বেঙ্গালুরু থেকে মুম্বই পৌঁছেই আইবিএল ফাইনালের প্রিভিউ লিখতে বসে যেতে হল। কারণ, একটু পরেই দেশের ব্যাডমিন্টন ইতিহাসের প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের অফিশিয়াল ডিনারে যাওয়ার ব্যাপারস্যাপার আছে। ওখানে নিশ্চয়ই শনিবারের টাইয়ের মহাম্যাচের দুই কুশীলবের সঙ্গে দেখা হবে। হ্যাঁ, সাইনা আর সিন্ধুর কথাই বলছি।
মানছি, এটা একটা টিমগেম। একটা ম্যাচের ওপর চ্যাম্পিয়নশিপ নির্ভর করছে না। কিন্তু সেই স্বাধীনতা দিবস থেকে তিন সপ্তাহ ধরে আইবিএলের ইউএসপি তো একটাই সাইনা বনাম সিন্ধু। ১৫ অগস্ট দিল্লির সিরি ফোর্টে যে লড়াই শুরু হয়েছিল, মাসের শেষ দিন মুম্বইয়ের ন্যাশনাল স্পোর্টস ক্লাব অফ ইন্ডিয়ার কোর্টে ফাইনালেও সেটাই ‘দ্য ম্যাচ’। ব্যাডমিন্টন মহল থেকে শুরু করে মিডিয়া সর্বত্র তাকালে মনে হচ্ছে, হাবভাবটা যেন চুলোয় যাক হায়দরাবাদ হটশটস না আওয়াধি ওয়ারিয়র্স কোন দল চ্যাম্পিয়ন হবে বা ফাইনালের অন্য চারটে ম্যাচে কে বা কারা জিতবে, সে সব নিয়ে চিন্তাটিন্তা। আসল হচ্ছে, ফাইনালের দ্বিতীয় ম্যাচটা সাইনা বনাম সিন্ধু। ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের মহারানি বনাম রাজকন্যা। আসল সাইনা বনাম নতুন সাইনা।
ভাবুন, এ রকম মারাত্মক হাইপ যে ম্যাচ ঘিরে, সেটা যারা খেলবে তাদের মানসিক অবস্থাটা! নিজে একজন ব্যাডমিন্টন অলিম্পিয়ান হিসেবে আমি সাইনা-সিন্ধু দু’জনকেই দেখা হলে বলব, যতটা পারো খোলা মনে খেলো। চাপ না নিয়ে ম্যাচটাকে বরং উপভোগ করো। |
তা ছাড়া, আমার মতে সিন্ধুর ওপর দেশজোড়া ব্যাডমিন্টনপ্রেমীদের যতই বিরাট প্রত্যাশা থাক, মেয়েটার ফাইনালে মহাপ্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে নামা উচিত এটাই ভেবে যে, আমার কিছু হারানোর নেই। আঠারো বছরেই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ মেডেল জিতেছি। আইবিএলে দু’বার হারিয়েছি তিন বারের অল ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়নকে। এক বার বিশ্বের তিন নম্বরকে। এই ম্যাচটায় চাপে যদি কেউ থাকে তো সেটা সাইনা-ই। ও ব্যাডমিন্টন বিশ্বে আমার চেয়ে ঢের বেশি প্রতিষ্ঠিত। আইবিএলেই আগের ম্যাচে আমাকে হারিয়েছে। আন্তর্জাতিক মঞ্চে আমার উত্থানের পর মিডিয়া সাইনার ওপর থেকে প্রচারের আলো কিছুটা কমিয়ে আনায় নিজেকে প্রমাণ করার দায় ওরই বেশি।
সত্যিই, ফাইনালে সিন্ধুর চেয়ে সাইনার ওপর চাপ বেশি। দু’জনের মধ্যে প্রথম ম্যাচ আইবিএলেই হয়েছে। গ্রুপ লিগ টাইয়ের সেই ম্যাচে সিন্ধুকে হারানোর ঠিক আগেই সাইনা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরেছিল। পাশাপাশি সিন্ধু ফিরেছিল ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের নতুন নায়িকা হয়ে। সেই তুলনায় সাইনা অবশ্য এখন ভাল জায়গায়। আইবিএলে টানা জয়ের ডাবল হ্যাটট্রিক করেছে। টুর্নামেন্টে এখনও অপরাজিত। সিন্ধু সেখানে প্রথম দু’টো ম্যাচ খারাপ খেলেছে। বিশেষ করে ক্যারোলিনা মারিনের বিরুদ্ধে। যে ম্যাচে ওর প্রতিপক্ষ বুঝিয়ে দিয়েছে, সিন্ধুর আসল অস্ত্র স্ম্যাশগুলোকে যদি অপোনেন্ট পরের পর রিটার্ন করে দেয়, তা হলে টিনএজার মেয়েটা ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। প্রচুর আনফোর্সড এরর করে। ফাইনালে সাইনা-ও ওই স্ট্র্যাটেজি নিলে অবাক হব না।
