁধা শিক্ষার গণ্ডিতে আটকে না-থেকে লোকসংস্কৃতির পাঠশালায় ঢুকে পড়ল এই অনুষ্ঠান। তাই লুপ্তপ্রায় লোকসংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে লড়াই করে চলেছেন যে শিল্পীরা, এ দিনের আসরের মঞ্চ প্রধানত তাঁদেরই। এই লড়াকুদের অনেককেই বৃত্তি-অনুদান দেওয়া হয়েছে।
টিটিআইএসের মঞ্চে রাসিনা বেওয়ার হাতে পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন আনন্দবাজার সংস্থার
প্রধান সম্পাদক অভীক সরকার। শনিবার সায়েন্স সিটি প্রেক্ষাগৃহে। ছবি: প্রদীপ আদক
এ বছরের অনুষ্ঠান শুরুই হয়েছে মুর্শিদাবাদের রায়বেঁশে ও রণপা নাচ দিয়ে। তার পরে ক্রমশ ছৌ, লাঠিখেলা, নাটুয়া, ভাওয়াইয়া-বৈরাতি, মুসলিম বিয়ের গানের আসর বাংলার ধনুকের ছিলায় ছিলায় যত টান! বাঁশের ডগায় বছর ছয়েকের বালককে বসিয়ে যে রায়বেঁশে শিল্পী মুখ দিয়ে বাঁশটা ধরে রাখেন, কিংবা অনবরত জ্বলন্ত আগুন গিলে মুখের ভিতরে তা নিভিয়ে ফেলেন, তাঁদের আটকাবে জীবনের কোন বাধা? কিন্তু পণ্যায়নের ঝোঁক ক্রমশ সংস্কৃতির এই ধারাগুলিকে বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। তাই অস্তিত্বের সঙ্কট এই মানুষগুলোর।
পুরুলিয়া থেকে ছৌ নাচ দেখাতে এসেছিলেন জধারাম কুমার। বললেন, “এই নাচ দেখিয়ে কি আর সংসার চলে? পাশাপাশি দর্জির কাজও করি।” বাপ-দাদার ধারা ধরে রাখতে তবু ছেলেদের ছৌ শিখিয়েছেন জধারাম। জলপাইগুড়ির সুলেখা রায়, নারায়ণ রায়েরা ভাওয়াইয়া গান আর বৈরাতি নাচের শিল্পী। ক্বচিৎ-কদাচিৎ সরকারি পুরস্কার জুটলেও সংসারের সুরাহা হয়নি সুলেখার। নারায়ণবাবু বলছিলেন, “এই গান উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজের বিয়েবাড়ির গান। আমার দুই মেয়েকেও শিখিয়েছি। লোকে আজকাল বিয়েতেও ব্যান্ডপার্টির সিনেমার সুর শুনতে চায়। তবু হাল ছাড়িনি।”
হার না-মানা এই মানুষগুলোর মাঝেই এ দিন এক বন্ধনীতে ধরা পড়লেন বাজারের ডিমব্যবসায়ীর ঘরের মেয়ে এভারেস্ট শৃঙ্গজয়ী টুসি দাসের মা সবিতা দাস ও বড়দি শ্রীপর্ণা নন্দী। শ্রীপর্ণা নিজেও ক্যারাটের ব্ল্যাকবেল্ট। ওঁরা এসেছিলেন কৃতীদের পুরস্কার দিতে। ৭০ ছুঁইছুঁই ‘তরুণী’ মঞ্জুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ও মঞ্চে উঠলেন গটগটিয়ে। শিক্ষকতা থেকে অবসর নেওয়ার পরে কলকাতার বিধান সরণির মঞ্জুশ্রীর বয়স হযবরল-র ঢঙে উল্টো দিকেই হাঁটতে শুরু করেছে। ‘সিনিয়র সিটিজেন’ হওয়ার পরেই খেলাধুলোর ইনিংস শুরু করেন তিনি। দৌড়ের বিভিন্ন ইভেন্ট ও লংজাম্পে বয়স্কদের এশিয়ান গেমসে পদক পেয়েছেন। একটু চোট পেলেও এখনই দৌড় থামাতে রাজি নন মঞ্জুশ্রী। প্রবীণদের অলিম্পিকের পদকটা একটুর জন্য মিস্ হলেও পরের বার ফের চেষ্টা জারি রাখতে চান। এক সময়ের নামী ফিল্ম-এডিটর অরবিন্দ ভট্টাচার্যও এখন দারিদ্রের সঙ্গে যুঝছেন। অকালে যুবক পুত্রকে হারানোর পরে বৃদ্ধ বয়সে তারাতলায় ভাতের হোটেল চালিয়ে তিনি সংসার চালাচ্ছেন। এঁরা সকলেই এ দিনের অনুষ্ঠানের এক-একটি দাগ-কাটা চরিত্র হয়ে উঠেছেন।
কোনও কোনও মানুষ জীবনে কখনওই হার মানতে রাজি নন। আবার কেউ কেউ থাকেন, মৃত্যুও যাঁদের কাছে হেরে ভূত হয়ে গিয়েছে। ‘লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্টে’ তাই এ দিন ভূষিত হয়েছেন সুটিয়ার বরুণ বিশ্বাস। বিশেষ স্বীকৃতি ছিল সমৃদ্ধি রায়ের জন্যও। ব্লাড ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করেই গার্ডেন হাইস্কুলের ছাত্রী সমৃদ্ধি ৯২.৪ শতাংশ নম্বর পেয়ে আইসিএসই পাশ করেছিল। পুরস্কারের এই আসরের ঠিক ২০ দিন আগে গত ১১ অগস্ট তার জীবনের লড়াই কিন্তু থেমে গিয়েছে। মেয়ের হয়ে পুরস্কার নিতে এসেছিলেন সমৃদ্ধির মা। কান্নায় বুজে আসা গলায় তিনি বলেন, “হাসপাতালে শুয়ে সমৃদ্ধি আমায় বলেছিল, মা তুমি কি আমার পুরস্কারটা নিতে যেতে পারবে? সমৃদ্ধি এই দেখ্, আমি তোর জন্য এসেছি।”
এসেছিলেন সুভদ্রা ভৌমিকও। শ্রীরামপুরের দরিদ্র পরিবারের মেয়ে সুভদ্রার হাত দু’টো কাজ করে না। পা দিয়ে লিখে এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে বাগনান কলেজে ভর্তি হয়েছেন সুভদ্রা। দেগঙ্গার সানোয়ার হোসেনের বাবা ঝাঁটা তৈরি করেন। বাবাকে সাহায্য করার ফাঁকে পড়াশোনা চালিয়ে সানোয়ার এ বারের মাধ্যমিকে ৮০ শতাংশেরও বেশি নম্বর পেয়েছেন। তাঁর স্বপ্ন এখন ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। শ্মশানের চিতার আলোয় পড়াশোনা করে উচ্চ মাধ্যমিকে ৮৬.২ শতাংশ নম্বর পেয়েছেন বিড়িশ্রমিকের ছেলে সুশান্ত হালদার। এই হার না-মানা মনকেই কুর্নিশ করেছেন ‘দ্য টেলিগ্রাফ এডুকেশন ফাউন্ডেশন’-এর চেয়ারম্যান সুকান্ত চৌধুরী। তাঁর মতে, “এই না-পাওয়ার কারণটা হয়তো বরাতের কিংবা সমাজের দোষে। কিন্তু সে জন্য একটুও পিছিয়ে থাকতে রাজি নয় ওরা।”
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.