|
|
|
|
|
|
 |
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
মিথ ভেঙে বহু জনতার মাঝে অপূর্ব একা |
আশিস পাঠক |
মহানায়ক: আ জার্নি থ্রু লেন্স, পাহাড়ী রায়চৌধুরী। সপ্তর্ষি, ৫৯৫.০০
মহানায়ক রিভিজিটেড, স্বপন মল্লিক। ট্রাঙ্কুবার, ২৯৫.০০
উত্তমকুমার অ্যান্ড সুচিত্রা সেন: বেঙ্গলি সিনেমাজ ফার্স্ট কাপল, মৈত্রেয়ী বি চৌধুরী।
ওম বুকস ইন্টারন্যাশনাল, ২৯৫.০০ |
আটচল্লিশটা ছবি। তার আটচল্লিশটা ক্যাপশন। কিন্তু সে তো শুধু স্থান আর কালের তথ্যমাত্র। সাদা-কালোর আলো-আঁধারে তথ্য ছাপিয়ে যে মানুষটি আজও ঘটমান বর্তমান হয়ে থাকেন পাহাড়ী রায়চৌধুরীর তোলা ছবির অ্যালবামটিতে, তাঁর একটাই ক্যাপশন, একা, নিঃসঙ্গ।
‘মানুষটি’ই বলব। কারণ এই বইয়েই প্রথম সংকলিত এত দিন না-দেখা ছবিগুলির (সঙ্গে তারই একটি) ছিটেফোঁটা দু’একটি ছাড়া সবই পর্দার বাইরের উত্তমকুমারের। ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে, কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত ওরফে ফাটাকেষ্টর কালীপুজোয়, ‘বনপলাশীর পদাবলী’র শ্যুটিং স্পটে কিংবা টলি ক্লাবে সেই উত্তমকুমার ভক্ত এবং বন্ধু-পরিবৃত। কিন্তু ক্যামেরা ধরেছে তাঁকে, বেশির ভাগই ক্লোজ-আপে। আরও বেশি করে ধরতে চেয়েছে ‘মহানায়ক’-এর চোখের ভাষা। পাহাড়ীর নাতিদীর্ঘ লেন্স-যাত্রাটির পাতা উল্টে গেলে সেই ভাষা পড়তে পারা যায়। নায়ক যেন ক্লান্ত তখন, যেন বলতে চাইছেন, বন্দরের কাল হল শেষ...।
ছবিগুলির সময় ১৯৬৮-’৭৮। ’৮০তে মারা যাবেন তিনি। পঞ্জি বলছে, জীবনের এই শেষ দশকটায় তাঁর উল্লেখযোগ্য ছবির সংখ্যা দশের বেশি নয়। বলিউডে চূড়ান্ত ব্যর্থতাও এই সময়েই। ও দিকে, বাংলায় তখন সত্তরের দশক। মধ্যবিত্ত তরুণের প্রেম আর স্বপ্নের রোমান্সে ঘনিয়ে উঠেছে কালবেলা। অভিনয়ের ধারাতেও চোরা বদল ঘটে যাচ্ছে। ‘মহানায়ক’ কি বুঝেছিলেন সেটা? এ বইয়ের ছবিগুলো বলবে, বুঝেছিলেন। জুটি-স্নিগ্ধ সেই চিরপরিচিত হাসিটি এখানে প্রায় কোনও ছবিতেই নেই, বরং সুপারহিট নায়কত্ব থেকে বেরিয়ে এক পরিণত অভিনেতা-ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠছে যেন। চলচ্চিত্রপঞ্জিও কথাটাকে সমর্থন করবে। এই তো সেই দশক যখন উত্তমকুমার আর টিপিক্যাল রোম্যান্টিক নায়ক নন। অনেক বেশি করে অভিনয় করছেন ‘নিশিপদ্ম’, ‘এখানে পিঞ্জর’, ‘জীবন জিজ্ঞাসা’, ‘বিকেলে ভোরের ফুল’, ‘অগ্নীশ্বর’, ‘বাঘবন্দি খেলা’ এমনকী ‘যদুবংশ’-র মতো ছবিতে। কিন্তু উত্তমকুমারের এই সময়টাকে বুঝতেই পারেননি বইটির প্রকাশন-সম্পাদক সুমিতা সামন্ত। হয়তো সে কারণেই ছবিগুলির সঙ্গে ছেপেছেন ‘বিপাশা’, ‘শিল্পী’, ‘চাওয়াপাওয়া’, ‘সপ্তপদী’ এমনকী ‘অগ্নিপরীক্ষা’-রও বুকলেট-লবিকার্ড! |

|
