মনোরঞ্জন...
যে জীবন ফড়িংয়ের
“উত্তমদা প্রথম দিনই তুই বলে আপন করে নিলেন। বললেন, অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে মাঝে মাঝে হাতে তালি দিবি, ছোটদের মতো। বোবাদের একটা শিশুসুলভ সরলতা থাকে, জানিস তো। পাশ থেকে মানিকদা গম্ভীর গলায় বললেন, ঠিকই বলেছে উত্তম।”
সত্যান্বেষী ব্যোমকেশের ভূমিকায় উত্তমকুমার। চাকর পানুর ভূমিকায় চিন্ময় রায়। সিনেমা আর নাটকের হাজারো স্মৃতি নিয়ে এখন আত্মজীবনী লিখছেন চিন্ময়, ওরফে ফড়িং।
এবং, শুরুটা হতে চলেছে ফড়িং দিয়েই।
কীসের শুরু? বাংলার কমেডিয়ানের পুরোদস্তুর আত্মজীবনীর। বাংলার কিংবদন্তি সব কমেডিয়ান নবদ্বীপচন্দ্র হালদার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি ঘোষ কিংবা অনুপকুমার আত্মজীবনী লেখেননি এঁদের কেউই।
সেই ঘটনাটা ঘটাতে চলেছেন চিন্ময় রায়। চুপিচুপি আত্মজীবনী লিখে পরম বিনয়ের সঙ্গে তার নাম দিয়েছেন ‘যে জীবন ফড়িংয়ের’ (সপ্তর্ষি প্রকাশন)।
ছাপার আগেই পুরো পড়ে নেওয়া গেল এক্সক্লুসিভ আত্মজীবনীটা। পড়তে পড়তে অবাকই হতে হল এই কিনা ‘ফড়িংয়ের’ জীবন!
আপাত পরিচয়টা পরদার হলেও, শুরুটা কিন্তু তাঁর মঞ্চে। রীতিমতো গ্রুপ থিয়েটার থেকে বেড়ে ওঠা অভিনেতা। ‘নান্দীকার’য়ের প্রথম ভাঙনের সাক্ষী তিনি।
আত্মজীবনীতে লিখছেন, “আমার জীবনের একটা টার্নিং পয়েন্ট। এখন বুঝি সেটা বড় ভুল ছিল। আমরা ন’জন একদিনের একটা মিটিং ডেকে ‘নান্দীকার’ ছাড়লাম। অনেকগুলো কারণ আস্তে আস্তে আমাদের মধ্যে ফাটল আনছিল।”
কী সেই কারণ? চিন্ময় জানিয়েছেন, মায়া ঘোষের সঙ্গে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলাদা রিহার্সাল, ওঁর একনায়কতন্ত্র এ সব মিলিয়ে তাঁদের তখন ‘রক্ত গরম’। ফলে দল ছাড়েন তাঁরা।
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
“কারণ দেখালাম অজিতেশদার সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক পার্থক্য। নাহ্! অনবদ্য সংলাপস্রষ্টা অজিতেশদা সেদিন কোনও কথা বলেননি। শুধু নীরবে বিদায় দিলেন। নান্দীকারে প্রথম ভাঙন। আমরা ১৯ জন অর্থাৎ বিভাস চক্রবর্তী, অশোক মুখোপাধ্যায়, অজয় গাঙ্গুলি, আমি আর বাকিরা মিলে গড়ে তুললাম থিয়েটার ওয়ার্কশপ।”
পরে কিন্তু অনুতাপ হয়েছে। চিন্ময় লিখেছেন কী ভাবে সব সময় পুরনো দল আর অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘মিস’ করতেন। “মনে হত, নাহ্! এ ভাবে দলটা ছাড়া একদম ঠিক হয়নি। কারণ ব্যক্তিগত ঝামেলা ইগো, এই সব গণ্ডি ভেঙে যদি দলটার কথা ভেবে অজিতেশদার পাশে থাকতাম, তা হলে ‘নান্দীকার’ আজ ভারতের শ্রেষ্ঠ দল হত।”
প্রথম ছবি। ‘গল্প হলেও সত্যি’। আত্মজীবনীতে লিখেছেন তাঁর গল্পও, “রুপোলি পরদা, স্বপ্নের জগৎ, ম্যাট্রিকে থার্ড ডিভিশনে পাশ করা সেই আমি কখনও ভাবিনি যে সিনেমায় কাজ করব। হাজারো লোক আমায় দেখবে, ছুঁতে চাইবে। সেই বাপে খেদানো-মায়ে তাড়ানো আমিই নাকি গেলাম সিনেমায় কাজ করতে। বাংলা চলচ্চিত্রে আমায় হাত ধরে এনেছিলেন তপনদা। তপন সিংহ।”
