স্মরণ
বুঝলি, আমার মনে হয় ক্যান্সার বা টিবি হয়েছে
বেশ লম্বা, ধবধবে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি, চোখে চশমা, রাস্তা পার হওয়ার সময় নাকে সাদা রুমাল চেপে কে সি দাসের দোকানের দিকে যেতে যেতে বন্ধু শিশির লাহিড়িকে যখন চাপা গলায় বললেন, “এ ব্যাটাকে কাটা শিশির”, তখন আমি ঠিক দু’হাত পিছনে। বাক্যটি শুনতে অসুবিধা হয়নি।
আনন্দবাজার থেকে বেরিয়ে তখন ওই যাত্রায় অনেক লেখককে নিয়মিত দেখা যেত। বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, সুধাংশু ঘোষ, অভ্র রায়, সত্যেন্দ্র আচার্য, প্রলয় সেন, নিখিল চন্দ্র সরকার, তুলসী সেনগুপ্তদের কেউ বেশ পরিচিত, কেউ বহু কাল লিখেও তেমন পরিচিতি পাননি। কিন্তু কে সি দাস-কার্জন পার্কের আড্ডায় সবাই বিমল করের সান্নিধ্য পেতে নিয়মিত আসতেন।
ছাত্রাবস্থায় ওঁদের দেখেছি আনন্দবাজার থেকে কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের বসন্ত কেবিনে হেঁটে গিয়ে আড্ডা মারতে। তখন শীর্ষেন্দুদাকেও বিমল করের সঙ্গী হতে দেখেছি। শিশির লাহিড়ি বলেছিলেন, ‘পারব না বিমল, এ শালা চায়ের পেটি মাথায় নিয়ে জলপাইগুড়ি থেকে এসেছে। বাংলা সাহিত্যের দোকানে ও চা সাপ্লাই দিয়ে যাবে।’ শুনে বিমল কর বলেছিলেন, “এই যে ছোকরা, এসো। কিন্তু বড়দের গল্প শুনে বন্ধুদের বলে বেড়াবে না।”
অত্যন্ত খুঁতখুঁতে মানুষ। লেখা শুরুর সময় প্রথম পাতাটা কত বার ছিঁড়তেন তার ইয়ত্তা নেই। শব্দ পছন্দ না হলে পরের লাইনে যেতেন না। সেই সিঁথির বাড়ি থেকে এই দৃশ্য দেখে এসেছি।
আমি যখন স্কুলের শেষ ধাপে, তখন জলপাইগুড়ির বাবুপাড়া পাঠাগারের সুধীন পাত্র একটা বই এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “ছোটগল্পগুলো পড়ে দ্যাখ। বাংলা গল্প কী ভাবে এঁর হাতে পালটে গেল, বুঝতে পারবি।” পারতাম। তখন তারাশংকর থেকে প্রেমেন্দ্র মিত্র আমার পড়া হয়ে গিয়েছে। বিমল করের গল্প, তাঁর শব্দচয়ন, তাঁর বাক্যনির্মাণ, তাঁর গল্পের থিম আমাকে অবশ করত। বাইরের পৃথিবীর ঘনঘটা নয়, আমি ঝরনার তলায় নুড়িদের নড়ে যাওয়ার আওয়াজ যেন শুনতে পেতাম।
মাত্র ষোলো বছর বয়সে ‘আত্মজা’ পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। কিন্তু আমার বড় মেয়ের যখন পনেরো বছর বয়স, তখন এক রাতে আবার ‘আত্মজা’ পড়ে চমকে উঠেছিলাম। এ তো আমারও গল্প হতে পারত। মানুষের মনের গভীরে চাপা থাকা বোধগুলোকে বিমল কর কী দক্ষতায় কাগজে তুলে আনতেন! আমি এবং আমার মতো অনেকেই ওঁর ছাত্র হয়ে গেলাম। কিন্তু আমরা কেউ বিমল করের ঘরানার লেখা রপ্ত করিনি। বা করা সম্ভব হয়নি। শুধু শীর্ষেন্দুদার সেই সময়কার লেখাগুলোতে এই ঘরানা স্পষ্ট।
এই খুঁতখুঁতে মানুষটি গাড়ি চালিয়েছেন এক সময়। ওঁর ড্রাইভিং গুরু ছিলেন বাদল বসু, যিনি আনন্দ পাবলিশার্সের দায়িত্বে ছিলেন। সেই ফিয়াট গাড়িতে বিমল করের পাশে বসে মনে হত পথ শেষ হচ্ছে না। রাস্তা ফাঁকা হলেও থার্ড গিয়ারের ওপরে গাড়ি চালাতেন না তিনি। আর প্রায়ই বিবেকানন্দ রোডে গিয়ে বাদলদাকে ডেকে গাড়ির নানা সমস্যা জানাতেন। বাদলদা হেসে বলতেন, ‘আপনাকে গাড়ি চালাতে হবে না, আমি ড্রাইভার দিচ্ছি’। বিমল কর হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন।
বইমেলায় একা যেতেন না। রাস্তা একা পার হতেন না। সঙ্গী লাগত। আমি অনেক বার বইমেলায় তাঁর সঙ্গী হয়েছি। নাক থেকে রুমাল নামাতেন না। দেখতাম, তাঁর বই শংকর বা আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মতো হু হু করে বিক্রি হচ্ছে না। কিন্তু তাঁর নিজস্ব পাঠক আছে। মনে আছে, তাঁর প্রথম গল্প ছবি হয়েছিল বহু আগে। ছবিটির নাম ‘হ্রদ’।
