পুস্তক পরিচয় ১...
পঞ্চাশের মন্বন্তর নতুন করে ভাবায়
ক্ষুধার্ত বাংলা/রাষ্ট্র ও বেনিয়াতন্ত্রের গণহত্যার দলিল, সম্পাদনা: মধুময় পাল। দীপ প্রকাশন, ৪০০.০০
যেন চলমান দুর্ভিক্ষ! খবরটা প্রকাশিত হয়েছিল ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য়, ২০১২-র ১১ অগস্ট। কটক থেকে সংবাদ সংস্থার পাঠানো সে খবরে বলা হয়েছিল, ‘নদীতীরে পড়ে আছে পোকা-ধরা, ধুলোভর্তি পরিত্যক্ত চালের বস্তা। আর তাই নিতে ভিড় করেছেন শ’য়ে শ’য়ে ক্ষুধার্ত মানুষ। তবে সে চালের গুণগত মান এতটাই খারাপ যে মানুষ তো দূরের কথা পশুখাদ্যের জন্যও তা অনুপযুক্ত।... ২০১১-র ডিসেম্বরে কালাহান্ডির কেসিঙ্গা থেকে প্রায় ছ’শো কুইন্টল চাল আসে জগৎপুরে। কিন্তু পরে খাদ্য নিগমের (এফসিআই) বিশেষজ্ঞ দল গুণগত মান পরীক্ষা করে জানান, মানুষের খাওয়ার উপযুক্ত নয় ওই চাল। ২০১০-র এপ্রিলে ওই ছ’শো কুইন্টল চালকে ছাড়পত্র দিয়েছিল এফসিআই। সেইমতো রেলের ওয়াগনও ভাড়া করা হয়। কিন্তু সেই চাল কটকে এসে পৌঁছয় ২০ মাস পর।...সেই পরিত্যক্ত চালই নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন জগৎপুরের গরিব মানুষেরা।’
আবার ২০১২-র ৯ নভেম্বর এই পত্রিকাই জানাচ্ছে, জলপাইগুড়ির বীরপাড়ার বন্ধ ঢেকলাপাড়া চা-বাগানের ১৫ জন শ্রমিক ‘মরতে চেয়ে’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লিখেছেন। ওই চা-বাগান দশ বছরের বেশি বন্ধ। দেড় মাসে অনাহারে মারা গিয়েছেন ১৫ জন। তাই ‘ইচ্ছামৃত্যু’ চেয়ে বাঁচতে চান ওই ১৫ জন!
দু’টি সংবাদেরই উল্লেখ রয়েছে মধুময় পাল সম্পাদিত ক্ষুধার্ত বাংলা নামে ৪৬৮ পাতার গ্রন্থটিতে। এই সংকলন গ্রন্থের বিষয়: পঞ্চাশের মন্বন্তর। অথচ আধুনিক ভারতবর্ষে, যেখানে সম্প্রতি খাদ্য নিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স পাশ হয়ে গিয়েছে, সেই ভারতবর্ষেও কী ভয়ঙ্কর ভাবে প্রাসঙ্গিক সেই পঞ্চাশের মন্বন্তরের আতঙ্ক। ১৯৪২-’৪৩ সালের সে দুর্ভিক্ষে মৃত্যু হয়েছিল তিরিশ লক্ষেরও বেশি মানুষের, অন্তত সমর্থিত ও অসমর্থিত নানা সূত্র এবং হিসেব সেই সংখ্যার প্রতিই ইঙ্গিত করে। সেই মন্বন্তর তর্জনী তুলে দেখায়, এখনও কোথায়, কী ভাবে যেন মিল হয়ে যায় জগৎপুর ও জলপাইগুড়ির বন্ধ চা বাগানের!
অথচ, পঞ্চাশের ওই মন্বন্তরে যাঁরা মারা গেলেন, যাঁরা না মরে কোনও রকমে বাঁচলেন, তাঁরা কি আদৌ চালের অভাবের শিকার ছিলেন? না কি সেই চাল তাঁদের ভাঁড়ারে ঢোকেনি ক্রয়ক্ষমতার অভাবে? অমর্ত্য সেন যে অবস্থাকে বলেছেন, ‘ক্যাপাবিলিটি ডিপ্রাইভেশন’?
১৯৪৩-এর সেই মৃত্যুমিছিলের বেশ কিছু ছবি আমরা দেখতে পাই সে সময়ের সংবাদপত্রের পাতায়। মৃত শিশু কোলে মা, কালীঘাট মন্দিরের কাছে গাছে ঝুলছে মৃতদেহ। মহানগরীর রাজপথ ও গলিপথে পড়ে থাকা মৃতদেহ ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে চলছে নাগরিক জীবন। অসংখ্য মানুষের হাহাকার: ‘ফ্যান দাও মা...ফ্যান দাও।’ আরও একটি ছবি সে সময় প্রকাশিত হয়েছিল: লরি থেকে গুড় পড়েছে রাস্তায় আর সে গুড় তুলে চেটেপুটে খাচ্ছে শিশুর দল। শুধু কি ক্যামেরার লেন্সই সে সব ছবি এঁকেছে সে দিন? চিত্তপ্রসাদ, জয়নুল আবেদিন, অতুল বসু, সোমনাথ হোর, দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের তুলির কথা মনে করুন।
পঞ্চাশের সেই ভয়াবহ মন্বন্তর নিয়ে গবেষণা ও চর্চা আজও শেষ হয়নি। সত্তর বছর আগের সেই বিনাশ-কালের ভয়াবহ স্মৃতিতে আজ হয়তো বা উদাসীনতার ধুলো পড়েছে। কিন্তু সেই ধুলো ঝেড়ে মধুময় পাল যে অমূল্য সম্পদ সামনে এনেছেন তা সবিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। লেখক-সূচি থেকেই এই সংকলন গ্রন্থ এই বিষয়ের আরও পাঁচটি গ্রন্থের থেকে আলাদা হয়ে যায়। দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা বললেই যাঁর নাম প্রথমে মনে আসে, সেই চিত্তপ্রসাদের মেদিনীপুর সফরের একটি অসামান্য বর্ণনা এখানে রয়েছে। ঝড়ে বিধ্বস্ত মেদিনীপুরে তাঁরা সফর করেন ’৪৩-এর নভেম্বর। চতুর্দিকে ধ্বংসের মধ্যে একফালি সবুজ ধানখেত থেকে চিত্তপ্রসাদেরা উদ্ধার করেন বছর ছ’য়েকের এক শিশুকে— চিত্তপ্রসাদের ভাষায়: হাড়ের তৈরি কালো পুতুল!