এমনিতে গোপীচন্দের দুই ছাত্রীর খেলার বেসিক স্টাইল একই রকম। দু’জনেই ম্যাচ শুরু হওয়ামাত্র অ্যাটাক করতে ভালবাসে। স্ম্যাশ, নেটের সামনে ড্রিবলিং শটে দুর্দান্ত। চূড়ান্ত ফিট। সাইনার মতো সিন্ধুও এই মুহূর্তে দারুণ ফর্মে। আইবিএলের প্রথম দিকের খারাপ খেলার ধাক্কা সামলে নিয়ে পরপর টাইন বাউন, জুলিয়েন শেঙ্কদের হারিয়েছে। তা সত্ত্বেও আমি একটু হলেও শনিবার সাইনাকে এগিয়ে রাখব। হয়তো ৫২-৪৮। কারণ, আন্তর্জাতিক ব্যাডমিন্টন মঞ্চে এ রকম সুপার ফাইনাল সাইনা অনেক বেশি খেলেছে সিন্ধুর তুলনায়। এ রকম ম্যাচ কী ভাবে বার করে নিতে হয় সেটা অনেক ভাল জানে। হাজার হোক, অভিজ্ঞতার তো একটা দাম আছে। |
দুই কন্যার রণসজ্জা |
সাইনা নেহওয়াল
বয়স: ২৩
উচ্চতা: ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি
ওজন: ৬০ কেজি
র্যাঙ্কিং: ৪
শক্তি: সার্ভিসে বৈচিত্র। নেটের সামনে ড্রিবল শট। ডাউন দ্য লাইন স্ম্যাশ। স্ম্যাশ রিটার্ন। আইবিএলে অপরাজিত। জয়ের ডাবল হ্যাটট্রিক।
দুর্বলতা: নেটের সামনে রিটার্ন। ব্যাকহ্যান্ড। চূড়ান্ত লড়াইয়ে ব্যর্থ হওয়ার প্রবণতা। |
পুসারলা বেঙ্কট সিন্ধু
বয়স: ১৮
উচ্চতা: ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি
ওজন: ৬০ কেজি
র্যাঙ্কিং: ১০
শক্তি: স্ম্যাশের গতি ও বৈচিত্র। কোর্ট কভারিং। ফিটনেস। আইবিএলে দু’বার অল ইংল্যান্ড জয়ীকে হারিয়ে বাড়তি আত্মবিশ্বাস।
দুর্বলতা: বড় টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতা কম। চাপে একবার ভেঙে পড়লে দ্রুত ফিরে আসতে পারেন না। |
গুরুবচন |
...আমার দুই সেরা ছাত্রীর লড়াইটা হবে ওদের শারীরিক শক্তির পাশাপাশি মগজাস্ত্রেরও। যতটা স্টাইলের যুদ্ধ, ততটাই মনোভাবের। দু’জনেরই বয়স কম। চাপে ধৈর্য দেখাতে পারাটা বড় ফ্যাক্টর। সাইনা অন্য লেভেলে। চার বছর বিশ্বের প্রথম পাঁচে। সিন্ধু দুর্ধর্ষ প্রতিভা। প্রথম দশে ওঠা মানেই সে বিশেষ প্রতিভা। আগের বার সাইনা সহজে জিতলেও ফাইনাল সর্বদাই একটা অন্য ব্যাপার।
পুল্লেলা গোপীচন্দ |
|
তবে আইবিএলের পয়েন্ট সিস্টেম যেমন টেবল টেনিসের মতো, তাতে যখন-তখন যে কোনও ফল ঘটতে পারে। টেবল টেনিসের মতোই ঠিক ম্যাচের সময়টুকু প্লেয়ারের ফর্ম, তার মানসিক ও ফিজিক্যাল কন্ডিশন কেমন থাকে তার ওপর রেজাল্ট নির্ভরশীল। ফলে আগাম বলা খুব মুশকিল যে, শনিবার রাত সাড়ে আটটা কিংবা ন’টায় সাইনা আর সিন্ধু ঠিক কী অবস্থায় থাকবে! তবে এই খেলাটার এক জন প্রাক্তনী হিসেবে বলতে পারি, দু’জনই চেষ্টা করবে আগেভাগে নেটের সামনেটার দখল নিতে। বেশি স্ম্যাশ করতে। বিপক্ষকে বেশি দৌড় করাতে। তবে সিন্ধুর বিধ্বংসী স্ম্যাশ যদি সাইনা ফেরত পাঠাতে থাকে, তা হলে কিন্তু দুই হায়দরাবাদির মহাযুদ্ধে সিনিয়রের জেতার সুযোগই বেশি।
গোটা ‘টাই’য়ের হিসেবে অবশ্য সিন্ধুর আওয়াধি-কে এগিয়ে রাখব। কারণ একটাই ডাবলস আর মিক্সড ডাবলস জুটি। দু’টোতেই বিশ্বের প্রথম দশে থাকা প্লেয়ার রয়েছে। সে ক্ষেত্রে আওয়াধির হয়তো স্ট্র্যাটেজি হবে, দুটো ডাবলস জেতার পাশাপাশি বাকি তিনটে সিঙ্গলসের মধ্যে যে কোনও একটা বার করে নেওয়া। ছেলেদের দু’টো সিঙ্গলসে অবশ্য হটশটস-এর অল ইংল্যান্ড সেমিফাইনালিস্ট তাইল্যান্ডের তানংসাক আর আমাদের দেশের এই মুহূর্তে সেরা পুরুষ প্লেয়ার জয়রাম কাগজে-কলমে আওয়াধির দারুণ ফর্মে থাকা শ্রীকান্ত এবং তরুণ প্রতিভা গুরুসাই দত্তের চেয়ে একটু হলেও এগিয়ে।
সুতরাং, সব মিলিয়ে ওয়ারিয়র্স সামান্য এগিয়ে থাকলেও তাদের দিকে ‘হট শটস’ প্রচুর আছড়ে পড়বেই! |
আজ আইবিএল ফাইনালে
সাইনার হটশটস বনাম সিন্ধুর ওয়ারিয়র্স
(ইএসপিএন রাত ৮টা) |