অভিনয় আর শু্যটিংয়ের মজার অনেক গল্পও ছড়িয়ে আছে ফড়িংয়ের ঝুলিতে। বৈজয়ন্তীমালাকে নিয়ে গল্পটি যেমন। তিনি লিখছেন, “হাটে বাজারে। বড় চরিত্র। কিন্তু সেখানেও হাফপ্যান্ট পরা হাসপাতালের বেয়ারা।...আমার জন্য একটা গান ছিল।...আগে আগে ননদি চলে পিছে ননদৈয়া...গানের সঙ্গে বৈজয়ন্তীমালার নাচের রিহার্সালও শুরু হল। ওহ্ কী আসাধারণ ফুটস্টেপিং। আমি হাঁ করে তাকিয়ে দেখতাম।”
রিহার্সালে বৈজয়ন্তীমালা নাকি একদিন বলেছিলেন, “হরবখত কেয়া দেখতে হো তুম?” চিন্ময়ের উত্তর ছিল, “আপনার নাচ। যে নাচে সঙ্গম-এ রাজ কপূরকে হারিয়েছিলেন।” এর পরেও সেই ‘হাঁ করা ভাবটা’ যায় না। তাই দেখে বৈজয়ন্তী বলেন, “আমার মনে হচ্ছে, তুমি আরও কিছু বলবে।” চিন্ময় লিখছেন, “আমি আমতা আমতা করে বলে ফেলি, আপনার কোমরটা একটু টাচ করব? আপনাকে দেখলে মনে হয় অজন্তার মূর্তিগুলো প্রাণ পেয়েছে। হা হা করে হেসে বললেন, তোমাকে টাচ করতে হবে না, আমিই টাচ করিয়ে দেব।”
দৃশ্য গ্রহণের দিন। বৈজয়ন্তীমালা নাচতে লাগলেন। সঙ্গে চিন্ময়ের গলায় সেই গান। হঠাৎ ‘মেরি পিছে সাঁইয়া’য় এসে বৈজয়ন্তী চিন্ময়ের কোমরে বিশাল এক ধাক্কা মারলেন তাঁর কোমর দিয়ে। আবার নাচতে লাগলেন। “আমি হাঁ, কী সাংঘাতিক ব্যালান্স।...এর পরে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালেই লোকে জিগ্যেস করত, কী হল? আমি বলতাম, বৈজয়ন্তীমালা কোমরে ধাক্কা দিয়েছেন। সেই স্মৃতিটাকে ধরে রাখছি।” লিখেছেন চিন্ময়।
স্মৃতি শুধু এমন মজার নয়। বেদনারও। থাকছে বিতর্কের সম্ভাবনা। কোনও রাখঢাক না রেখে পরিষ্কার জবাব দিয়েছেন তাঁকে ঘিরে অনেক বেসামাল সওয়ালেরও।
এক সময় সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে চিন্ময় রায়ের সম্পর্ক নিয়ে অনেক কানাঘুষো উঠত সিনেমা পাড়ায়। তিনি খোলামেলা সেই প্রসঙ্গেও।
লিখেছেন, “আমার হাত ধরেই ওর এ জগতে আসা। স্বামীভাগ্য বড় খারাপ ছিল ওর। মারধর, অপমান লাঞ্ছনা ছাড়া স্বামীর থেকে আর কিছু পায়নি মেয়েটি।... আমিই ওকে দীনেন গুপ্ত আর তপনদার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।”
এর পর দীনেন গুপ্তর সঙ্গে সুমিত্রার সম্পর্ক ঘিরেও মুখ খুলেছেন তিনি। লিখেছেন, “প্রায় সব ছবিতে সুমিত্রা পর পর হিরোইন হয়েছে। ...দীনেনদা সুমিত্রাকে ব্যবহার করতেন লালসা মেটাতে এমন অনেক গল্প চালু ছিল মিডিয়ায় যাই হোক সে তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে আমায় ঘিরে গুঞ্জন বাড়তেই থাকল।”
আর জুঁইদেবী? না, তাঁর সম্পর্কে বড় রক্ষণশীল ফড়িং। আত্মজীবনীতে শুধু লিখেছেন, “বালিকা বধূ ছবিতে প্রথম দেখেছিলাম জুঁইকে। ননীগোপালের বিয়ে ছবিতে কাজ করার সময় প্রেম নিবেদন করি। আমার মতো চেহারার এক মানুষকে কাছে টেনে নিয়েছিল। আমরা বিয়ে করলাম। সব কেমন হারিয়ে গেল সুখে চলতে চলতে। পাঠকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, এর বেশি আর বলতে পারব না। জুঁই চলে যাওয়ার পর যে অবসাদ আমায় ঘিরে রেখেছে তা থেকে আমি বেরোতে চাই।”
এইটুকু? আত্মজীবনীতে আর একটু খুলবেন না নিজেকে? “না। বড় কষ্ট পাই।” সংক্ষিপ্ত উত্তর চিন্ময়ের।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.