লঙ্গরখানা। ক্ষুধার্ত বাংলা থেকে।
লেখকসূচিতে চিত্তপ্রসাদ ছাড়াও পি সি জোশী, ভবানী সেন, গোপাল হালদার, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সোমনাথ হোর, অশোক মিত্র (আইসিএস), হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, আনিসুজ্জামান, সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত, হাওয়ার্ড ফাস্ট-এর সঙ্গে আছেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ আজিজুল হক, পুলক চন্দ, সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। বেশ কয়েকটি লেখা এখানে পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। তাঁর লেখায় সন্দীপ উল্লেখ করেছেন ব্রিটেনের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের একটি উক্তি। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে যখন ভারতে দ্রুত চাল পাঠানোর আর্জি জানানো হচ্ছে, সে সময়ে চার্চিলের মনে হয়েছিল, খাদ্যাভাবের একটা বড় কারণ: ভারতের জনসংখ্যা। ‘ওরা খরগোশের মতো বাচ্চা দেয়।’ চরম খাদ্যসঙ্কটের আরও একটি কারণ দেখিয়েছিলেন চার্চিল। এত বড় একটা যুদ্ধ চলছে, অনেক দেশেই খাদ্যাভাব রয়েছে, ভারতের মানুষকে তো ভুগতে হবেই। মধুশ্রী মুখোপাধ্যায়ের ‘চার্চিলস সিক্রেট ওয়র’-এর আলোচনা করতে গিয়ে ওই দুর্ভিক্ষের কারণ চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন সন্দীপ।
ক্ষুধার্ত বাংলা-য় পঞ্চাশের মন্বন্তর নিয়ে গোপাল হালদারের একটি সাক্ষাৎকার রয়েছে, যেটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘সংস্কৃতি ও সমাজ’ পত্রিকায়। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন মৈত্রেয় ঘটক। সেখানে গোপাল হালদার বলছেন, ‘আনন্দমঠে যে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ছবি এঁকেছেন বঙ্কিমচন্দ্র তা সমস্ত ছিয়াত্তরের মন্বন্তর সম্পর্কে অন্যান্য লেখা থেকেও অনেক বেশি সত্য। কিন্তু তেমন একটা কিছু লিখে রেখে যেতে পারব এমন সাধ্য আমার নেই। কিন্তু মডেল আকারে যদি আমি এই সময়টা ও ঘটনাকে উত্থাপন করে যাই তা হলে, পরবর্তীকালে যদি কোনও বঙ্কিমচন্দ্র দেশে জন্মগ্রহণ করেন, তিনি তা অবলম্বন করে, সেই তথ্য সংগ্রহ করে হয় তো কোনও নতুন আনন্দমঠ লিখতে পারবেন...। এই ধারণা থেকেই আমি নভেলের দিকে আকৃষ্ট হই।’
বৌধায়ন চট্টোপাধ্যায়ের একটি মূল্যবান প্রবন্ধ এখানে সঙ্কলিত। পঞ্চাশের মন্বন্তরের কার্যকারণ সন্ধানে তাঁর কলম পরিক্রমা করেছে অর্থনীতির আঙিনায়। বিভিন্ন সারণির মাধ্যমে এ দেশে দুর্ভিক্ষ ও মন্দার কারণ খুঁজেছেন লেখক।
বস্তুত, পঞ্চাশের মন্বন্তরের উপর নানা দিক থেকে আলো ফেলা, তাকে বিশ্লেষণ করে তৎকালীন ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বুঝতে চাওয়ার বিশেষ প্রয়াস এই গ্রন্থে রয়েছে। এই গ্রন্থের উজ্জ্বল সংযোজন, সে সময়কার বহু ছবি। দ্য স্টেটসম্যান, আনন্দবাজার পত্রিকা-সহ বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া সেই হনন-কালের যে সব সাদা-কালো ছবি এবং চিত্তপ্রসাদের আঁকা যে সব ছবি এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তা দেখে এই একবিংশ শতাব্দীতে বসেও শিউরে উঠতে হয়! ১৯৪৩-এর এই অগস্টের মৃত্যুমিছিলের ছবি আরও বহু লক্ষ শব্দের প্রয়োজন মিটিয়ে দেয়।
খাদ্য সুরক্ষা নিয়ে দেশজোড়া আলোচনার এই কালে সে-কালের ‘ক্ষুধার্ত বাংলা’ চিন্তার নতুন খোরাক জোগালো!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.