তার পর ‘পিয়ারিলাল বার্জ’। কিন্তু বিমল করকে সাধারণ পাঠক-দর্শক গ্রহণ করল ‘বালিকা বধূ’ থেকে। খুব চটি উপন্যাস, বিক্রি হল খুব। তার পর ‘যদুবংশ’। সিনেমার সাফল্য কোনও কোনও লেখকের সামগ্রিক বই বিক্রি বাড়ালেও বিমল করের ক্ষেত্রে তা হয়নি। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘পূর্ণ-অপূূর্ণ’ আম-পাঠক কতটা গ্রহণ করেছিলেন? ‘অসময়’-য়ের জন্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার ঘোষণার কথা শুনে বললেন, ‘দূর, দিল্লিতে যাব না।’
আমরা অনেক বোঝালাম। কলকাতা ছেড়ে প্রবাসে যেতে তাঁর তীব্র আপত্তি। শেষে আমি আর কল্যাণ চক্রবর্তী সঙ্গী হলে তিনি যেন তেতো গিললেন। সে বার দিল্লিতে গিয়ে পুরস্কার নেওয়া পর্যন্ত বিমল করকে সামলাতে হয়েছিল আমাদের। কিন্তু বৃন্দাবনে বেড়াতে গিয়ে বাঙালি বিধবাদের দুর্দশা দেখে তিনি অদ্ভুত বদলে গেলেন। সব জড়তা ঝেড়ে ফেলে সেই দুঃখী মহিলাদের সঙ্গে কথা বলে গেলেন একান্তে।
ফেরার পথে এক তামিল বয়স্ক মানুষ অল্পবয়সি মেয়ের সঙ্গে অতি ঘনিষ্ঠ হয়েছেন দেখে আমরা প্রতিবাদ করে জানলাম ওরা মামা-ভাগ্নি। বিয়ে করতে কলকাতায় যাচ্ছেন। বিমল কর হেসে বলেছিলেন, “কেন অন্যের ব্যাপারে নাক গলাস!”
ছেলেবেলাটা বিহারে কেটেছিল। কলকাতায় এসে প্রায় শামুকের মতো জীবন কাটিয়েছেন। সমরেশ বসুর মতো নানান স্তরের জীবন দেখার অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না। সেই ছেলেবেলার দেখা জগৎ বারংবার ঘুরেফিরে আসত তাঁর লেখায়।
যুদ্ধের পরের কলকাতা নিয়ে অনবদ্য উপন্যাস লিখেছিলেন তরুণ বয়সে, যার অনেকটাই তিনি শুনেছিলেন। কিন্তু অসাধারণ কল্পনাশক্তি থাকায় গল্প তৈরি করতে অসুবিধে হত না। বিমল করের গল্প মস্তিষ্ক মারফত হৃদয়ে প্রবেশ করে। একটু কি কনজারভেটিভ ছিলেন? আমার চেয়ে সিনিয়র এক লেখক দীর্ঘকাল ‘দেশ’-য়ে গল্প লিখতেন। গল্প সম্পাদক বিমল কর তাঁর একটা গল্প ফিরিয়ে দিয়ে খুব ভর্ৎসনা করলেন। কারণ লেখক কাকিমার সঙ্গে ভাসুর পুত্রের শারীরিক প্রেমের কথা লিখেছেন। লেখক খুব বিব্রত হয়ে আমাকে বললেন, “কী করি বল তো? গল্পটা আমার স্ত্রী এন্ট্রি করে ফেলেছে খাতায়। ছাপা না হলে টাকা পাব না।” আমি অবাক। এ রকম হয়!
দু’দিন বাদে লেখক নতুন গল্প জমা দিলেন বিমল করের কাছে। গল্পটা পড়তে পড়তে বিমল কর ঠোঁট কামড়ালেন। তার পর ছিঁড়ে বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিলেন। বললেন, “অদ্ভুত ব্যাপার। কাকিমার বদলে বৌদি বানিয়ে একই গল্প এনেছ। কাকিমাকে নায়ক যা বলেছে, তাই বৌদিকেও বলছে? চমৎকার।”
দেহপট সনে নট সকলই হারায় কথাটি লেখকদের সম্পর্কে ক্রমশ প্রযোজ্য হতে চলেছে। তারাশংকর থেকে বিভূতিভূষণ মৃত্যুর পরেও দীর্ঘকাল বেঁচেছিলেন। এখনও গ্রন্থাবলিতে রয়ে গিয়েছেন। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তো এখনও দুর্দান্ত ভাবে জীবিত। কিন্তু সমরেশ বসুর বই কি বইমেলায় আগের মতোই বিক্রি হয়? বিমল করের যে নিজস্ব পাঠক ছিল, যাঁরা ওঁর রচনায় আত্মার আরাম অনুভব করতেন, তাঁদের অধিকাংশই আর নেই। মৃত্যুর দশ বছর পূর্তিতে এসে মনে পড়ে চল্লিশ বছরের সান্নিধ্যে অন্তত আশি বার ওঁর মুখে শুনেছি, ‘বুঝলি, আমার মনে হয় ক্যান্সার বা টিবি হয়েছে।’ এটা ওঁর বাতিক ছিল। উনি জানতেন না। তামাম বাংলা সাহিত্য এখন ওই রোগে ভুগছে। নইলে লাইব্রেরির তাকে এত ধুলো জমছে কেন?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.