উত্তমকুমারের সেই সময়, অর্থাৎ উত্তম-সুচিত্রা জুটি যখন হল-কাঁপানো সুপারহিট তখন কোন রসায়নে বাংলা সিনেমার এই প্রথম সার্থক জুটি আজও অদ্বিতীয় রয়ে গেল সেটা বিচার করে দেখতে চেয়েছেন মৈত্রেয়ী বি চৌধুরী। তাঁর বইয়ের ন’টি অধ্যায়ে নানা দিক থেকে সেই জুটিকে দেখার চেষ্টা। স্বর্ণযুগ, রুপোলি রোমান্স-জাতীয় ফিল্ম-ম্যাগাজিনের গোলা ধারণায় আচ্ছন্ন থাকেননি মৈত্রেয়ী। সমকালীন বাংলা সিনেমা, বলিউডের প্রেক্ষিতেও বুঝে নিতে চেয়েছেন, কী করে ওই জুটি আজও বাঙালির মনের অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়ে গিয়েছে। তিনি লক্ষ করেছেন, তথাকথিত ‘প্যারালাল সিনেমা’-র বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার সময়টাই উত্তমকুমারেরও প্রতিষ্ঠার সময় এবং উত্তম-সুচিত্রা জুটিও তখনই ‘আইকনিক’ হয়ে উঠেছিল। ‘বসু পরিবার’ ১৯৫২-র ছবি, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ১৯৫৩-র, ঋত্বিককুমার ঘটকের ‘নাগরিক’ ১৯৫২-য় শেষ হল, ১৯৫৫-য় মুক্তি পেল সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’। আর একটু এগোলে মৈত্রেয়ী দেখতে পেতেন, ১৯৫৯-এ ‘অপুর সংসার’ মুক্তি পেয়েছিল। বাংলা সিনেমার নায়কের অভিনয়ে তৈরি হচ্ছিল অন্য একটা ধারা। কিন্তু আরও অন্তত দেড় দশক চলেছিল ‘মহানায়ক’-এর দাপট। পপুলার সিনেমা আর প্যারালাল সিনেমা কী করে পাশাপাশি নিজের নিজের মতো করে চলেছিল সেটা গভীরে গিয়ে দেখেছেন মৈত্রেয়ী। কিন্তু ‘স্টার’ আর ‘অভিনেতা’ হওয়ার মধ্যে যে সূক্ষ্ম পার্থক্যটি বুনে দেওয়ার চেষ্টা হয় চিত্রসমালোচকদের একটা মহলে, সে দিক থেকে উত্তম-সুচিত্রার অভিনয়ের বিচার করেননি তিনি। করলে, বইটি আরও সম্পূর্ণ হত।
দুটি কাছাকাছি বিষয়ের ছবির সূত্র ধরে একটি গভীর ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছেন স্বপন মল্লিক। তাঁর বিশ্লেষণী উত্তম-জীবনীর ষষ্ঠ অধ্যায়টির নাম ‘কন্টেম্পোরারিজ, নট রাইভ্যালস’। এখানে বসন্ত চৌধুরী ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে উত্তমকুমারের পাশে রেখে দেখেছেন তিনি। তুলনা করেছেন তপন সিংহের ‘জতুগৃহ’ আর অজয় করের ‘সাত পাকে বাঁধা’-র। মরে যাওয়া প্রেমের মজে যাওয়া দাম্পত্য দুটি ছবিরই কেন্দ্রে। স্বপনের মতে, সাধারণ ভাবে কোনও পরিচালক পছন্দ করতেন নায়কছাপবিহীন কোনও অভিনেতাকে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অনিল চট্টোপাধ্যায়ের মতো। ‘বাট দ্য ডিরেক্টর সেটলড ফর উত্তম, অল দ্য সেম, উইথ পজিটিভ রেজাল্টস। ইট কনফার্মড দ্যাট দি ইম্প্রেশন ইন ইন্টেলেকচুয়াল সার্কলস, দ্যাট উত্তম ওয়াজনট ফিট ফর থিঙ্কিং পার্টস, ওয়াজ লার্জলি আ মিথ।’
পাহাড়ীর অ্যালবামে উত্তমকুমারের একটি ছবির সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে ইংরেজি অনুবাদে। সৌমিত্র লিখেছেন, ‘উত্তমদা ওয়জ অলওয়েজ ইন আ ডিলেমা— হোয়েদার টু বি আ স্টার অর অ্যান অ্যাক্টর।’ ওই বিভাজনটাও কি সমালোচনার একটা মিথ নয়? ছকে বাঁধা তকমার বাইরে নতুন প্রজন্মের চোখে বহু জনতার মাঝে ওই অপূর্ব একা-কে নতুন করে দেখার সম্ভাবনা জাগাল বই তিনটি, আপাতত এটুকুই আশা। |
|
|
 |
|
|